গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৭ জুলাই, ২০১৮

প্রদীপভূষন রায়

পরিবর্তনের গল্প  
      
মেট্রো থেকে নেমে গণেশ পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে । সকালেই যাবার সময় খেয়াল করেছিল আপ আর ডাউন দুদিকের এসক্যালেটারের সিঁড়িগুলো খুলে মেইনট্যানেন্সের কাজ চলছে।
কাজেই এসক্যালেটারের আরামটা সকালেও পায়নি , এখনও পাবে না । সবাই সিঁড়ির দিকেই হাঁটছে । বয়সটা যে বাড়ছে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামাতে বেশ বুঝতে পারে আজকাল । হাঁফ ধরে যায়, হাঁটুতেও লাগে । বয়সের আর দোষ কি । মেঘে মেঘে বেশ বেলা হল । এই তো কদিন বাদেই পঞ্চান্ন পার হয়ে ছাপ্পান্নতে পা দেবে । সুমিতা তো আজকেও বলছিল ‘ সাবধানে যেও একদম হুটোপাটি কোরো না । তোমার আবার সব কিছুতেই তারাহুড়ো ।’
ভুল বলেনি সুমিতা । সময়ের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সামলাতে পারে না । ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে । কাজের চাপ সংসারের চাপ এমন ভাবে বেড়ে চলেছে ফুরসতের সময় কোথায় । রোজ রোজ জিনিসপত্রের যে ভাবে দাম বাড়ছে খুব সাধারণ ভাবে সংসার চালানোই বেশ কঠিন হয়ে উঠছে । আজকাল একটা অসহনীয় চাপের মধ্যেই দিনগুলো কেটে যায় সাধারণ মানুষের । গণেশ তো তাদেরই একজন । তাই তার জীবনটাও সেইরকমই হবে । দশটা পাঁচটার সরকারি চাকরি জোটেনি । মাস গেলে থোক টাকাটা হাতে আসবে সেইরকম নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন গনেশের নয় । রোজই তার ছোটা । লোকের থেকে ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম জোগাড় করা , জমা দেওয়া , রশিদ পৌঁছে দেওয়া , তার ওপর নতুন ব্যবসার চাপ । এর সঙ্গে রয়েছে নানান ধরণের সার্ভিসিং।
ল্যাপস পলিসি রিভাইভাল , ম্যাচুরিটি ক্লেইম , মানি ব্যাক পলিসির সারভাইভাল ক্লেইম । ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট রাখতে তার অন্য ব্রাঞ্চের সার্ভিসিং । যে পলিসিটা আদৌ তার করা নয় । ছোটা-টা তাই বেড়েই চলেছে । মাঝে মাঝে বড় ক্লান্তও লাগে আজকাল । একটা অদ্ভুত একঘেয়েমি মনের মধ্যে বাসা বাঁধছে ।
 
স্টেশন থেকে বেরিয়ে বড়রাস্তায় উঠে অবাক হয় গণেশ । রাস্তায় একটাও অটো নেই । অন্য সময় অটোর জন্য হাঁটাচলাও মুশকিল হয়ে পড়ে । প্রায় গায়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেলেও অটোচালকের কোনও হেলদোল দেখা যায় না । রাস্তায় শুধু প্যাসেঞ্জার ভরে নিয়ে সাইকেল রিক্সা পাঁইপাঁই করে ছুটছে । গুমোট ভাবটা যেন বেড়েই চলেছে । আকাশের রঙটা অন্যরকম । একটু একটু করে মেঘ জমছে মনে হচ্ছে । মোড়ের রিক্সা-স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলে গণেশ । সারাদিনের খাটুনির পর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না । স্ট্যান্ডে এসে দেখে একটাও রিক্সা নেই । অনেক প্যাসেঞ্জারই দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্য । লোকের কথায় জানতে পারে সি এন জি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না । তাই স্বাভাবিক সরবরাহের দাবিতে অটোর স্ট্রাইক । ক্লান্তিতে শরীরটা যেন আর চলতে চাইছে না । একটু অপেক্ষা করে । খানিক বাদে প্যাসেঞ্জার নিয়ে একটা রিক্সা এসে দাঁড়ায় । ভাড়া দিয়ে প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ার পরে গনেশ এগিয়ে গিয়ে রিক্সাটাকে ধরে । লোকটা অদ্ভুত ধরনের । কথাবার্তা কেমন যেন চ্যাটাং চ্যাটাং । ভাড়ার কথা শুনে তো গণেশ থ । কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । তবুও গনেশ বলল , তোমাদের সেক্রেটারি কে ? লোকটি বলে উঠল , যে-ই হোক , বৃষ্টি হলে আরও পাঁচ টাকা এক্সট্রা লাগবে ।
 
