গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৯

অঞ্জন সরকার

ইভ টিসিং



     সন্ধ্যার পর পঞ্চানন-বাটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম প্রায় খালি হয়ে যায়। সন্ধ্যে ছটার প্যাসেঞ্জারের পর, সেই রাত সাড়ে দশটায় রামপুর প্যাসেঞ্জার। সন্ধ্যে ছটার প্যাসেঞ্জার আজ আবার প্রায় এক ঘণ্টা লেট। দু চারটে লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মের লম্বা টানা চত্বরে। সুজন চা-ওয়ালা তার ছাউনি দেওয়া ঠেলা নিয়ে প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষের দিকে একটা বেঞ্চের কাছে দাঁড়িয়েছে। তার সামনেই বিশুপাগলা একটা খাম্বায় হেলান দিয়ে বসে আছে।তাকিয়ে আছে সুজনের চায়ের কেটলির দিকে, যদি এক চুমুক চা পাওয়া যায় সুজনের থেকে। একটু ভালো বিক্রিবাটা হলে এক কাপ চা জুটে যায় বিশুর কপালে। রোজকার যাত্রীরা বহু বছর ধরে দেখে আসছে বিশুকে। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে স্টেশনের চত্বরে চুপচাপ ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, আর মাঝে মধ্যে, কোন অপেক্ষারত যাত্রীর থেকে চেয়ে এক কাপ চা খায়।
    আরতি, টিউশানি পড়িয়ে, এই সন্ধ্যের প্যাসেঞ্জারে বাড়ি ফেরে। প্রায়ই সন্ধ্যে পেরিয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। কখনো তার মোবাইলে মা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে, আজ ঠিক টাইমে ফিরছিস তো?’ আরতি সাধারনত ছোট্ট জবাবে জানিয়ে দেয়, ‘ট্রেন আজ লেট, দেরী হবেমা, উদ্বিগ্ন হয়ে আরতিকে কয়েকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ‘তোকে কতদিন ধরে বলছি, এদিকেই দুটো টিউশানি ধরে নিতে!সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি ত ফিরতে পারবি!না হয় দুটো পয়সা কমই হবে।আরতি, ছোট্ট জবাব দিয়ে, ‘আচ্ছা, দেখব।লে আলোচনা বন্ধ করে দেয়।
    আজও, ট্রেনের অপেক্ষায়, আরতি খালি বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসে। এখনও পৌনে এক ঘণ্টার মতন বাকি ট্রেন আসতে।
    মিনিট দশেক চুপচাপ কেটে যায়। কিছুক্ষন পরে, তিনটি ছেলে, বছর কুড়ি বাইশের মতন বয়েস হবে, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, ও সুজনের চায়ের ঠেলার কাছে গিয়ে তিনটে চায়ের অর্ডার করে। যতক্ষণে চা ঢেলে ওদের দিকে গ্লাস এগিয়ে দেয় সুজন, একটি ছেলের নজর যায় একা বসে থাকা আরতির দিকে। চোখের ইশারায় অন্য দুজনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনজনে নিজেদের চা নিয়ে আরতির পাশে বেঞ্চির খালি জায়গাটায় বসে।আরতি একটু দূরত্ব রাখতে আরও ধারের দিকে সরে যায়। আরতিকে উদ্দেশ্য করে, সন্ধ্যায় অভিসারে যাওয়ার টিপ্পনী ছোঁড়া শুরু হয়।আরতি অগ্রাহ্য করে, চুপ করে বসে থাকে।আজকাল তো পথে ঘাটে এইসব শোনা একঘেঁয়ে হয়ে গেছে, আরতির। ট্রেনটা এখন তাড়াতাড়ি এলে হয়।
    চা শেষ করে কাগজের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ছেলেটি আরতির আরও একটু কাছে ঘেঁসে বসার চেষ্টা করে। আরতি একটু বিরক্তির ভাব দেখিয়ে একেবারে কোনের দিকে সরে যায়।
