ও বিধি কি হইলো রে
ইশকুল
থেকে ফেরার পরেই ইঁদারার চাতালে ফেলে মা আমাদের প্রতিদিন ধোলাই মোছাই করে নিয়ে তবে
ঘরে ঢুকতে দেয়।ইশকুল ড্রেস, জুতামোজা চলে যায় রেনুদির হাতে। এ সময় রেনুদি দু একটা চোরা মার মেরে দেয়। বিশেষকরে আমাকে। মা দেখেও না
দেখার ভান করে শুকনো কাপড় হাতেবারান্দায়
বসে থেকে নির্দেশ দেয়, কানের নিচটা ভালো করে ডলে দে রেনু। কেমন প্যাচড়া হচ্ছে
চারপাশে। বাচ্চাদের নোংরা রাখলেই এসব হয়। দেখিস আমার বাসায় যেনো ওসব পচাধচাঅসুখ না
ঢোকে । আর হ্যা কাল কিছু নিমপাতা সেদ্ধ করে দুটোকে ভালো করে ধুয়ে দিবি।
রেনুদি
ভালো করে আমার দু কান ডলে লাল করে ফেলে। আমি জোরসে চেঁচাই , মা মা রেনুদি ইচ্ছে
করে ব্যাথা দিচ্ছে। মা আর রেনুদি হেসে উড়িয়ে দেয় আমার চেঁচানি । ওরা জানে এটুকু
ব্যাথায় আমার কিচ্ছু হয় না। প্রায়ই আমার হাত ভাঙ্গে, মাথা ফাটে, পা মচকায়। আমি তাই
নিয়েই খেলতে নেমে যাই। খেলতে না নিলে অন্যদের খেলা পন্ড করে দিই। ব্যাথা বেদনা বলে
আমার কিচ্ছু নাই। যা করছি সব ভান!
পাত্তা
না পেয়ে এবার আরো জোরে চেঁচাই , ইশকুলেই তো ছিলাম। আদাড়ে তো ছিলাম না।
মা
লম্বা নাকটা হাসিতে ঝলমলিয়ে বলে ওঠে, হুম তাই তো ! আর ইশকুল ফেরত যে প্রায়দিনকালিবাড়ির
আদাড়ে নামো সে কথা বুঝি আমরা জানি না তাই না !
সারাদিন
ঘরে থেকেও মা যে কি করে সব কথা জেনে যায় কে জানে! একদম সত্যি সত্যি কালিবাড়ির
আদাড়ে নেমেছিলাম। দুর্গার গলার সোনারং মাটির হারটা খুঁজতে। পাইনি। মাটি যে এত
তাড়াতাড়ি গলে যায় তা কে জানত!
মা
প্রায়ই বলে আমার একটা গোপন চোখ সবসময় তোমাদের পেছনে থাকে। কি করছ, কোথায় যাচ্ছ সব
জেনে যাই আমি বুঝেছ।
দুপুরে
মা ঘুমুলে আমি মার মাথার চুলের ভেতর, ঘাড়ে, পিঠে,পায়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই
গোপন চোখ খুঁজে পাইনি। মাঝে মাঝে আমরা তাই মুখোশ পরি। চুরি করে কিছু খেতে গেলে,
নিতে গেলে, ছিঁড়লে, ভাংলে ভাইয়ার সামনে আমি দাঁড়াই । আবার ভাইয়া দাঁড়ায় আমার
সামনে। এই বুদ্ধিতে কিছুটা লাভ হয়েছে। মা অনেক কিছুই জানতে পারে না এখন।
কিন্তু
আজকের দুপুরটা যেনো কি রকমের। থোপ থোপ অস্বস্তি জমে আছে আমাদের বাসার এখানে
সেখানে। মা আমাকে আর ভাইয়াকে পেট ঠেসে খাইয়ে আজ আর অংক করতে বলে না। বাংলা ইংরেজি
হাতের লেখাও করায় না। বরং অন্যমনস্কভাবে আমাদের চুল আঁচড়ে দিয়ে ভেজা ভেজা গলায়
বলে, তোমাদের বুজির শরীর খুব একটা ভালো নয় গো। এখন তখন অবস্থা। তোমরা ছোটকার বাসায় চলে যাও।তেমন কিছু ঘটলে
সাথে সাথে খবর করে দিও তোমার বাপিকে।
বুজি
থাকে আমার ছোটকার বাসায়। আমার ছোটকাকি অসম্ভব কৃপণ, স্বার্থপর আর মুখরা। প্রায় দিন
তাতারি ফুপির সাথে ঝগড়া করে পাড়া মাথায় করে রাখে। মা ছোটকাকিকে কিছু না বলে তাতারি ফুপিকে ধমকায়, তুই জানিস যখন, তখন যাস
কেনো ঝগড়া করতে?
