গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ জুলাই, ২০১৮

সুধাংশু চক্রবর্ত্তী / দুটি অনুগল্প

আমি আছি না

সে অনেককাল আগেকার কথা । সেবার প্রবল দাঙ্গা বেঁধেছে দেশে । প্রাণ হাতে করে বর্ডারের দিকে ছুটছি আর সকলের সাথে । সামনে থেকে বিপদ এলে পিছিয়ে আসার গেট বন্ধ । মানুষে মানুষে অবিরাম ঠেলাঠেলি চলেছে পিছনে । অদূরেই ভারতের বর্ডার । বর্ডারে সশস্ত্র সৈনিকের কড়া নজর । ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে বর্ডার পার করা মুখের কথা নয় । যেনতেনপ্রকারেণ যেতেই হবে বর্ডারের ওপারে । এখন উপায় ?

সহসা কে যেন কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ?
এরপর কীকরে বর্ডার পার হলাম, কীকরে ভারতে এসে আশ্রয় নিলাম নিরাপদ স্থানে কিছুই টের পেলাম না । সবই ঘটলো তার কৃপায় । এসে পড়লাম একেবারে নতুন একটা জায়গায় । কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাইয়ের কী ব্যবস্থা হবে ? গাছতলায় তো থাকা যায় না ।
আবার সেই গলা বেজে উঠলো আমার কানের কাছে চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ?

তারই কৃপায় এরপর অনেক কিছুই হলো আমার । নতুন একটা ঘর হলো । গ্রাসাচ্ছাদনেরও একটা ব্যবস্থা হলো । এমনকি বিয়ে করে সংসার পাতাও হলো একদিন । সবই হলো আমি আছি না কত্তারদৌলতে একেবারে নির্বিবাদে । দিনগুলো বেশ আনন্দেই দিন কাটছে ।

বিয়ের মাস ছয়েক পর এক রাত্রে স্ত্রী হঠাৎ অনুযোগ করে বললো এ কেমন পুরুষ মানুষ তুমি ? আজ পর্যন্ত একটা সন্তানেরও .........
এবার আর কানের কাছে নয় অন্ধকার ঘরের ভিতর সেই গলা বেজে উঠলো গমগম করে খামোখা চিন্তা করছেন কত্তা । আমি আছি না ?
স্ত্রী শুনেই গোসা করে বাপের বাড়ি যাবার তোড়জোড় জুড়ে দিলো । তাকে কিছুতেই ধরেবেঁধে রাখা যাচ্ছে না । আমাকে ভাবনায় পড়ে যেতে দেখে সেই গলাটা আবার বেজে উঠলো আমার কানের পাশে - চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ?

এবার আমি রেগে গিয়ে সেই অদৃশ্য গলাকে বললাম কেন ? তুমি কি আমার হয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ইয়ে.........

ছি-ছি কত্তা । অমন কথা মুখে আনাও পাপ । তবে কিনা একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে । একবার দেখুনই না কি ব্যবস্থা নিই ।

আমার জন্য কী করেছে টের পেলাম স্ত্রী যখন বাপের বাড়ির যাবার জন্য সুটকেস নিয়ে ঘরের বাইরে পা রেখেছেন তখন । তিনি ঘরের বাইরে পা রাখামাত্র সিঁড়ির এক পাশ থেকে একটি সদ্যোজাত শিশুর কান্না বেজে উঠলো । শিশুটিকে দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠে বললাম এ কার সন্তান ? এখানে এলো কীকরে ?

চিন্তা করছেন কেন কত্তা ? আমি আছি না ? সব খবরাখবরই আপনি পেয়ে যাবেন ।

খাঁটী কথা বলেছে । আমাকে আর এতটুকুও চিন্তা করতে হলো না । স্ত্রী যখন বাপের বাড়ি যাওয়া ভুলে শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন ঘটনাটা তখনই ঘটল । সহসা সেই শিশুটির মা-বাবা এসে হাজির হলো পুলিশ নিয়ে । ওদের দেখে অদৃশ্য গলাটা আবার বেজে উঠলো কানের পাশে বলেছিলাম না চিন্তা করবেন না । কার সন্তান, এলো কীকরে সবই জানতে পারবেন ওদের মুখে । তবে কত্তা, একটা কথা আগাম জানিয়ে রাখি । আজকের পর আমাকে আর কাছে পাবেন না আপনি । এই শেষবারের মত আপনার চিন্তা দূর করে দিয়ে গেলাম ।
আজকাল স্ত্রীকে নিয়ে হাজতে বসে ঘানি টেনে চলেছি সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়েও ।


শর্ত

সন্ধ্যের পরপরই প্রিয়াকে আসতে দেখে অভ্র খুব অবাক হলো । ওরা তো কাশ্মীরে বেড়াতে গেছিলো । কবে ফিরলো ! হিসেব মতো তো আরও দিনচারেক পর আসার কথা ! তাহলে কি আগেই ফিরে এসেছে !
প্রিয়া হাসলো - তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলো বলে চলে এলাম । তাছাড়া মনটাও ভালো নেই । এসো না, দুজনে মিলে হেঁটে আসি এই আলোআঁধারিতে ।
অভ্র ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পথে নেমে এলো প্রিয়ার সাথে । ধীরে ধীরে কালো আঁধারের ছেয়ে যাচ্ছে চরাচর । দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে টুকটাক কথা বলতে বলতে । অনেকটা হাঁটার পর রাস্তার পাশেই একটা প্রাচীন বটগাছের তলায় বাঁধানো বেদীতে বসে পড়লো প্রিয়া । অভ্রকে টেনে বসালো নিজের পাশে । রাত এতক্ষণে আরও গভীর হয়েছে । রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে । প্রিয়া হঠাৎ আবদার ধরে বসলো আমাকে একটু আদর করবে অভ্র ?
- এখানে, এই রাস্তার ওপর ? কেউ দেখে ফেললে লজ্জার শেষ থাকবে না আমাদের ।  
 কেউ দেখবে না । এমন আড়াল কর দেবো যে এক হাত দূর থেকেও কেউ দেখতে পাবে না তোমাকে ।ভাববে আমি একলাই বসে আছে বটগাছ তলায় ।   
অভ্র আর কথা না বাড়িয়ে প্রিয়ার সুন্দর মুখটা নিজের দুহাতের তালুবন্দী করে কাছে আনতে গিয়ে বাধা পেলো প্রিয়ার কাছ থেকে - তার আগে একটা শর্ত মানতে হবে তোমাকে ।
 কি সেই শর্ত ? এই সুন্দর রাতটাকে আর একমুহূর্তও বিফলে যেতে দিতে চাই না প্রিয়া ।
 খেয়াল রেখো । আমাকে আদর করার সময় তোমার চোখদুটো যেন বন্ধ থাকে  । একদম খুলবে না
ওহ্‌ এই কথা ! আমি ভাবলাম কি না কি । এই নাও, চোখ বন্ধ করলাম । এবার হবে তো ?
 হবে ।
অভ্র আর কথা না বাড়িয়ে প্রিয়ার রক্তিম অধরে আলতো করে চুমু খাওয়া মাত্র  অনুভব করলো ওর ওই মুখে যেন রক্তমাংসের লেশমাত্র নেই ! শর্ত ভেঙে দ্রুত চোখ খুলে দেখলোওর হাতের তালুতে বন্দী হয়ে রয়েছে একটা কঙ্কালের মুখ ।