নির্ঝরা
নির্ঝরার চশমাআঁটা চোখে এখনো খেলে বেড়ায় লাল-সবুজ মাছ। শাড়ির জমিনে কেমন এঁকেবেঁকে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সে তরুণী
কি সুন্দর মিলে মিশে থাকে ডাবল ব্লকে। ‘‘নিজের কাজ দেখে নিজেই
মুগ্ধ’’ মেডামের ঠাট্রা গায়ে মেখে চোখ সরায়।নতুন শাড়ি নেয় ওড়না,
থ্রিপিচ। ওড়নার কাজ শেষ হতেই চায় না।হাত ধরে আসে, শ্বাস পড়ে জোরে। মেডাম একটি খাবারের বাটি এগিয়ে দেয়। গতকালের রান্নার ক্লাশে
তৈরী করা পেটিস ও পেনকেক।
নির্ঝরা চিত্রপটের দিকে তাকিয়ে আছে । তের/সতের ইঞ্চির ক্যানভাসে নিজের আঁকা চিত্রটি ইজেলে ভাসছে।চারটি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো কাঠের এ ইজেলের মাঝখানে
ড্রয়ার যাতে রাখা যায় রঙ আর ক্যানভাসের নিচে আড়াআড়িভাবে তুলি। একটি কাঠের পাতলা অংশ বেরিয়ে আসে একটা বোতাম
টিপলে যাতে ব্যবহৃত তুলিগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয় একটা পটে। ইচ্ছে করলে একে ভাঁজ করে
বক্স বানিয়ে ব্রিফকেসের মতো নেয়া-আনা করা যায়। লন্ডনের আর্টের
সরঞ্জামাদির দোকান ‘আটলান্টিস’ থেকে নব্বই
পাউন্ড দিয়ে কিনেছে ইজেলটা।গত দশ বছর ধরে চলছে বিরামহীন আঁকাআঁকি। কয়েক হাজার ছবি।
বাইরে নিয়েছিল অনেকবার। টেমস নদীর পাড়ে। লন্ডন ব্রিজের কিনারা ঘেষে
দেয়ালটা শেষ হয়েছে যেখানে। নৌকা আর নদীর ছবি ছিল সেটা। আরো মাইল্যন্ড পার্ক,
কিউ গার্ডেন। কিউ গার্ডেন মানে প্রকৃতি। সাজানো অথচ সাজানো নয়। যেন খোলা
প্রকৃতি অথচ পার্ক । ছিল একটা গ্রিন হাউজও যাতে বিভিন্ন দেশের ছোট গাছ ও গুল্ম সাজানো
থরে থরে।এশিয়ার গ্রামের কচুশাক আর ঢেঁকিশাক আর বাগানের মাটি নির্ঝরার চোখে জল এনে দেয়।দেশের
মাটিতে নাড়ি, দেশের মধ্যে শক্তি। নয়তো চোখে জল আসে কেন! তাই তো এ ফিরে আসা মাটির গন্ধ শুঁকে স্মৃতির হরিয়াল।
প্রবাসী পল্লীর কাছ থেকে কেনা তিন কাঠার তিন দুই অংশে করা রূপগঞ্জের
গ্রাম বহুল্ত্এ বাড়িটির পঞ্চাশ -চল্লিশ ফিটের এ কক্ষটি
নির্ঝরার ছবি আঁকার ঘর--আর্টিস্টগণ যাকে স্টুডিও বলে।রাত নিঝুম
হলেই ঘুমের ফাঁক গলে নির্ঝরা তার স্টুডিওতে আসে।নির্ঝরিণি-নির্ঝরা-নিঝু তিনটিই তার ডাক নাম। কারো আদুরে ডাক ছেনীর মতো বুকে বিঁধে। আহা ডাকটা