তাতারি
ফুপি তখন হেসে ফেলে, সত্যি বড়ভাবি ফজলুটা যে কিভাবে এই বউয়ের সাথে ঘর করে। মা
তাতারি ফুপির হাতে চা দিতে দিতে বলে, না করে উপায় আছে ! তোমার বন্ধুর যে দু পয়সার
আয়! অন্তত সংসারটা ত বেঁধে রেখেছে বউটা।
ফজলু
আমার ছোটকা। স্থানীয় সরকারি কলেজের একাউন্টেড। স্কলারশিপ পেয়ে কেউ খুশি হয়ে মিষ্টি
খেতে দিলে ষ্টীলের টিফিন বক্সে ছোটকাকির জন্যে তুলে রাখে। কখনো দুটো সিঙ্গারার
একখানা। দুজনের ভাব ভালোবাসার কোনো অভাব
নেই। মা জানে বলেই তাতারি ফুপিকে উলটে বকে দেয়। তাতারি ফুপি দুঃখী মানুষ। একটি
চলন্ত লাইব্রেরির সাথে ফজলুর চাইতে বেশি বেতন পেলেও আর যাই হোক ঘর করা খুব সহজ কথা
নয়। ময়েন স্যার বই ছাড়া কিছুই বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। তাতারি ফুপি তাই শিমূল
তুলার মত ভেসে ভেসে বেড়ায় ।
আমরা
জানতাম এই দুপুরে ছোটকার বাসার গেট বন্ধ থাকবে। আর ধাক্কিয়ে গেট খুলে বাসায় ঢোকার সাহস ছোটকারও
নাই। এ সময় ছোটকাকি্মা ঘুমোয়। আমি আর ভাইয়া তাই বাসার পেছনে তারকাঁটার বেড়ার কাছে
চলে যাই। ভাইয়া তারকাঁটা উচু করে ধরে, আমি
বাগানে ঢুকে পড়ি । এভাবে এবারভাইয়াও ঢুকে পড়ে। বাগানের এখানে তিনটে বরই গাছ তিনদিক
দিয়ে বেড়ে উঠেছে। বরই হয় ঝেঁপে। ইয়া বড় বড়। মিষ্টি টক। পাড়া প্রতিবেশি যাদের সাথে
ছোটকাকির ভাবভালোবাসা তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা গুণে গুণে ছোটকাকি বরই পাঠিয়ে
দেয়। যাদের সাত জন , তাদের সাতটা বরুই। জীবনেও আটটা কিম্বা ছটা দেবে না। ভুলেও না।
কে কি বল্ল তাতে ছোটকাকি মোটেও কান দেয় না। পরিষ্কার বলে দেয়, এই যে মুস্তারির মা,
কাজ কাম কিছু নাই নাকি যে অন্যের পেছনে ঘুচঘুচানি করছ! আমি না খেয়ে থাকলে তুমি কি আমারে খাওয়াবেনে নাকি
হ্যা ! ভালো হয়ে যাও আরনিজের সংসারে তেল দাও গে যাও।
ভাইয়া
আর আমি বরই গাছের নিচে ঝরা বরই খুঁজি । মনে বড় আশা একটাও কি পাবো না! ভাইয়া খুঁজতে খুঁজতে বুজির ঘরের দিকে চলে যায়। কয়েকটা পুরনো টিন দিয়ে বুজির জন্যে ঘর
বানিয়ে দিয়েছে ছোটকা। একটা কাঠের পাটাতন। মোটা তার দিয়ে কয়েকটা তাক বানিয়ে দিয়েছে
কাপড় চোপড় এটাসেটা রাখার জন্যে। আমরা জানি বুজির কাছে তেমন কিছুই থাকে না।কোনো
কৌটায় হয়ত সামান্য গুড়, একটু চিনি। কয়েকটা
বিস্কুট, দানাদার। মুড়ি চিড়ে। কিছু খই মুড়কি আর তার ভেতরে দুএকটা তক্তি, বাতাসা।
বুজির
কাছে গেলে বুজি এগুলো থেকে আমাদের খেতে দেয়। আর শীর্ণ, রগ ওঠা, হাড্ডি সর্বস্ব হাত
দিয়ে আমাদের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ও দাদু পড়ালেখা শেষ হলে চাকরি
করেআমারে একখান মোটা চাদর, উলের মোজা
,বাটার জুতো আর এক গামলা ভাত খাওয়ায়বেনে তো দাদুসোনারা। তোমার মার হাতের সরপুঁটি মাছ
