তুলো ও লাজবন্তী
নতুন বাড়ি । মণিমালা দেখছিল
চারদিকে খোলা মাঠ , তবে রাতের
বেলা , আবছা আঁধার রয়েছে , তাই সবকিছু ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছিল না ।
অভিমন্যু বলল -এই আমাদের
বাড়ি । জানি না , তোমার
পছন্দ হবে কি না ।
তারা বসে আছে একটা বলেরো গাড়িতে , বেশ দ্রুত চলছে গাড়ি , আশপাশে উঁচুনিচু খোলা জায়গা ,
হঠাৎ এক একটা বাড়ি , কেমন যেন
গা ছমছমে চারদিক ।
আজই বিয়ে
করেছে তারা । মণিমালা ও অভিমন্যু । কথাটা বলতে অদ্ভুত শোনালেও বিয়ের আগে এই বাড়ীটা
এসে দেখেনি মণিমালা । বলেরো এসে থামল বাড়ির পাশে । বেশ সুন্দর বাড়ি । নতুন রঙ করা
হয়েছে । ইলেকট্রিক আলো তেমন ধারালো নয় । বাড়িটা এই আলোতেই দিব্যি ঝকমক করছে । সোমনাথ
, ঝিমলি , সুরজ , চৈতালি ওরা আগে থেকেই এসে ঘরদোর সাজিয়ে ফেলেছে । অভিমন্যুর
বাবা মা নেই , মণিমালার
সাথে একই অফিসে চাকুরিতে আছে । আর মণিমালার বাবা মা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না । তাদের পছন্দের পাত্রের
সাথে বিয়েতে মণি রাজি হয়নি । সে নিজের মত করে বিয়েটা করেই ফেলেছে । তবে আগামিকাল
তারা এসে আশীর্বাদ করে যাবেন , বলেছেন শেষ পর্যন্ত । অভিমন্যু ও মণির সহকর্মীরাই সব
সময় পাশে থেকে বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক সাঙ্গ করেছে ।
বাড়িটা
কেমন যেন । এমন একটা জায়গায় কেন অভিমন্যু বাড়ি করল ভেবে পায় না মণিমালা । এখান
থেকে অফিস খানিকটা কাছে । শুধু এইটুকুই যা সুবিধে । কথাটা আজ বলবে মণি অভিমন্যুকে
। তাদের বিয়ের সোজাসাপ্টা আয়োজন চুকে গেছে । মণির মা বাবা এসেছিলেন ।
দুজনেই নাক সিঁটকে বললেন - শেষকালে তোর কপালে এই ছিল ! এখানে ভাল থাকবি ? এখানে ভাল থাকতে হলে হাতে জাদুকাঠি থাকা চাই । কি বলিস ?
কিছু
বলেনি মণি । কথাটা ফেলে দেবার নয় । চারদিক ধু ধু করছে । উঁচুনিচু ঢালাও খোলা জমি
। খানিকটা কৌণিক দূরত্বে টিনের চালার একটি
ছোটো বাড়ি । কিছু ছোটো ছেলেমেয়ে খেলাধুলো করে বিকেলের দিকটায় । সেই সময়টাতে
জায়গাটাকে কিছু প্রানবন্ত মনে হয় ।
অভিমন্যুকে
কিছু বলতে হয়নি , নিজের
থেকেই বলল - তোমার বাড়িটা পছন্দ হয়নি , তাই না ? আমি ভেবেছিলাম নিরিবিলিতে দুজনে থাকবো কপোতকপোতী যথা...... তারপর কি ছিল মণি , বাকিটা তুমি বলো ।
মণির খুব অদ্ভুত লাগে । কিছু বলে
না ।
সেদিন
বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর ডোরবেল বাজলো । দরজা খুলতেই পনেরোষোলো বছরের একটি মেয়ে , কোলে একটি ছোট্ট বেড়ালছানা । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি বলে , আমার নাম লাজবন্তী । ঔ বাড়িত্ থাকি । বিলাই রাখবায় নি ?