থাকুক...রঙ আর তুলি, ইজেল আর ক্যানভাস।
অংকন আর মগ্নতা।স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মত ঋজু তার মনোবল। কোথাও ভাঙন
নেই, রিক্তের বেদনও নয়। এ ঘর থেকে আকাশ দেখা যায় না। মগ্নতার
গভীরে ঢোকে আকাশ স্পর্শ করে নির্ঝরা।গায়ে মাখে মেঘ-রোদ আর বৃষ্টি।ডুব
দেয়। স্মৃতির গহীন থেকে তুলে আনে শাপলা-শালুক আর হিযল তমালের
ছায়া।নিরিবিলি এ সময়টা স্পর্শ করে অধরা সময় আর পেরিয়ে আসা দিনের অনুরাগ। জানালাবিহীন এ ঘরের দেয়াল মেঝেতে
স্তূপাকার আর আড়াআড়িভাবে রাখা চিত্রপটে সেসব মনি-মুক্তো ঝলঝলে।
মগ্নতা তাকে নিয়ে যায় শহর ছেড়ে কোন দূর গ্রাম-পথ পেরিয়ে কোন এক পাকা আধভাঙা পাকা ঘাটে।একটি শিশু জল ছিটায়। সে ছেলেশিশুর পানিতে হিসি
করার কারণে আরেকটি মেয়েশিশু সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে বসে। সকালের বাসিমুখ ধুতে হবে যে।হাত
দিয়ে সরায় ‘ও হিসি জল এদিকে এসো না।’ আচমকা
হিসিশিশুটির ধাক্কায় পানিতে পড়ে যায় সিঁড়ির পাশঘেষা মেয়েশিশুটি। সাঁতার জানে না গো...
পাড়ছোঁয়ানো বর্ষার ডুবোপুকুর। শিশুটি ভাসে-ডোবে
হাত বাড়ায় কিনারা চায়।ওহ! নির্ঝরা কেঁপে ওঠে!
চিত্রপটে ধাক্কায় পড়ে যেতে থাকা শিশুটিকে আঁকতে চায়।শুকনো হলুদ পাতার
মতো ফ্রক পরা, ফুটফুটে মুখ। থৈ থৈ জল, চারপাশে ঘন গাছ। আম, গাব, করই,
মান্দার, ডুমুর, কৃষ্ণচুড়া,
সোনালু কি নেই! বৃক্ষদের কোলে এ স্তব্ধ পুকুর গ্রামের
বৌ-ঝিদের এ-ঘাট থেকে ও-ঘাটে গল্পের মুখরতায় মেতে থাকে বেশি সময় । মাঝে মাঝে ‘ডুব ডুব’ করে পুকুরে পড়ে আম, গাব
ও ডুমুর।কখনো ঝপাৎ শব্দে পড়ে নারিকেল। মালিক পক্ষের সাথে ছুটে আসে আরো অনেক পক্ষ ভেসে
থাকা নারিকেল দেখে। পুকুরের পানিতে আধা ডোবানো একটি নারিকেল গাছ বেঁকে আধশোয়া -- মাথাটা উপরের দিকে... পুকুরের রঙটা সবুজ হওয়া চাই। নীল
আর লেবু হলুদ আর সাদা মেশালে যে সবুজ হয় অনেকটা তেমন হবে এ কিনারার জলের রঙ। পাতার
রঙ করতে শুধু নীল আর লেবু হলুদ, আর বুড়ো পাতা হলে সোনালি হলুদ!
‘রঙটা একটু বেশি করে মিশ্রণ করো;
না হলে পরে একই রঙ পাওয়া কঠিন হয়।’ কে কে বলছে!
গল্পের রঙ মাখিয়ে কঠিন প্রশিক্ষনের বিষয়গুলোকে সহজ করার গতিময়তা!