ভাঁজা আহা একেবারে অমৃত যেনো! সেই কবে খেয়েছি। ছোটবউমা সেবার ভেঙ্গেচুঙ্গে এই ইট্টুসখানি
দিয়েছিল থালার পাশে।
বুজির
শীর্ণ হাতে ভাঙ্গাচুরা সরপুঁটি মাছের কল্পিত আকৃতি আমার দুচোখে গেঁথে যায়।
আর
তার সাথে বুজির কথা শুনে কান্নায় আমার বুক দুলতে থাকে। আমরা ছোটরাও জানি,বুজিকে
কিছু ভালো জিনিস খেতে দেওয়া যায় না। ছোটকাকি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়।ছোটকাকির যুক্তি,
এসব খেয়ে অই বুড়ি পেট খারাপ করলে কেদেখবেনে শুনি! কে আসবেনে তখন বুড়ির কাঁথা কিচেড়
ধুয়ে দিতে !চিনি চিনি। সবাইকেই চেনা আছে আমার! নিদানকালে কে কার আপন তা ভালো করেই
জানি আমি।
আমরা
বাসায় গিয়ে মা বাপিকে ধরি, বুজিকে নিয়ে এসো। নিয়ে এসো। আমাদের বাসায় থাকবে। বুজি তো আমাদেরও বুজি। ও
বাপি বুজির খুব কষ্ট হচ্ছে গো।
মা
বাপি বুজিকে আনতে পারে না। বুজিই আসেনা। ফজলু তার পেটের ছেলে নয় কিন্তু দিন শেষে
যখন মা মা করে ঘরে ফেরে ছোটকা, একসাথে বসে চা খায় বুজি তখন সব দুঃখ ভুলে যায়। এই
আনন্দটুকু ছোটকাকি কিছুতেই ছোটকার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। যেদিন ছোটকাকি
বাড়াবড়ি করে ছোটকা সেদিন চলে যায় পাওয়ার হাউসে। সেখানে আমাদের বংশ পরম্পরা বাড়ি
ছিল। সেই বাড়ির পুকুরঘাটেভাঙ্গা সিঁড়িতে জমিয়ে বসে ছোটকা ইঞ্জিনীয়ার, টেকনিসিয়ান,
মিস্ত্রীদের সাথে কয়েক কাপ চা উড়িয়ে দেয় ততক্ষণে। ছোটকা আবার পেটুক রসিক। খাবার পেলেই
রসিকতার তুফান ছুটিয়ে দেয়।
এদিকে
ছোটকাকি হার মেনে বুজিকে ধরে বসে, আম্মা আপনি যান। আপনার ছেলেকে নিয়ে আসেন। বুজি
গেট খুলে মেইন রাস্তা অব্দি লাঠি
ঠুকঠুকিয়ে সামান্য এগোলেই কেউ একজন ছোটকাকে খবর পাঠিয়ে দেয়। আর ছোটকা সব গল্প,
চালিয়াতি, রসিকতা ফেলে শিশুর মত হাসতে হাসতে ছুটে আসে।
অনেক
সময়ই লুকিয়ে চুরিয়ে বুজির জন্যে এটাসেটা কিনে এনে ছোটকা মিথ্যে করে বলে, তাতারি
পাঠালো বুঝলে। যাই আম্মাকে দিয়ে আসি। নইলে জিগ্যেস করলে মান সন্মান চলে যাবেনে। তাতারিকে
ত তুমি ভাল করেই চেনো!
সেরের
উপরেও সের থাকে। ছোটকাকি আপাত গবেট, কমবুদ্ধির সরল গাম্বাট ছোটকার চালাকি ধরতে
পারে না তাতারিফুপির ভয়ে। ওদিকে ছোটকাও ছোটবেলার বন্ধু তাতারি ফুপিকে আগে থেকেই
শিখিয়ে পড়িয়ে রাখে। তাতারি ফুপি যখন যেদিন
ছোটকাকিকে ধরে তখন একেবারে খাল চামড়া ছিলেদেয়। ছোটকাকির দুই ভাই ফিজুমিজু, যাদের
শহরের অনেকেই ইয়াজুজ মাজুজ বলে ডাকে তারাও তখন লেজ গুটিয়ে এদিক সেদিক পালিয়ে যায়।
আমি
আমরুল গাছের ঝোপে একটি লাল বরই পেয়েই প্যান্টে মুছে মুখে চালান করে দিই। এয়া
ভ্যাক। থু! থু! পচা বরুই। কবে ঝরে পড়েছিল কে জানে। ছোটকাকির শকুন চোখে ধরা পড়েনিবরুইটা।
থু থু করে পচা বরুইয়ের বিজলে ফেলছি, এসময় ভাইয়া ডাক দেয়, ছো ছো ছো ছোটন!