- সে তো বৃষ্টি পড়লে এমনিতে দিতেই হয় তা বলে রোজকার ভাড়াও বেশি চাইছো ! অটোর স্ট্রাইক বলে মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছ ।
 
- আমি কি আমার রিক্সায় যাবার জন্য আপনাকে জোর করছি ? পোষালে যাবেন না হলে যাবেন না । শুধু শুধু এত কথা বলার তো দরকার নেই ।
- এত কথা কি আর এমনি বলছি ? তোমাদের অন্যায় আবদারের জন্যেই বলতে হচ্ছে ।
 
- অন্যায় তো সবাই করছে । সব জায়গায় কি বলেন ? দু-টাকার জিনিষ পাঁচ টাকায় কিনতে হচ্ছে । সব তো মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন , দোষ দেখছেন শুধু আমাদের ।
- সেটাই তো আমাদের অসহায়তা । সব কিছু মেনে নিতে নিতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে । তোমার শর্তটাও মেনে নিতে হবে । কেননা সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে এতটা রাস্তা হেঁটে বাড়ি ফেরার ধকল নেওয়ার অবস্থায় নেই বলে । সেইজন্যেই বলছি যেটা করছ ঠিক করছ না ।
 
- ঠিক বেঠিকের প্রশ্নটা আসছে কোথা থেকে ! যেখানে জীবনটাই বেঠিক হয়ে গেছে ।
 
- একথা কেন বলছ ? রাজ্যে পালা বদল হল । নতুন সরকার । একটা পরিবর্তনের আশা করতেই তো মানুষ সরকার পরিবর্তন করল । বেঠিককে ঠিক জায়গায় আনার জন্যেই তো ।
 
- না দাদা , শুধু বাইরেটাই বদলেছে । দেখছি তো সব । এই আমাদের ইউনিয়নের কথাই ধরুন না , পুরো ইউনিয়নটাই পালটি খেলো । ভাবতে পারেন ! আগেও একটা ইউনিয়ন ছিল , এখনও একটা । তফাতটা শুধুই রঙের । চরিত্রের বদল হয়নি ।
- এত তাড়াতাড়ি সব হয় না । খানিকটা সময় তো দিতে হবে ।
 
- সময়টাই তো কমে গেছে । সবাই দৌড়াচ্ছে । কে আগে যাবে । সোজা ভাবে সহজ চলার ছন্দটাই এখন হারিয়ে গেছে । প্রতিটা মানুষই এখন সু্যোগের অপেক্ষায় থাকে । সু্যোগ পেলেই একে অন্যকে পিষে দিয়ে চলে যায় । তখন তার ন্যায় নৈতিকতা বিবেকবোধ সব হারিয়ে যায় । আমার বয়স তো কম হল না । দেখলাম তো অনেক । বাতাসে স্বার্থপরতার গন্ধ । আপনি পান না ?
 
- এভাবে ভাবছ কেন ? এখনও অনেক মানুষ দেখা যায় যারা মানুষের পাশে দাঁড়ায় । যাদের জন্য মানুষ এখনও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। চলো, যেতে যেতে কথা হবে, তুমি যা চাইছ তাই দেবো ।
 
এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে তোমার সময় নষ্ট করাটাও ঠিক নয় । অটো না থাকায় প্যাসেঞ্জারের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে । রিক্সাগুলো আসছে আর ভর্তি হয়ে চলে যাচ্ছে । এরপর আর রিক্সা পাব না ।
গণেশ রিক্সায় উঠে বসে । রিক্সাচালক রিক্সা ঘুরিয়ে প্যাডেলে চাপ দেয় । সামনে বাধা । এক বয়স্ক ভদ্রলোক রিক্সার সামনে । রিক্সাচালক খেঁকিয়ে ওঠে । ‘ দেখে চলতে পারো না ! ধাক্কা লাগলেই তো রিক্সাচালকের দোষ হত ।’
 