সেই যে তরুণ কাল! হ্যা, বাটিক,
সেলাই মেডাম।ব্লক, রঙ,তুলি,
পানি, মোম, রজন, গাম...জীবন অন্বেষণ।শাড়ির পর শাড়ি, থ্রি পিচের পর থ্রিপিচ ব্লক কর, বাটিক কর ফেব্রিক্সে
ব্রাশ ঘষাও।
‘প্রতি শাড়িতে ব্লক করলে বিশ টাকা
পাবে আর বাটিক করলে দেড়শত টাকা। করবে কি?’ কেন নয়। সংসার নুন
আনতে পান্তা ফুরুবার দলে। আরও চাই তেল, সবজি; মাংস নাই হলো মাছ, ডিম তো খেতে হয়। সাথে থাকে মুখ হা
করা বাসা ভাড়া। বাসা নয় গো ছোট ঘর।পাখির বাসার মতো। ফ্লাটের শেষ সীমায় ছোট ঘরটিতে যেতে
একে একে দুটো বেড রুম পার হতে হয়।কেউ শুয়ে থাকে কেউ বসে...গম্ভীর
ভারকরা মুখ। কত গান হয়েছিল একসাথে, কত গল্প, হাসি, ঠাট্রা আবেদন নিবেদন। জীবন যখন পড়তির দিকে আপনজনও
সে পথ ধরে হাঁটে আগে আগে।
ঘরটির ছোট জানালার সামনে বিশাল আম
গাছ। ‘ঝুপ’ করে’ আম
পড়ে জানালার সামনে ছোট বেলার কথা চ্যাৎ করে কাঁপিয়ে দেয়। জানালা খোলা রাখলেও কেউ দেখে
না শুধু দেখে অভাব আর চেটেপুটে খায় ভালোবাসার গুঞ্জরণ; পরস্পরের
আলিঙ্গন থেকে খুলে নেয় আবেগের মোহময় কাল।আর মৌ মক্ষিকা হ’য়ে হুল
ফুটায়।
নির্ঝরা ব্লক করে, বাটিক করে...‘রঙের উপরে রঙ মানে ডাবল ব্লক হলে শুধু আঁচল পাড়ে পঞ্চাশ টাকা, মেডাম পাবে দেড়শ টাকা। তা পাক। তার ব্লক, রঙ ও ঘর। দোকানীরা
তাকেই কাজ দিয়েছে। রঙের মিশ্রণটা শিখে নিলে নির্ঝরা নিজেই করতে পারত এ কাজ । কিন্তু
এসব কাজের আদি ইতি শিখতে লাগবে এক হাজার টাকা। বাটিকের আরো বেশি মোম, রজন, গাম, লোহার ব্লক আর শেখার
চার্জ পুরো দুই হাজার টাকা।
দ্রুত কাজ শেষ করে চট থেকে রঙ তুলে, ব্রাশ
ধুয়ে, সবকিছু ঠিক জায়গায় রেখে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে দুপুরের কড়া রোদ,
যাম আর যানজটের ভিতর দিয়ে দৌড়ায় নির্ঝরা।আলু, ডিম
ও তেল কেনে। আর কেনে সাত টাকা দামে একটা চকবার। মাঝে মাঝে চকবার খেয়ে তার মন থেকে অভাবের
অভাবীয় বোধটা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। স্বামী ঘুমায়। চশমার আড়ালে চকচক করে শ্যামলকান্তি মুখশ্রী।
বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হ’য়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বইটা বুকের উপর। বই পড়ুক...একদিন
লেখক হবে যে...আহা ঘুমন্ত মায়ামুখ। ইচ্ছে করছে একটি চুমু এঁকে
দেয়। না নির্ঝরা সামলে নেয় ঘুম ভেঙে যাবে।
সিঁদেল চোরের মতো
খাটের নিচ থেকে এক হাতে মসলাপাতির ছোট ডালা ও অন্য হাতে বাজারের
ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। আবার ঘরে গিয়ে তরকারীর পাতিল ও ছোট একটা বাটিও আনে। এ ফ্লাটের
সাবলেট সে নিজের সবকিছু ঘরেই রাখতে হয়।
গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকে। ভারী বৃষ্টি হবে। মেঘ ডাকলে চঞ্চলা হয়ে যায়।