আমি
বিশ্রি মুখ জিভ দিয়ে এপাশ ওপাশ গুলগুল করতে করতে এগিয়ে যাই, কি হয়েছে রে।
কে
যেনো এসেছে। বুজির ঘরে গেল। অই দেখ বুজির দরোজা খোলা।
তাই
তো। বুজির দরোজা কেমন দুলে দুলে খুলে গেছে। সিওর রুমাফুপি এসেছে। রাজাকার পরিবারে
বিয়ে হয়েছে বলে আমাদের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। কিন্তু ফুপি আসে। আবোল তাবোল
একগাদা কথা বলে বাড়ি গরম করে তোলে । বাপির পানি খাওয়ার দামি ধাতব ঘটিটা ছোঁ মেরে
নিয়ে ইঁদারার কাছে বসে ঝকঝকে করে মেজে ধুয়ে কাঁসার ট্রের উপর ঠং করে রেখে মাকে দু
চারটে কথা শুনিয়ে দুমদাম করে চলে যায়। মা হাসে। আমরা বুঝি এই ভাবেই পরিবারে
বিচ্ছিন্নতা আসে। ফুপি আর তার ছেলেমেয়েরা কখনো আমাদের ভাইবোন হতে পারবে না। ওরা
বলে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। জয় বাংলা নাকি জয় হিন্দের নকল ! ক্ষমতা আর ধনীর ঘরে ফুপি
সারাক্ষণ পাটিসাপটা পিঠের মত ল্যাদিয়ে পেঁচিয়ে থাকে।
আমি
ভাইয়ার হাত ধরে চমকে উঠি। কি ঠান্ডা। রোমকূপগুলো ফুলে ফুলে উঠেছে উচ্ছে করলার
গায়ের মত। ওরবুকে থু থু দিতে দিতে বলি, ভয় পাসনে ভাইয়া। ভেতরে হয়ত রুমাফুপি আছে।
কলেমা জানিস তো। পড়, লা ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদের রাসুল্লালহু। লা ইলাহা –
কলেমা
পড়তে পড়তে দরোজার কাছে গিয়ে এবার আমারো ভয় লেগে যায়। ঘরে কেউ নেই। বুজির শুকনো বিবর্ণ
জিভ চিবুকের উপর বেরিয়ে এসে লকলকিয়ে কাঁপছে। রহিম বেদের শঙ্খচূড় সাপের মত দুলে দুলে উঠল
জিভটা। কয়েক লহমা মাত্র। এ সময় সরসর শব্দ করে মনে হলো কে যেনো চলে গেলো। এদিক ওদিক
তাকাই। ভাইয়া বলে, শুনেছিস? সরসর ? কেউ চলে যাচ্ছে !
আর
তখুনি একটা মৃদু বাতাস এসে বুজির ঘরের দরোজা আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেয়। আমরা ভয়ে
তারকাঁটার বেড়া সরিয়ে কি করে যেনো ছুটে বেরিয়ে আসি। ছোটকার বাসা আর আমাদের বাসার মাঝখানে বাপির
ফার্মেসি। ছুটে এসে বাপিকে বলি, বাপি বাপি বুজির জিভ বেরিয়ে পড়েছে এই এত্তবড় হয়ে। সাপের মত কাঁপছে । শিগগীর চলো। চলো চলো। এখুনি
চলো।
বাপি
বোধহয় কোনো কবিতা লিখছিলো। হতবিহবল হয়ে বসে থাকে। শচিনকাকা বাপিকে তুলে দেয়, যান
ভাইজান। মনে হয় সব শেষ হয়ে গেছে এতক্ষণে।
কাকুই
আমাদের পাঠিয়ে দেয় অন্য চাচা ফুপিদের বাসায়, যা খবরটা দিয়ে আয়। সবাইকে এখুনি অই বাসায় আসতে বলে আয়।
আমরা
উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ছুটে কলেজপাড়া, গোহাটাঘুরে ঘুরে সবাইকে জানিয়ে আসি। সেজোকাকা
ছেলের প্যান্টের বোতাম লাগাচ্ছিল। বোতামের ঘরে সুঁই ঢুকিয়ে হঠাত হো হো করে কেঁদে
ফেলে। অবাক হয় সবাই। এই সেজো জীবনে কোনোদিনবুজির খোঁজ নেয়নি। বছরের পর বছর রাগ
অভিমান পুষে রেখেছে মনে। কেনো বুজি তার ভাগের
সব জমি ছোটকাকাকে দিয়ে দিলো তাই! ফজলু যেমন সৎ ছেলে, সেজোও ত তেমনি সৎ ছেলে!