গণেশ লক্ষ করে রিক্সাচালকের ধমকানিতে ভদ্রলোক বেশ অপ্রস্তুত । আধময়লা পোষাক , বয়সের ভারে দু-হাতের বড় ব্যাগ দুটো সামলাতে পারছেন না । গণেশ রিক্সাওলাকে থামায় । ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে ,
 
- আপনি কোথায় যাবেন ?
- রঙকলের মোড় ।
- উঠে পড়ুন রিক্সায় । আমার রাস্তাতেই পড়বে , আপনাকে নামিয়ে দেব । দুটো ভারি ব্যাগ নিয়ে আপনি পারবেন না । অটোর স্ট্রাইকে রিক্সার যা অবস্থা , আসছে আর উবে যাচ্ছে । আপনি রিক্সা জোগাড় করতে পারবেন না ।
 
ভদ্রলোক রিক্সায় উঠতে যেতেই রিক্সাওলা বলে ওঠে , ‘ উনি তো আপনার লোক নন , ওনাকে তুলব না ।’
গণেশ অবাক হয়ে যায় । বলে নাই বা হল আমার লোক । বয়স্ক মানুষ , অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন । ওনাকে নিতে চাইছো না কেন ?
 
- আমার ইচ্ছে । আমার গাড়ি , আমি কাকে নেবো কাকে নেবো না আমিই ঠিক করব ।
- আশ্চর্য লোক তো তুমি ! অবস্থার সু্যোগ নিয়ে যা ইচ্ছে তাই শুরু করেছো । আরে দুটো লোক শেয়ারেও তো রিক্সা চড়ে ।
 
- ঠিক আছে , নিতে পারি । তবে ওনাকে আলাদা ভাড়া দিতে হবে ।
 
- ভাড়া তো আমি দিচ্ছি । একই রাস্তায় খানিক দুরেই নেমে যাবেন । তার জন্যে এনার থেকেই ভাড়া নেবে !
- কেন নেবো না ? উনি রিক্সায় উঠবেন ভাড়া দেবেন না !
- তোমার রিক্সায় দুজন বসতে পারে । যদি তার থেকে বেশি লোক হয় তার জন্য লোকে এক্সট্রা ভাড়া দেয় । আমার সঙ্গে যদি আর একজন থাকত তার জন্যে কি বেশি ভাড়া চাইতে ?
 