ঝড় হবে শো শো বাতাস। মট মট করে কি যেন পড়ে। ডাল ভাঙলো বুঝি! কারো বা ছাদের ্উপরের টিন। পা নিসপিস
করে দৌড় দিতে। তার এ তিন তলা ঘরের চালে টিন লাগানো। ঝমঝম বৃষ্টি শুনবে আর ভেসে যাবে
শিশু কালে, কিশোরী কালে, যৌবনের আংশিক বৃষ্টি
গেয়েছিল। ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে আঁকড়ে ধরেছিল এক বুড়ো বৃক্ষের শিকড়। সে বৃক্ষটিকে
একটি ক্যানভাসে ধরে রেখেছে সে। রঙ ও তুলিতে আটকে থাকুক জীবন গতির মূহুর্তকয়েক।এ ঘরটিতে
হাজার ক্যানভাসে জমে আছে জীবনের লক্ষ টুকরো কথা। কখনো ব্যর্থ হয়েছে। অর্ধ বা পোনে অংশ
সফলতা ব্যর্থতার রঙিন কালো পোচে মাখামাখি হ’য়ে পড়ে আছে। একরামিন
ও তেল রঙে আঁকা এসব জীবনছবি নির্ঝরার একার। এ-ঘরে ঢোকার অনুমতি
নেই কারো।কিংবা কাউকে দেখানোর তাগিদও নেই।কোথাও ঢলে পড়ে আছে বৃক্ষ, কোথাও বাকল, কোথাও ঝরছে জীবন-অশ্রু
কোথাও স্নিগ্ধতা।অশ্রু, রক্ত, সুখ-কান্না, প্রতারণার ছোবলমাখা অবিমিশ্র খন্ডায়ন নির্ঝরা
তেল রঙে ্আঁকছে। রঙের গন্ধে যেন শ্বাস।
তেলরঙ মানে বেঁচে থাকা, অতীত থেকে স্ফুরণ
নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। স্মৃতির আমেজে ঠাঁসা তার ছবিগুলো কাউকে দেখায় না সেদিন থেকে
যেদিন একজন তার মা ও শিশুর একটা ছবি কিনতে চেয়েছিল।তার মনে হয়েছিল তার প্রাণ কেউ কেটে
নিতে চাইছে... আর প্রাণ কেটে টাকা আয়ের আর সময় নেই তার।
তার রুমটি বাদে দোতলার ছাদ তিন তলার উঠোন। সে উঠোনের এক পাশে উপরে ছাদওয়ালা
বেশ কিছু জায়গা। সেখানে বসার বেঞ্চিতে বসে বৃষ্টির মাতলামী দেখে।বৃষ্টির উন্মাতালতা
তাকে রঙতুলিতে মগ্ন থাকতে দেয় না। ‘নিঝু নিঝু’
প্রিয় কোন ডাক বুকে ছেনীর মতো বিঁধে।
...বিজন বিবশ রাতে কথা বলে কে যে
বুকের পাশটি ছুঁয়ে কার আদৃত চোখের পাতা
কোন কালের গল্পের ভিড় পরান ডাঙার মোড়ে
আজ কার কথা মনে পড়ে!
বৃষ্টিতে ভেজার বয়স এটা নয় নির্ঝরা
বোঝে।‘তুমি এত কেন বোঝ মা? বেশি বুঝে বুঝে
কষ্ট বাড়াও। ’ ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আদরের ধমক দেয়। শিশুবেলার তার ছেলেটার পাকা
কথা ‘আমাকে মাছ কাটা শিখিয়ে দাও মা আমি তোমার মেয়েও হবো ছেলেও
হবো।’ না ছেলেটা শুধু ছেলেই হ’য়ে রইলো আর
মেয়েটাও ছেলে হতে চায়।এ পৃথিবীটাই ছেলে হবার প্রতিযোগীতায় মেতে আছে। ছেলে মানে ক্ষমতা,
ছেলে মানে বড়, ছেলে মানে আগেভাগে দৌড়ানোর কৌশল...
নিচে নিজস্ব ঘরে ঘুমুচ্ছে তার বড় হয়ে যাওয়া শিশুরা।সবাই নিজের পায়ে
দাঁড়াতে শিখে গেছে। কাউকে নিয়ে আর রাত জাগার ক্লান্তি নেই। গলার ঘাম মুছে দেবার কসরত
কিংবা ফ্যান কমানো বাড়ানোর জন্য উঠানামা নয়ত মশা...
এখন শুধু নিজেকে পাহারা দেয়া আর বাঁচিয়ে রাখার কসরত।সবার দরোজা ভিতর
থেকে বন্ধ।শুধু নির্ঝরা খোলা রাখে দরোজা; যদি কেউ
খবর নিতে এসে বন্ধ দরোজা দেখে ফেরত চলে যায়!