হাত
পা মুখ নেড়ে সেজো আমার মাকে বলত, বুঝলে বড়ভাবি সৎ মা সবসময় সৎ মাই হয়। আমার কত
অভাব। কতগুলো ছেলেমেয়ে।
মা
উলটো দিকে কথা ঘুরিয়ে কথা বলত, তুই ত অশিক্ষিত মুর্খ। এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা কে নিতে
বলেছিল তোকে! এক মুখ সোনা দিয়ে ভরা যায়। দশ মুখ ছাই দিয়েও ভরা যায় না শুনিস নি
বুঝি। মানুষ দেখেও তো শেখে! আর তুই!
সেজোকাকি
কখনো বেড়াতে এলে মা বেশি করে বকা দিত, উদোমসুদোম কিছু নাই নাকি তোমার। স্বামির অই
ত আয়। বছর বছর বাচ্চা বিয়েচ্ছো। কেবল শুতে জানলে হয় না বুঝলে!
দশ
বাচ্চা নেওয়ার পর মা সেজোকাকিকে অপারেশন করিয়ে আনে। পরিবার পরিকল্পনা অফিসের
বিনীতা মাসি্র হাসতে হাসতে সেদিন চোখে পানি এসে গেছিলো, ও বড়ভাবি তবু তো কটা জন্ম
ঠেকানো গেলো কি বল তুমি!
মা
ভ্যানিটি ব্যাগ তুলে নিতে নিতে বলেছিল, তোদেরও বলিহারি বিনু। মানুষকে মোটিভেট করা
তো জানতে হবে। এরা তো বিশ্বাস করে, মুখ দিয়েছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি। এদিকে
ছেলেপেলেরা তো ইশকুল টিশকুল ছেড়ে ফাউ উপার্জন শিখতে নেমে গেছে। এর গাছের লাউ, ওর
গাছের কুমড়ো চুরি করছে। তোরা প্রপার ওয়েতে কাজ করছিস নে কিন্তু বিনীতা !
ছোটকার
উঠোন ভরে গেছে মানুষ আর মানুষে। ছোটমানুষের মত কাঁদছে ছোটকা। এই মর্মান্তিক দুঃসময়ে
উঠোনভর্তি মানুষের সামনে রুমাফুপি ছোটকাকে খোঁচা দিয়ে কথা শোনায়। তাতারি ফুপি ধমক দেয়, তুমি কি করেছ রুমা ? একদিনও ভাল কিছু
রান্না করে চাচিমাকে খাইয়েছ ? একাত্তরেও তোমরা লুটে খেয়েছো, এখনো লুটে খাচ্ছ।
গরীবকে সুযোগ পেলে সবাই কথা শোনায়। সরো সরো। সরে যাও এখান থেকে ।
তাতারি
ফুপি আর ছোটকাকি বরই পাতা সেদ্ধ করে সেই
পানিতে বুজিকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড়ের কাফনে মুড়ে দিয়েছে। মসজিদ থেকে কফিনবাহি
দোলা এসেছে। বাপি, সেজো, ছোটকা দোলার তিন পা কাঁধে নিয়ে দাঁড়াতেই তাতারিফুপির বর
ময়েন স্যার এসে দোলার চতুর্থ পা কাঁধে
তুলে নেয়। ময়েন স্যারের সাদা লুঙ্গী সাদা
পাঞ্জাবী। বাপির চিরকালের খদ্দর । ছোটকার বাসার কাঠের গেট পেরিয়ে কফিন
রাস্তায়নামতেই ছোটকা কলেমা না বলে, আল্লাহু আকবর না বলে, ইন্নাললিল্লাহ দোয়া না পড়ে হাউ হাউ করে জোরে কেঁদে ওঠে, আম্মা আম্মাগো!