- সেটা তো হয় নি ।
- নাই বা হল । তুমি বেশি ভাড়া চেয়েছো আমি রাজি হয়েছি । এখন একজনকে যদি সঙ্গে নিই তাহলে তার জন্যে আলাদা নেবে কেন ? তোমরা কি অটোর মতো লোক প্রতি ভাড়া নিতে শুরু করেছো ?
- আপনি বড় ক্যাচাল করেন । গরিব মানুষ একটু পয়সা পাবে তাতেও আপত্তি ।
- গরিব মানুষের বেশি পয়সায় আমার একটুও আপত্তি নেই । আপত্তি শুধু অন্যায় দাবিতে।
একটু আগেই বলছিলে না , ‘ সুযোগ পেলেই একজন অন্যজনকে পিষে দিয়ে চলে যায় ।’ তুমি যা করছ এটাও তো সেইরকমই । আসলে আমরা সকলেই একটা অদ্ভুত চেনের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। যার মধ্যে আটকে গিয়ে অজান্তেই কখনও আমরা শিকার কখনও বা শিকারী হয়ে যাচ্ছি । যাক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । উনি ভাড়া দিতে না পারলে আমার থেকে নিয়ে নিয়ো । এখন চল ।
গণেশের ইশারায় বয়স্ক মানুষটি রিক্সায় উঠে আসেন । রিক্সা চলতে শুরু করে । আকাশে বেশ মেঘ জমেছে । বৃষ্টি হলেও হতে পারে । অদ্ভুত একটা ভ্যাপসা গরম । ব্যাগের মধ্যে থেকে ছোট জলের বোতলটা বার করে গণেশ । আসার সময় পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে ঠান্ডা জল ভরে নিয়েছিল । এখনও বেশ ঠান্ডা । মেট্রো ট্রেনটা এদিকে চালু হওয়ায় যাতায়াতের বেশ সুবিধা হয়ে গেছে । না হলে এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বাসে করে আসা যে কি দুর্ভোগের , যারা আসে একমাত্র তারাই বোঝে । এক একটা সিগনালে রাত কাবার। গাড়ি যেন নড়তেই চায় না । বছর বছর শুধু গাড়ি বেড়ে গেছে , রাস্তা বাড়েনি । ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে । গাড়ির গতি গেছে শ্লথ হয়ে । আগে যখন বাসে আসত , ডালহৌসি থেকে গড়িয়া পৌঁছতে দু-ঘণ্টা লেগে যেত । আর এখন আধঘণ্টার মধ্যে গড়িয়া । কতটা সময় বেঁচে গেছে । বোতলের ছিপি খুলে খানিকটা গলায় ঢেলে নেয় । খানিকটা স্বস্তি পায় গণেশ । রাস্তায় শুধুই আজ রিক্সার প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ। এদিকে অটো বন্ধ থাকলে খুব অসুবিধা হয় । একটা বাস রুট যদি চালু থাকত তবে মানুষকে এইরকম দুর্ভোগে পড়তে হত না । গণেশের মনে পড়ে একসময় সকালবেলায় হেঁটেই গড়িয়া থেকে সাড়ে আটটার সরকারি বাস ধরত । তখন আসা যাওয়া হেঁটেই করতে হত । সাইকেল আর রিক্সা ছাড়া কিছুই ছিল না । তারপর অটো চালু হতেই অভ্যাসটা গেল বদলে । হাঁটার ইচ্ছেটাই উবে গেল । এইজন্যেই বোধহয় বলে মানুষ অভ্যাসের দাস। ছিপিটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে নজর পড়ে ভদ্রলোকের দিকে । পকেট থেকে রুমাল বার করে বারবার ঘাম মুছছেন । গণেশ জলের বোতলটা এগিয়ে দেয় । জিজ্ঞেস করে , ‘ শরীর খারাপ লাগছে ? যা ভ্যাপসা গরম । আমরাই কাহিল হয়ে যাচ্ছি। আপনার তো বয়স হয়েছে । একটু জল খেয়ে নিন। দেখবেন ভালো লাগবে ।’
 
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিতে গিয়ে টলে পড়েন গনেশের দিকে । গণেশ বাম হাত দিয়ে ধরে ফেলে । গণেশের হাতের মধ্যে এলিয়ে পড়ে থাকেন । কোনও কথা বলার শক্তি নেই । গণেশ বুঝতে পারে ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । রিক্সা থামাতে বলে । রিক্সাওলা বিরক্তিতে জিজ্ঞেস করে , ‘ কী হয়েছে ?’
- মনে হচ্ছে খুব অসুস্থ বোধ করছেন ।
 
