হিরোইনের
লাশ
মৃত কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত লাশটা তুলে এনে শোয়ানো হয় মর্গের টেবিলে । পাওয়া
গিয়েছে রেললাইনের ধারে জলাভূমিতে । মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বেআবরু অবস্থায় । ঠিক বেআবরু
নয় । গায়ের দামী জামাটা এমন ভাবে ছিঁড়ে ফালাফালা করা হয়েছে যে ঐ শরীরে আব্রু বলে
কিছুই আর অবশেষ নেই । পরণের শালোয়ার কোমর থেকে নেমে এসেছে একেবারে হাঁটুর নিচে ।
মৃত কিশোরীটিকে সেই অবস্থায় তুলে এনে শোয়ানো হয় মর্গের টেবিলে । পুলিশ , ক্যামেরাম্যান এবং মর্গের
গুটিকতক কর্মচারি ঘিরে আছে ওর লাশ । ক্যামেরাম্যান লাগাতার ক্যামেরার সাটার টিপে
চলেছে, ক্লিক্
ক্লিক্ ক্লিক্ । সেইসঙ্গে ঝিলিক দিয়ে উঠছে ফ্ল্যাশলাইটের তীব্র আলো ।
ফ্ল্যাশ লাইটের আলো এসে চোখে পড়তেই কিশোরীর লাশটা বেদম চমকে ওঠে । হায় রে, আজ আবার মরতে হবে ! গত রাত্রে সিনেমাওয়ালা বাবুরা যে এমন করেই ওর ছবি তুলেছিলেন
। ওই বাড়ির বাবু বলেছিলেন ওকে নাকি সিনেমার হিরোইন করে দেবেন । গিন্নীমা সেই শুনে নিজের হাতে ওকে সাজিয়েগুছিয়ে
পাঠিয়েছিলেন বাবুর সঙ্গে । তারপর......
পরক্ষণে লাশটা লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে চোখদুটো বুজে নেয় । গত রাত্রে হোটেলের ঘরে
ওকে নগ্ন করে ছবি তোলার পর লোকগুলো ওর সঙ্গে কুকর্ম করতে যেতে ও প্রবলভাবে বাধা
দিয়েছিলো বলেই না আজ এতগুলো মানুষের সামনে ওকে আবার বেআবরু হতে হচ্ছে !
কিশোরীর লাশটা লজ্জায় চোখ বুজে পড়ে থাকে মর্গের টেবিলে । গত রাতে যা যা
ঘটেছিলো তারপর এদের আর বাধা দিতে ইচ্ছে করছে না ওর । বাধা দেবার ইচ্ছেটাই যে মরে
গিয়েছে ওর মন থেকে ।
অতীতের ছায়াছবি
ষাট বছরের বৃদ্ধ কমলাকান্ত আজও নিয়ম করে খাতা নিয়ে কবিতা লিখতে বসেন । সেই কোন
ছেলেবেলা থেকে কবি হবার ইচ্ছে পুষে রেখেছেন মনে । সেই ইচ্ছে পূর্ণতা পায়নি বলে আজও
হাল ছাড়েননি । তবে একটা ব্যাপারে খুবই ভাবনায় পড়েছেন তিনি । আজকাল অনেক কথাই মনে রাখতে পারছেন না । এমনকি
একটু আগে যা যা ভেবেছেন অনেকসময়ে সেসবও ভুলে যান মুহূর্তের মধ্যে । এই যেমন, খানিক আগে হয়তো লিখতে বসেছিলেন
হঠাৎ করে মনে উদয় হওয়া একটা
কবিতার দুটো লাইন , “পাখিসব করে রব / বিছানা
ছাড়ো ভাইসব” । কিন্তু লেখার সময় লিখে বসছেন “পাখি সব করে রব / ছুঁড়ে দাও
গম যব” ।
আজকাল এমন অনেক
ভুলই করে বসছেন তিনি । এমনকি নিজে ছেলে সুমন্তকেও প্রতিবেশী বন্ধু বলে ভ্রম করে
বসেন কখনো সখনো । এই নিয়ে বাপের
আড়ালে খুবই রাগ ফলায় সুমন্ত । মাঝেমধ্যে বাপকেও
দুটো কথা শুনিয়ে দেয় রাগের বশে । বৃদ্ধ কমলাকান্ত ছেলের
অকথা-কুকথাও মনে রাখতে পারেন না ।
আজ সকালে পুরোনো আসবাবপত্রে ঠাঁসা ঘরে কি একটা বস্তু খুঁজতে ঢুকেছিলো সুমন্ত ।
খুঁজতে খুঁজতে হাতে পেয়ে যায় বাবার অনেক কাল আগেকার একটা ভাঙা ঝর্ণাকলম । ও শুনেছে বাবা নাকি এক সময় এই কলম
দিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছেন এবং কোনো একদিন রাগ করে নিজেই আছড়ে ভেঙেছেন এই কলম ।
ঝর্ণাকলমটা কবে থেকে যেন আশ্রয়
পেয়েছে এই আবর্জনার স্তুপে । যাইহোক সুমন্ত ভাঙা ঝর্ণাকলমটা এনে বাবাকে দেখিয়ে শুধোয় – এই ঝর্ণাকলমটা চিনতে পারছো বাবা ?
কমলাকান্ত কবিতার খাতা খুলে বসেছিলেন । এখনো কলমের আঁচড় কাটতে পারেননি খাতার
সাতা পাতায় । ছেলের কথায় মুখ তুলে চেয়ে একগাল হেসে বলেন – আসুন আসুন দীপকবাবু । অনেক দিন পর মনে পড়লো আমাকে ? বসুন বসুন, দুটো কথা বলি আপনার সঙ্গে ।
ধূস্, আমি দীপককাকু নই । আমি সুমন্ত । এই নাও তোমার ভাঙ্গা ঝর্ণাকলম । খুঁজে পেলাম
ভাঙাচোরার ভিতর থেকে । সুমন্তর গলায় একরাশ বিরক্তি
ঝরে পড়ে ।
ওহো,
অত সুন্দর ঝর্ণাকলমটা ভেঙ্গে ফেলেছো তুমি ? তোমাদের হাতে কি সংসারের কিছুই
আর আস্ত থাকবে না বাপ ? কমলাকান্ত ছেলেকে চিনতে পেরে রাগ ফলাতে কসুর করেন না ।
সুমন্ত একপ্রকার জোর করে ঝর্ণাকলমটা বাবার হাতে গুঁজে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়
রাগে পা দাপাতে দাপাতে । ঝর্ণাকলমটা হাতে নেবার পরই বৃদ্ধ কমলাকান্তর চোখের সামনে
ঝুলে থাকা অদৃশ্য পরদায় ভেসে ওঠে অনেক কাল আগেকার একটা দিনের টুকরো টুকরো কিছু ছবি
। ঝর্ণাকলম ছুঁড়ে ফেললেন ......সাদা খাতা
বক হয়ে ........
নিবভাঙা ঝর্ণাকলম হাতে নিয়ে চোখের সামনে ঝুলন্ত অদৃশ্য পরদায় বৃদ্ধ কমলাকান্ত
দেখে চলেছেন একটার পর একটা ছবি । সেদিনের মতো আজও সাদা খাতার পাতায় একটা আঁচড়
কাটতে পারলেন না তিনি ।