আমারে মাফ করে দিও গো আম্মা।
সেই
সাথে আমরাও হাপুস হয়ে কাঁদতে থাকি। এখন
বুঝতে পারছি, বুজিকে আর কোনোদিন আমরা দেখতে পাবো না। মার হাতে পাখার ডাঁটির মার
খেয়ে আর কোনদিন বুজির কাছে নালিশ করা যাবে না।
বুজিরে ও বুজি! আপনি জেতা হয়ে আবার
ফিরে আসেন গো বুজি।
সেজো
ছোটকাকে সান্ত্বনা দেয়, কাঁদিসনে বাচ্চু। তওবা পড় ভাডি। শেখের মেয়ের গুণাগাতি মাফ
করে আল্লাহ যেনো তারে জান্নাতবাসি করে নেয়।
বড় কষ্ট দিয়েছি আমরা তাকে।
বুজিকে
একমাত্র ছোটকাই আম্মা বলত। আমার দাদার তৃতীয় স্ত্রী এই বুজি। প্রথম স্ত্রীর ঘরে
বহু বছর সন্তান না হওয়ায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার দাদিমা দাদাকে বিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী ভাল ঘর, নামকরা পরিবার। নীলার মাঠের কাছে সেই দাদির বাড়ি। পরির মত
দেখতে। বয়স্ক আর দোজবর জেনেও কেন যে তারা বিয়ে দিয়েছিল কে জানে! হয়ত বাবা মা ছিল
না এজন্যে। খুব কুঁদুলে ছিল পরিদাদি। দাদাকে কিছুতেই প্রথম স্ত্রীর কাছে যেতে দিতে
রাজী ছিল না। দাদাও প্রথম স্ত্রীতে এমন দিওয়ানা ছিল যে পরিদাদির মনে হয়েছিল বিয়ের
নামে তাকেঠকানো হয়েছে।
আর
কি আশ্চর্য এতদিনে যা হয়নি তাই হতে শুরু করল। প্রথম দাদির পর পর চারটে ছেলে হয়ে
গেলো। বাপি, মেজকা, সেজকা, ছোটকা। সব ছোট ছেলে ফজলু জন্মের পর প্রথম দাদি আর
বিছানা ছেড়ে ওঠে বসতে পারলা না। কয়েক বছর ভুগে দাদি যখন মারা যায় তখন ছোটকার বয়েস
চার কি পাঁচ হবে। এরপরেও পরিদাদি কিছুদিন
সংসার করেছিল। কিন্তু দাদা নাকি তেমন ফিরেও তাকাতো না। একদিন বাপের বাড়ি যাওয়ার
কথা বলে সেই দাদি চলে গেলো। আমার বাপি, মেজকা, সেজকা অনেকবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে।
কিন্তু উনি আসেননি। বরং এক বছরের মাথায় পরির মত সুন্দরী দেখতে রুমাফুপিকে বাপির
কোলে দিয়ে বলেছিল, আর আসবি না তোরা। তোদের বোন তোদের দিয়ে দিলাম। আর শোনআমি এদেশ
ছাড়ি চলি যাতিছি।
সত্যিই
চলে গেছিল পরিদাদি। ইরাক, ইরান, নাকি পাকিস্তান কে জানে। রুমাফুপি বহু খুঁজেছে
পরিদাদি ধরা দেয়নি।
মায়ের
পায়ের কাছে বসে রুমাফুপি অনেক কেঁদেছে , এমন মানুষও হয় বড়ভাবি!
মা
গল্পের বই পড়তে পড়তে সহজ করে বলেছে, হবে না কেনো ? অনিচ্ছুক বিয়ে অনিচ্ছুক সন্তান।
মেয়ে হলেই যে কেবল মা হতে হবে এমন কেনো নিয়ম আছে নাকি রে রুমা ? কোনো কোনো মানুষ
তার মন দিয়েও জীবন চালায়।
রুমাফুপি
গাড়ল, লোভি। ভিতুর ডিম। শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ম করে দিয়েছে , ফুপির একটি ছেলেমেয়েও যেনো
আমাদের বাসায়নাআসে। যদি ওরা বাঙ্গালিয়ানা শিখে যায়। রুমাফুপির শ্বশুর তো ভেচরে
ভেচরে বলেই দিয়েছে, তোমার বড়ভাইকে জবাই করা দরকার। নাস্তিক একটা। পয়লা বৈশাখ পালন
করে হিন্দুদের মত। বেশ্যাদের মত মেয়েদের নাচগান শেখায়। আবার নামাজ পড়ে। দু নম্বুরে
জালি মুসলামান।
বাপিরা
আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে এই ভেবে বোনকে নিয়ে ফিরে এসেছিল বাসায়। বাপিদের বংশে মেয়ে
জন্মায় না। রুমাফুপি সেই দুর্লভ রাজকন্যা। ভাইরা ইশকুলে যায় না, পড়াশুনা করেনা,
ঠিকমত খায় না, ঘুমোয় না সারাক্ষণ বোনকে ঘিরে থাকে। এ অবস্থায় কেউ দাদাকে আবার বিয়ে
করার পরামর্শ দেয়। সংসার তো দেখতে হবে!