রিক্সাওলা এগিয়ে এসে গণেশের হাত থেকে জলের বোতলটা নিয়ে খানিকটা জল ভদ্রলোকের চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয় , তারপর ভদ্রলোককে দেখে গনেশকে বলে , ‘ দাদা , আপনি শক্ত করে ওনাকে ধরে থাকুন । সামনেই একটা ওষুধের দোকান আছে , এই সময় একজন ডাক্তারও থাকে। একবার দেখানো দরকার ।
গণেশ শক্ত করে ধরে থাকে ভদ্রলোককে । অল্পক্ষণের মধ্যেই রিক্সাওলা একটা ওষুধের দোকানের সামনে এসে দাঁড় করায় রিক্সাটাকে । কয়েকজনকে ডেকে নেয় , তারপর ধরাধরি করে রিক্সা থেকে নামিয়ে শুইয়ে দেয় একটা বেঞ্চের ওপর । ডাক্তারবাবু বেরিয়ে আসেন ভেতর থেকে । ওদের মুখে সব শুনে পরীক্ষা করতে শুরু করেন । পালস দেখেন , প্রেশার মাপেন । কী একটা ওষুধ জিভের তলায় দিয়ে দেন । একটা ইনজেকশনও দেন ।
একটু বাদেই ভদ্রলোক সুস্থ হয়ে ওঠেন । ধীরে ধীরে উঠে বসেন বেঞ্চের ওপর । ডাক্তারবাবু বলেন, ‘ ভয়ের কিছু নেই এখন । গরমে প্রেসারটা হঠাৎ ফল করে গিয়েছিল । তবে ওনার একটা ই সি জি করা দরকার । বয়স হয়ে গেছে , হার্টটা মনে হল একটু দুর্বল । আমি প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি ।
গণেশ ডাক্তারের ফিস ওষুধপত্রের দাম মিটিয়ে দেয় । রিক্সাওলাকে বলে, ‘ ভাই এই অবস্থায় তো ওনাকে রঙকলের মোড়ে নামিয়ে দেওয়া যায় না , বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে হবে আমাদের । রাগ কোরো না , যা চাইবে দিয়ে দেব ।’
ভদ্রলোককে বলে, ‘ আপনার বাড়িটা চিনিয়ে দেবেন , আমরা আপনাকে পৌঁছে দেব ।’
রিক্সাওলা বলে, ‘ আমি ওনার বাড়ি চিনি ।’
ভদ্রলোককে রিক্সায় ধরাধরি করে তুলে আস্তে আস্তে রিক্সা এগিয়ে চলে । রঙকলের ডানদিকের রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে একসময় একটা টালির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রিক্সাটা । ভদ্রলোককে ধরে আস্তে আস্তে নামায় রিক্সা থেকে । ভদ্রলোক পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে রিক্সাওলার হাত দুটো ধরে বলে ওঠেন , ‘ আমায় ক্ষমা করে দিস সুখেন ।’
টাকা সুদ্ধু হাতটা সরিয়ে দেয় রিক্সাওলা । গনেশকে অনুরোধ করে , ‘ দাদা আপনি ওনাকে একটু ঘর অবধি পৌঁছে দিন ।’
গনেশ হতবাক হয়ে যায় । রিক্সাওলার কথামত ভদ্রলোককে ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসে রিক্সায় উঠে পড়ে ।
 
রিক্সা চলতে শুরু করে ।
দুজনে কেউই কথা বলে না ।
গনেশই নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করে , ‘ তুমি ওনাকে চেনো , তা সত্ত্বেও ওনাকে নিতে চাইছিলে না কেন ?’
এবার উত্তর আসে , ‘ আমি ওনাকে ঘেন্না করি ।’ একটা তীব্র বিতৃষ্ণা যেন ঝরে পড়ে সুখেনের গলায় ।
- কেন ? কী করেছেন উনি ?
- নিজের স্ত্রী , ছোট ছোট দুটো সন্তান থাকা সত্ত্বেও হঠাৎই আরেকটা বিয়ে করে নিয়ে এসে অসহায় নিরপরাধ স্ত্রী আর বাচ্চাদের ঘর থেকে বার করে দেন । রাতের অন্ধকারে কোথায় থাকবে কী খাবে তারা , কোনও কিছুই ভাবতে চাননি সেদিন । তাদের কোনও কান্নার আওয়াজ তাকে স্পর্শ করেনি । বুঝতে পারছেন কেমন মানুষ লোকটা । এইরকম একটা মানুষের জন্য আমি কেন ভাববো বলতে পারেন ?
 
- ওনার সেই স্ত্রী আর বাচ্চারা ! তারা এখন কোথায় ?
- জীবনের চলার পথে ঠোক্কর খেতে খেতে তারাও এখন এই পৃথিবীরই একজন হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ।
- তুমি তাদের চেনো ?
উত্তর দেয় না সুখেন । রিক্সা এগিয়ে চলে । একসময় থামায় ।
- আপনার স্টপেজ এসে গেছে দাদা ।
গণেশ নেমে পড়ে । পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে ভাড়ার টাকা এগিয়ে দেয় সুখেনের দিকে । বাড়তি ভাড়া ফিরিয়ে দিতে দিতে সুখেন বলে ওঠে , ‘ অনাত্মীয় হয়েও একজন অপরিচিত মানুষের জন্য আপনি যা করলেন , সেই মানুষের ছেলে হয়ে এরপরেও আপনার থেকে বেশি ভাড়া নিই কী করে ।’