মা
শহরে হঠাৎই বৃহন্নলাদের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে।খোলা রাস্তাতেই উগ্রসাজ আর উন্মুক্ত ক্লিভেজ দেখিয়ে তাদের রমণীয় চালে হাঁটা দেখে নারীরাও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।এই তো,ক'মাস আগের পুজোতেও দেবীমন্ডপ থেকে এক বৃহন্নলাকে এমনই এক সাজে বেরোতে দেখল শ্রী।রাত প্রায় ভোর হতে চলেছিল,তখনও তার সাজের উগ্রতা,তার কামনাময় আঁখির ঔজ্জল্য এতটুকু কমে নি।তবে কি আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ: পুরুষহীন হতে চলেছে?ভাবতে থাকে শ্রী।নারীরও আর প্রয়োজন পড়বে না তারপর।একই দেহে পুরুষ ও নারী মিশে গিয়ে তৈরি করবে সন্তান।বৃহন্নলাদের দেহেও তৈরি হবে মাতৃথলি,তাদের দ্বৈতসত্তার শিশু বেড়ে উঠবে সেই থলিতেই।বেশ হয় কিন্তু এমন হলে।যখনই নারীটির প্রয়োজন পড়বে সে হাতের কাছেই পেয়ে যাবে তার প্রিয় পুরুষটিকে,তার জন্য তাকে আর বাইরে ছোটাছুটি করতে হবে না,পুড়তে হবে না কোন বিরহজ্বালায়।যখনই পুরুষটির প্রয়োজন পড়বে ঢুকে যাবে তার নারীশরীরে। মন্থনদণ্ডটি সেচন করে তুলে আনবে অমৃতের নির্যাস। পান করবে একসাথে বসে পুরুষ ও নারী একই আস্বাদে। কমে যাবে মোবাইলের ব্যবহার, বন্ধ হয়ে যাবে বাতাসে সমস্ত চিঠি ওড়াওড়ি, ডাকঘরগুলি আরও ধু্ঁকতে থাকবে। চালু থাকবে কেবল জরুরি পরিষেবা বিভাগটি। মদ সিগারেট খাওয়াও কমে যাবে বহুল পরিমাণে। ধর্ষণ কমে যাবে, বধুহত্যা কমে যাবে। পুলিশ ও উকিলদের আয়ও যাবে কমে। কত কত দূষণ বন্ধ হয়ে যাবে ভাবতেই শ্রীর দেহ পুলকিত হয়ে ওঠে।
হঠাৎই এক ঝাঁকুনিতে শ্রীর ঘুমের ঘোরটা যায় কেটে। ও মা, সত্যি সত্যিই এক বৃহন্নলা যে! তার কাধে আলত চাপড় মেরে ভিক্ষে চাইছে। শ্রী কোনদিন কোন হিজড়েকে ভিক্ষা দেয় না। তাদের অপমান যেন শ্রীর নিজেরই অপমান। তাদের দেখলেই শ্রী নিজেই যেন এক হিজড়ে হয়ে যেতে চায় মনে মনে। অনুভব করতে চায় তাদের ব্যথা, আনন্দ, তাদের যাবতীয় অপূর্ণতা। মনে হয় কেন তারা ভিক্ষে করবে, কি তাদের অভাব? কেন তারা করুণা আদায় করবে এক একটি অসম্পূর্ণ মানুষের কাছ থেকে? তারা তো তুলনায় অনেক পূর্ণ। একই দেহে নারী ও পুরুষ। অনুভবকে ধারণ করতে পারা তো বিধাতার আশীর্বাদ। কোমলতা ও কঠোরতায় গড়া এক অপূর্ব ভাস্কর্য। গভীর ভালবাসায় চোখ দুটি ভরিয়ে শ্রী চোখ রাখে ওই বৃহন্নলার চোখে। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, তোমার কিসের অভাব বোন? আমি তো তোমার কোন অভাব দেখছি না! বরং এই হাত বড় রিক্ত, বড় বেদনায় জীর্ণ এ হাত। বহু বছরের অসম্মানে কলুষিত হতে হতে ক্ষয়ে যাওয়া এ হাতে তুমি যদি কিছু ভিক্ষে দাও তবে তা মাথায় করে রাখি। তোমার ওই পূর্ণতা দাও বোন, আমার আঁচল পেতে ভিক্ষে করছি, সহস্রবছরের অন্যায় বঞ্চনা ও উপহাসের তোড়েও ভেসে না গিয়ে বিদ্রূপের তালি মেরে তাকে উড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্রটি দাও বোন, আমার দুর্বল পা দুটিকে আবার নিজের ভার নিজে বওয়ার শক্তি দাও বোন, তোমাদের মতো শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গিয়ে পুরুষের কলার চেপে ধরার মুন্সিয়ানা দাও বোন। আমাকে তুলে ধর,আমাকে তোমাদের জগতে নিয়ে চল বোন, আমাকে মুক্তি দাও। হিজরেটি বলে উঠল,দিতে পারি, তুমি তোমার গর্ভটি ভাড়া দেবে আমাকে? তাহলে দিতে পারি। আমি অবাক চোখে চেয়ে রইলাম সেই হিজড়ের দিকে। গর্ভ চায়? পৃথিবীর সব সুখ পেয়েও সে একটি গর্ভ চায় কেবল বন্দী হওয়ার জন্য?পুরুষের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার জন্য সে সকল সুখ, সকল স্বাধীনতা বলি দিতে চায়? তবে তুই হিজড়ে হলি কেন? গর্ভই যদি কাম্য তবে তুই হিজড়ে হলি কেন? আয় তোর সকল পুরুষ অঙ্গ ছেটে দিয়ে আমার গর্ভ যোগ করে দিই। তুই ধীরে ধীরে মা হয়ে ওঠ আর আমি পুরুষ। তোকে বন্দি করে ফেলি আমার খাঁচায়। আজ থেকে আমি ছড়ি ঘোরাব তোর ওপরে। আমি কর্তা আর তুই দাসী। আমি যখন যা বলব তোকে তাই করতে হবে। আমি যখন সন্তান চাইব তোকে দিতে হবে, আমি যখন বলব এবার থাম, তোকে থামতে হবে। আমি যখন বলব দে তোর শরীর দে, আমার ভীষণ শীত করছে, তখনই সব ছেড়ে এসে আমাকে গরম করে দিতে হবে। পারবি, বল পারবি এসব করতে? বললি, পারব, মা হওয়ার জন্য আমি সব ছাড়তে পারব। বলে কি! এ ছুঁড়ি বলে কি? মা হওয়ার জন্য ও সব ছাড়তে পারবে? দুলে উঠল আমার বিশ্ব, দুলে উঠল আমার সমস্ত বেদনাবহ সেই মাতৃহৃদয়। অনুভব করলাম সেই প্রথম আমার অমূল্য সত্তাটিকে। না, না, না, আমি হারিনি, আমি হারিনি। পৃথিবীর কোন পুরুষের ক্ষমতা নেই আর আমাকে ছোট করার। হা হা হা! পুরুষ! দেখ তোর হৃদয়ও মা হতে চায়। তোর হৃদয়ও পেতে চায় একটা গর্ভ। একটা গর্ভ নেই বলে হিংসায় তোরা জ্বলে পুড়ে মরিস। কেড়ে নিতে চাস, ছিঁড়ে নিতে চাস, পুড়িয়ে ফেলতে চাস আমাদের সেই মাতৃজঠরটিকে, তাই এতো ধর্ষণ চারিদিকে। তাই এতো মারামারি, লাঠালাঠি। তাই এতো যুদ্ধ। দেব না দেব না, কোনদিনও দেব না এই জঠর তোদের হাতে তুলে। আমি মা, আমি জননী, আমি রক্ষাকর্ত্রী। আয়, পৃথিবীর সকল সন্তান আয় আমার বুকে। পুরুষ, তুইও তো আসলে একটা শিশু। রাত হলেই ঘুমোতে আসিস আমার বুকে, ঢুকে যেতে চাস সেই জঠরে যেখানে তোকে আর কেউ আঘাত দেবে না। আয়, তোকে স্তন্যপান করিয়ে আমিও নিদ্রা যাই।