সেই
সুবাদে বুজি আমাদের তৃতীয় দাদি। একেবারেই গরীবের মেয়ে। তিনবেলা ভাতের জন্যে
এই বিয়ে। প্রথম প্রথম নাকি তিনজনের ভাত একাই খেতো বুজি। দাদা
ভুলেও কোনদিন তাকিয়ে দেখেনি বুজিকে। ছেলেদের নিয়ে কলকাতা থাকত। আর আগ্রা, তাজমহল,
কুতুব মিনার, বেনারস, পুরি ঘুরে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু বুজির কোন অভিযোগ ছিল না এ নিয়ে । বুজির
কোলের ভেতর রুমাফুপি, হাতের উপর ছোটকা ঘুমিয়ে থাকত। বাপি, মেজকা, সেজকা বুজিকে
কখনো কোনদিন মা বা আম্মা বলে কিছুই ডাকত
না। একান্তই কিছু বলতে হলে বলত, এই যে
শেখের মেয়ে। বুজি তাতেই গলে যেতো।
আজ
যখন জানাজায় বুজির স্বামির পরিচয় দিয়ে নামাজ শুরু হলো, বাপির চোখ চিকচিক করে উঠল
বেদনায়। আহা রে জীবন। এক থালা ভাত , দুটি মোটা জামাকাপড়ের জন্যে এদেশের কত মেয়েকে
এভাবে জীবন বলি দিতে হয়েছে। জানাজার নামাজের ফাঁকে বাপি চকিতে প্রতিজ্ঞা করে তার
মেয়েদের তিনি কখনো কেবলমাত্র ভাত কাপড়ের জন্যে বিয়ে দেবে না। মেয়েরা হবে
স্বাবলম্বী। বিবি খাদিজা রাঃ এর মত স্বয়ম্বরা, স্বমত পোষণকারী । বিবি আয়শা রাঃ এর
মত তেজি। যুক্তিশীল। তিনি মেয়েদের পড়াবেন। তার মেয়েরা চাকরী করবে।
আসরের
নামাজে জানাজা শেষ করে বুজিকে নিয়ে ওরা গোরস্থানের দিকে চলতে শুরু করে। সারাপথ
দোয়া দরুদ, তওবা পড়ে সবাই। আমরা কবরযাত্রীদের
পেছন পেছন ছুটে গোরস্থানের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি । ভাইয়া হাত ধরে টানে, চল।
ভেতরে যাই।
আমি
যাইনে। কি যে ভয় লাগে আমার । একটা গা গুলানো পচা গন্ধ ভেসে আসে গোরস্থানের ভেতর
থেকে। গেট বেয়ে উপরে ওঠে দেখি কিছু কবর দেখা যাচ্ছে। হাস্নুহেনা গাছে ফুল ফুটেছে।
কয়েকটা গন্ধরাজ গাছ। বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে
পড়েছে। ভাঙ্গাবেড়া জুড়ে মাধুরীলতা ফুল ফুটেছে। দু একটা কবর কেমন গর্ত গর্ত । রাতে
নাকি শেয়াল কুকুর এসে লাশ টানাটানি করে। আবার আত্মারা ঘুরে বেড়ায় গোরস্থানের
আশেপাশে। গা ছমছমিয়ে ভয় লাগে আমার।
গোর
খোদক ইমান আলিচাচা চকচকে কোদাল নিয়ে ঢুকে গেলো গোরস্থানে। আমি ভাইয়াকে বলি, চল
ভাইয়া। আমার ভয় লাগছে। সন্ধ্যাও হয়ে
এসেছে। এখুনি মাগরিবের আজান পড়বে।
ভাইয়া
জানে সন্ধ্যা হলে আমি খুব ভয় পাই। ও আমার হাত ধরে, দূর বোকা ভয় কিসের বলে বাসায়
নিয়ে আসে।
মা
রেনুদিকে বলে , দুটোকেই গোসল করিয়ে ঘরে আন রেনু। একটু আগুণ আর লোহা ছুঁইয়ে দিস।
ভাইয়া
রেনুদিকে বলে, এক কাপ নুনপানি দাও রেনুদি। ছোটন ভয় পেয়েছে।
রেনুদি
হেসে ফেলে, তোমার বোন যেমন শাসেডানি পদ্মরানি তার আবার ভয়। ও বড়কাকিমা চা বানাবো ?