    আরে, এর পরে তো বেঞ্চি থেকে পড়ে যাবেন!আমরা কি অচ্ছুৎ নাকি, যে একটু গা লাগলেই গঙ্গাস্নান করতে হবে!বলে ছেলে তিনটি নিজেদের মধ্যে বেশ হাসাহাসি করে নিলো।
    আরতি, দাঁতে দাঁত চেপে, ঠোঁটের নিচে চাপা স্বরে বিড়বিড় করে ছোটলোকআউড়ে, বেঞ্চি থেকে উঠে যায়, ও প্ল্যাটফর্মের পেছনের দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্ল্যাটফর্মে,  দূরে দু চারজন বসে থাকা ছাড়া, তেমন কোনও লোক নেই।
     ছেলে তিনটি উঠে আরতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আরতি এবার একটু ভয়ই পেয়ে যায়।এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে কাকে ডাকবে,যদি ছুরি দেখিয়ে অভদ্র আচরণ করে!পাসে যে বসেছিল, ছেলেটি আরতিকে ধমকের সুরে বলে, “ ছোটলোক বলছেন কাকে? আপনি বুঝি রোজ ভদ্রলোকদের সাথে গা ঘষেন, তাই না! আজকে তাহলে ছোটলোকের সাথে গা ঘসা হয়ে যাক?” বলেই, ছেলেটি আরতির কানের দু পাশ দিয়ে দেওয়ালে হাত রেখে, আরতির মুখের কাছে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে যায়।
     আরতি নিচু হয়ে পালাবার চেষ্টা করার আগেই, ছেলেটি হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে।
     বিশু-পাগলা সুজনের ছাউনির ঠেকনা লাঠি নিয়ে, ছেলেটির পিঠে সজোরে আঘাত করে, আর লেঠেলের ক্ষিপ্রতা নিয়ে, অন্য দুজনের ওপরও লাঠি বর্ষণ শুরু করে দেয়। বেগতিক দেখে ছেলেগুলি পালায়, কিন্তু একটি ছেলে হাঁটুতে লাঠির বাড়ি খেয়ে, লেংচে পালাতে পারে না, আর গেটের কাছে ধরা পড়ে, ও রেল পুলিশের হেফাজতে যায়।
               আরতি স্তম্ভিত আকস্মিক ভাবে এক বিভীষিকা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে। আরতি ভেবে পায় না সে কি করে বিশু-পাগলাকে তার কৃতজ্ঞতা জানাবে। আরতি ব্যাগের থেকে একশ টাকার একটা নোট বার করে বকশিশ দিতে যায়। বিশু-পাগলা ঠেলে টাকার হাতটা সরিয়ে দিয়ে, আর্ত স্বরে ধমকায়, “বাড়ি জা! তুই বাড়ি জা! নিয়ে যা তোর টাকা। শিউলি ফেরে নি, তুইও ফিরতিস না!  আরতি দেখে বিশু-পাগলা এক ভীষণ আহত দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে।চোখের কোনে চিকচিক করছে জল।একশ টাকা দিয়ে আব্রু রক্ষার কৃতজ্ঞতা শোধ করতে গিয়েছিল আরতি! এক মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্য বিমুড় হয়ে, হুঁশ সামলে, বিশুপাগলার নোংরা জামাকাপড় উপেক্ষা করে, আরতি নিচু হয়ে প্রণাম করে আর বিশু-পাগলাকে জড়িয়ে ধরে। বিশুপাগলার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে ধরে, কাঁপা স্বরে বলে, “ তুমি আমায় যে ভাবে বাঁচালে, এই ঋণ ত আমি শোধ করতে পারব না, বিশুকাকা?”
বিশুপাগলার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আরতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, “বাড়ি যা, বাড়ি যা, ... বাড়ি যা                
দৈনন্দিন যাত্রীরা কেউই খবর রাখে না, বেশ কিছু বছর আগে পঞ্চানন-বাটির পাশের জোড়াপুকুর গ্রামের বাসিন্দা, বিশ্বনাথ সাহার সোমত্ত অষ্টাদশী মেয়ে শিউলি, এই পঞ্চানন-বাটি স্টেশন থেকেই নিখোঁজ হয়। বিশ্বনাথ সাহার থেকে জন্মায় বিশুপাগলা।