মণি থমকে যায় । মেয়েটির মায়াভরা
দুটি চোখ ,
কোলে সাদাকালো ছোট্ট বেড়ালছানা । মণি কি বলবে ঠিক ভেবে পায় না ।
লোকটি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ।
বর্ষা রেগে বলল - আপনার
জন্যে এমন হয়েছে । যদি বলি , আপনি
মেয়েটাকে খুন করেছেন , তাহলে ভুল বলব কি ?
লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ।
যেন অভিযোগ মাথা পেতে নেবার জন্যে সে হাজির । যেন যে কোনও শাস্তি মাথা পেতে নিতে
তার কোনও দ্বিধা নেই ।
-আশ্চর্য! আপনার
চোখে ত একফোঁটা জলও নেই । আপনার মত অমানুষের মেয়ে হয়ে জন্মেছিল মেয়েটি । হায় রে , আফসোষ !
বর্ষা যেন হাহাকার করে ।
-আবার সাধ করে নাম রাখা হয়েছিল ‘লাজবন্তী’ ! বর্ষার কণ্ঠে এবার বিদ্রূপ ।
লাজবন্তী ! –অস্ফুটে
বলে ওঠে মনিমালা ।
লোকটি এবার মুখ তোলে । মণি চমকে
দেখে ,
লাজবন্তীর বাবা । সেই পুরনো
বাড়ির প্রতিবেশী ।
-আপনারে
খুব ভালা পাইত মেয়েটা । বিয়া দিলাম । শ্বশুরবাড়িত্ শান্তি নাই । মেয়েটারে পুড়াইয়া মারছে ।
-আর তুমিও
তাই চেয়েছিলে । -বর্ষার রাগ ষেন উপছে পড়ছে ।
-না
দিদিমণি ।
-তাহলে
মেয়েটা যখন থাকতে এসেছিল তখন থাকতে দিলে না কেন ?
-একটা মানুষের পেট ,ক্যামনে চালাই......।
-ছিঃ ছিছি ! তাই বলে মেয়েটাকে ষমের মুখে ঠেলে দিলে ?
মেয়েদের পুরনো গল্প । লাজবন্তীর কাছে টাকা চাইত শ্বশুরবাড়ির লোকেরা
। দিতে পারেনি । অতঃপর পুড়িয়ে খুন । বর্ষার পীড়িত মেয়েদের সুবিচারের এন ,জি,ও ‘ আলোকশিখা ‘ তে এসেছে লোকটি সুবিচারের আশায় ।আজকাল মণিমালাও অবসরমত মাঝে মাঝে এখানে আসে ।
এবারে আইনি ব্যবস্হা নেবার ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেবে বর্ষা । কিন্তু এত টাকা লোকটা
পাবে কোথায়! দুমুঠো খাওয়ানোর ব্যবস্হা
করতে না পেরে যে নিজের মেয়েটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল সে লড়বে আইনি লড়াই ?
অভিমন্যু শহরতলির ঐ বাড়িটা ভাড়া
দিয়ে সহরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে । এত নির্জনতা দুজনেরই ভালো লাগেনি ।গা ছমছম
করতো । তবে যে ক’টা দিন
ছিল লাজবন্তীর বেড়ালছানাটিকে
সে পুষেছিল । অফিস থেকে ফেরার পর রোজ এসে বেড়ালছানার খোঁজ নিত লাজবন্তী
। অনেকসময় খাবার নিয়ে আসতো । বাড়ি ছেড়ে
আসার সময় বেড়াল ছানাটি বেড়াল হয়েছে । বেশ হৃষ্টপুষ্ট । নাম রাখা হয়েছিল তুলো ।
তুলোকে লাজবন্তীর কাছে রেখে এসেছিল মণি । অভিমন্যু আজ অফিসের কাজে বাইরে গেছে ।
মণিমালা আজ একা । খুব খালি খালি লাগছে সবকিছু । তুলো কি বেঁচে আছে ? লাজবন্তী ও তুলোর কোনও ছবিও নিজের কাছে রাখেনি
মণিমালা ।