মা
এক কাপ নুনপানি এনে খাইয়ে দেয় আমাকে। তারপর ভাইয়ার মাথার ভেজা চুল নরম তোয়ালে দিয়ে
মুছে দিতে দিতে বলে, তুই চা খেয়ে নে রেনু। তোরকাকা ফিরলে তখন আমাদের চা দিস।
মা
আমার মাথা মুছিয়ে দেয় না। জানে ত সবাই আমার আসলে কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। পানিতে
ফেললে ভেসে উঠি, আগুনে পোড়ালে বেরিয়ে আসি। হাত পা ভেঙ্গে গেলে, কেটে গেলে, ছড়ে
গেলেও আমার খেলা বন্ধ হয় না। কেবল ভয় পেলে আমার বেজায় ঘুম পায়। ঘুমুলে আর ভয় কিসের
! বিশাল বড় খাটে লাল কাঁথা গায়ে আমি শুয়ে পড়ি আর মনে মনে কলেমা পড়ি, লা ইলাহা
ইল্লাল লাহু মোহাম্মাদুর রাসুল্লাহ। লা ইলাহা---
ভাইয়া
আমার মাথার চুল মুছে দিতে দিতে সাহস দেয়, কি বোকারে তুই! আমি ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে
ভাবি, ছোটকার বাসায় বুজির ঘরে সরসর করে কি আজরাইল ফেরেশতা নেমে এসেছিল ? কাঠের দরোজা কেমন আপনাআপনি খুলে গেছিল। ভাইয়া
টের পেলো, আমি কেনো বুঝলাম না ! ভাইয়া অসুস্থ বলে কি আজরাইল দেখা দিলো ভাইয়াকে?
ঘুমের
ভেতর আমি স্বপ্ন দেখি, ভাইয়ার জিভ রহিম বেদের শঙ্খচূড় সাপের মত লকলক করে উঠছে। আর
মা আমাদের শান বাঁধানো উঠোনে আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদছে , ও বিধি আমার কি হইলো রে !
ভয়ে
জেগে ঊঠি। না ভাইয়া আমার পাশে কুকড়ে মুকড়ে ঘুমিয়ে আছে। নাকের কাছে হাত দিই। নিঃশ্বাস
নিচ্ছে। বুকের উপর হাত রাখি নাহ, বুক তো নিঃশ্বাসে ওঠানামা করছে। মাকে ডাকব, দেখি বাপি কোরান শরীফ রেহেলে রেখে ভেজা গলায়
মাকে বলছে, একেবারে এতিম ছিল। আর কি ভয়ঙ্কর গরীব ছিল যে ! কয়টা ভাতের জন্যে আমাদের
পালতে এসেছিল শেখের মেয়ে। কোনোদিন কিছু চায়নি। রাবি আজকে আবার আমি সেই প্রতিজ্ঞাটা
করলাম। মনে আছে কলকাতায় হেয়ার সাহেবের কবর ছুঁয়ে আমাদের প্রতিজ্ঞার কথা ? ছেলে হোক
বা মেয়ে হোক আমরা সমান গুরুত্ব দিয়ে তাদের পড়াশুনা করাবো। যদি শুকনো মরিচ ডলে ভাত
খেতে হয় তাও এই প্রতিজ্ঞা পালন করে চলবো !
আমি
মার মুখটা দেখতে পাইনা। কেমন আলো আঁধারিতে বসে আছে মা। ভাইয়ার পিঠে হেলান দিয়ে আমি
মাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে দেখি মার মুখটা রাহুল সাংকৃত্যায়ণের ‘ভলগা সে গঙ্গা” বইয়ের মলাটের মত লাগছে।
এই
আমার মা। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় এক হাঁটু হিন্দু মুসলিমের রক্ত উজিয়ে পালিয়ে গেছিল
হাওড়ার বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরের কোনো মুসলিম সংখ্যাধিক্য গ্রামে। সেখানে হিন্দুদের
উপর অত্যাচারের কথা উঠলে মা খাঁড়া বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, দাঙ্গাকারিদের আবার ধর্ম কি!
তোমদের কুপিয়ে হিন্দুদের আমি বাঁচাবো।
আটচল্লিশে
হাওড়ার বাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান চলে আসার সময় একই গ্রামের সই মিনতি মাসিকে
বলেছিল, দিয়াটা জ্বালিয়ে রাখিস মিনু। দেখিস একদিন আমরা সবাই আবার মানুষ হয়ে ফিরে
আসবো। তখন ভাবতে লজ্জা করবে, আমরা তোদের মেরেছি। তোরা আমাদের মেরেছিস।
আমি
ভাইয়ার পিঠ ঘেঁষে কুকড় মুকড়ে শুতে শুতে ভাবি, রাহুল সাংকৃত্যায়ন কি আমার মাকে
দেখেছিল?
আমি
সিওর! দেখেছিল