আমি
আছি না
সে অনেককাল আগেকার কথা । সেবার
প্রবল দাঙ্গা বেঁধেছে দেশে । প্রাণ হাতে করে বর্ডারের দিকে ছুটছি আর সকলের সাথে ।
সামনে থেকে বিপদ এলে পিছিয়ে আসার গেট বন্ধ । মানুষে মানুষে অবিরাম ঠেলাঠেলি চলেছে
পিছনে । অদূরেই ভারতের বর্ডার । বর্ডারে সশস্ত্র সৈনিকের কড়া নজর । ওদের দৃষ্টি
এড়িয়ে বর্ডার পার করা মুখের কথা নয় । যেনতেনপ্রকারেণ যেতেই হবে বর্ডারের ওপারে ।
এখন উপায় ?
সহসা কে যেন কানের কাছে মুখ এনে
ফিসফিস করে বললো – চিন্তা
করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি
না ?
এরপর কীকরে বর্ডার পার হলাম, কীকরে ভারতে এসে আশ্রয় নিলাম নিরাপদ স্থানে কিছুই টের পেলাম না । সবই ঘটলো তার
কৃপায় । এসে পড়লাম একেবারে নতুন একটা জায়গায় । কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাইয়ের কী
ব্যবস্থা হবে ? গাছতলায় তো থাকা যায় না ।
আবার সেই গলা বেজে উঠলো আমার
কানের কাছে – চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ?
তারই কৃপায় এরপর অনেক কিছুই হলো
আমার । নতুন একটা ঘর হলো । গ্রাসাচ্ছাদনেরও একটা ব্যবস্থা হলো । এমনকি বিয়ে করে
সংসার পাতাও হলো একদিন । সবই হলো ‘আমি আছি না কত্তার’ দৌলতে একেবারে নির্বিবাদে । দিনগুলো বেশ আনন্দেই দিন কাটছে ।
বিয়ের মাস ছয়েক পর এক রাত্রে
স্ত্রী হঠাৎ অনুযোগ করে বললো – এ কেমন পুরুষ মানুষ তুমি ? আজ পর্যন্ত একটা সন্তানেরও .........
এবার আর কানের কাছে নয় অন্ধকার
ঘরের ভিতর সেই গলা বেজে উঠলো গমগম করে – খামোখা চিন্তা করছেন কত্তা । আমি আছি না ?
স্ত্রী শুনেই গোসা করে বাপের
বাড়ি যাবার তোড়জোড় জুড়ে দিলো । তাকে কিছুতেই ধরেবেঁধে রাখা যাচ্ছে না । আমাকে
ভাবনায় পড়ে যেতে দেখে সেই গলাটা আবার বেজে উঠলো আমার কানের পাশে - চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ?
এবার আমি রেগে গিয়ে সেই অদৃশ্য
গলাকে বললাম – কেন ? তুমি কি আমার হয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ইয়ে.........
ছি-ছি কত্তা । অমন কথা মুখে আনাও পাপ । তবে কিনা একটা ব্যবস্থা
ঠিক হয়ে যাবে । একবার দেখুনই না কি ব্যবস্থা নিই ।
আমার জন্য কী করেছে টের পেলাম
স্ত্রী যখন বাপের বাড়ির যাবার জন্য সুটকেস নিয়ে ঘরের বাইরে পা রেখেছেন তখন । তিনি
ঘরের বাইরে পা রাখামাত্র সিঁড়ির এক পাশ থেকে একটি সদ্যোজাত শিশুর কান্না বেজে উঠলো
। শিশুটিকে দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠে বললাম – এ কার সন্তান ? এখানে এলো
কীকরে ?
চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ? সব
খবরাখবরই আপনি পেয়ে যাবেন ।
খাঁটী কথা বলেছে । আমাকে আর
এতটুকুও চিন্তা করতে হলো না । স্ত্রী যখন বাপের বাড়ি যাওয়া ভুলে শিশুটিকে কোলে
নিয়ে ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন ঘটনাটা তখনই ঘটল । সহসা সেই শিশুটির মা-বাবা এসে হাজির হলো পুলিশ নিয়ে । ওদের দেখে অদৃশ্য গলাটা আবার বেজে উঠলো কানের
পাশে – বলেছিলাম না চিন্তা করবেন না । কার সন্তান, এলো কীকরে – সবই জানতে পারবেন ওদের মুখে ।
তবে কত্তা, একটা কথা আগাম জানিয়ে রাখি ।
আজকের পর আমাকে আর কাছে পাবেন না আপনি । এই শেষবারের মত আপনার চিন্তা দূর করে দিয়ে
গেলাম ।
আজকাল স্ত্রীকে নিয়ে হাজতে বসে
ঘানি টেনে চলেছি সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়েও ।
শর্ত
সন্ধ্যের পরপরই প্রিয়াকে আসতে
দেখে অভ্র খুব অবাক হলো । ওরা তো কাশ্মীরে বেড়াতে গেছিলো । কবে ফিরলো ! হিসেব মতো তো আরও দিনচারেক পর আসার কথা ! তাহলে কি আগেই ফিরে এসেছে !
প্রিয়া হাসলো - তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলো বলে চলে এলাম । তাছাড়া মনটাও ভালো নেই । এসো না, দু’জনে মিলে হেঁটে আসি এই
আলোআঁধারিতে ।
অভ্র ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পথে
নেমে এলো প্রিয়ার সাথে । ধীরে ধীরে কালো আঁধারের ছেয়ে যাচ্ছে চরাচর । দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছে টুকটাক কথা বলতে বলতে । অনেকটা হাঁটার পর রাস্তার পাশেই
একটা প্রাচীন বটগাছের তলায় বাঁধানো বেদীতে বসে পড়লো প্রিয়া । অভ্রকে টেনে বসালো
নিজের পাশে । রাত এতক্ষণে আরও গভীর হয়েছে । রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে ।
প্রিয়া হঠাৎ আবদার ধরে বসলো – আমাকে একটু আদর করবে অভ্র ?
- এখানে, এই রাস্তার ওপর ? কেউ দেখে
ফেললে লজ্জার শেষ থাকবে না আমাদের ।
কেউ দেখবে না । এমন আড়াল কর দেবো যে এক হাত দূর
থেকেও কেউ দেখতে পাবে না তোমাকে ।ভাববে আমি একলাই বসে আছে বটগাছ তলায় ।
অভ্র আর কথা না বাড়িয়ে প্রিয়ার
সুন্দর মুখটা নিজের দু’হাতের তালুবন্দী করে কাছে আনতে গিয়ে বাধা পেলো প্রিয়ার কাছ থেকে - তার আগে একটা শর্ত মানতে হবে
তোমাকে ।
কি সেই শর্ত ? এই সুন্দর রাতটাকে আর একমুহূর্তও বিফলে যেতে দিতে চাই না প্রিয়া ।
খেয়াল রেখো । আমাকে আদর করার সময় তোমার চোখদুটো যেন বন্ধ
থাকে । একদম খুলবে না ।
ওহ্ এই কথা ! আমি ভাবলাম কি না কি । এই নাও, চোখ বন্ধ করলাম । এবার হবে তো ?
হবে ।
অভ্র আর কথা না বাড়িয়ে প্রিয়ার
রক্তিম অধরে আলতো করে চুমু খাওয়া মাত্র
অনুভব করলো ওর ওই মুখে যেন রক্তমাংসের লেশমাত্র নেই ! শর্ত ভেঙে দ্রুত চোখ খুলে দেখলোওর হাতের তালুতে বন্দী হয়ে রয়েছে একটা কঙ্কালের মুখ ।