যদি
এমন হয়
একবার মনে মনে ভাবুন যদি এরকমটা হ'ত তাহ'লে কেমন হ'ত।
ধরুন কৈলাস পর্বতের প্রদোষকাল। মহাদেব বেড টি খেয়ে সদ্য বিছানা ছেড়ে উঠেছেন। মনে
মনে ভাবছেন অন্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশীই দেরী হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠতে। তারপরই
তাঁর মনে পড়লো আগের সারা দিন এবং রাত্রেও এক ভক্তের বাড়ীতে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে
বাড়ী ফিরতে মধ্য রাত্রি পার হয়ে গেছলো। একবারও তাঁর মনে পড়েনি যে গতকালই তাঁর আর
পার্বতীর পাঁচ কোটি তিরিশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার সাতশ পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী ছিল।
তাই ঘরে ফেরা অব্দি সেই যে পার্বতী মুখ ফিরিয়ে রয়েছে, তাঁর
সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহসটুকুও মহাদেবের আর হচ্ছে না। পার্বতীর থমথমে মুখটার দিকে
তাকালে বুকের ভিতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মহাদেবের। ভাবছেন কী ভাবে তাঁকে
ঠাণ্ডা করা যায়। নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে তাঁর। কোন মতেই বিবাহবার্ষিকীর দিনটা
ভুলে যাওয়া উচিৎ হয়নি তাঁর। এর আগে তো কখনও এমনটা হয়নি। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে
গামছাটা টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন তিনি। তাঁর ধ্যানে বসার সময় আগতপ্রায়। ভাবেন,
পার্বতী অনেক কোমল হৃদয়া, তাই ওর কাছে
ক্ষমা চেয়ে সব মিটমাট বা ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে।
ওদিকে অদ্ভুত রকম থমথমে আর গম্ভীর মুখ নিয়ে পার্বতী ঝাড়ু হাতে ঘর
পরিষ্কার করছেন আর অকারণে সরস্বতী কে বকাঝকা করছেন। সরস্বতী বুঝতেই পারে না মায়ের
কি হ'ল। প্রতিদিন সকালে মা কত হাসিখুশি থাকে, কত সুন্দর করে সবার সাথে কথা বলে, হাসে,
জলখাবার বানিয়ে সবাইকে খেতে দেয় কিন্তু আজ কী এমন হ'ল যে কোন কারণ ছাড়াই এত বকাবকি করছে ? সরস্বতী
গভীর দৃষ্টি নিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়, তার মনে হয়
মায়ের চোখের কোনায় জল। মায়ের চোখে জল কেন ভেবেই অস্থির হয়ে যায় সে। কিছুতেই তার
বোধগম্য হয় না কি এমন কারণ থাকতে পারে যাতে মা ভীষণ দুঃখ পেয়েছে ? লক্ষ্মীও ঘরে নেই। সে তো সদা চঞ্চলা, কোন সময়
স্থির থাকে না। এই সাত সকালে সে যে কোথায় গেছে কেউ জানে না। কার্ত্তিক ভোর হ'তে না হ'তে তীর ধনুক নিয়ে বন্ধুদের সাথে কোন
জঙ্গলে বীরত্ব ফলাচ্ছে কে জানে বাপু। আর গণেশের কথা তো ধরারই নয়। প্রতিদিন কত
বেলায় যে তার ঘুম ভাঙে তার ঠিকানা নাই। মা বাবার শত বকুনিতেও তার কিছু যায় আসে না।
তার কাজ শুধ ঘুম আর ভালমন্দ খাওয়া।
মহাদেব বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিত্যদিনের মত তাঁর পূজো এবং ধ্যানের
জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাস্থানে দেখতে না পেয়ে পার্বতী কে ডাকতে থাকেন চিৎকার করে।
কিন্তু পার্বতীর তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ নাই। তাঁর বইয়েই গেছে মহাদেবের ডাকে সাড়া
দিতে। ভাঙড় ভোলার মনে পড়ে যায় পার্বতীর রাগের কারণ। মনে মনে তিনি ভাবেন যেভাবেই হ'ক তাঁকে তুষ্ট করতে হ'বেই নইলে সমূহ বিপদ।
সরস্বতী সকালবেলা মা বাবার এহেন আচরণে বিস্মিত হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে তাঁদের মধ্যে
এমন কিছু ঘটেছে যার ফলে এই বিপত্তি। যাই হ'ক, বাবার ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটছে দেখে সরস্বতী বলে, “বাবা, আমি তোমার সব জোগাড় করে দিচ্ছি, তুমি ধ্যানে বসো”। মহাদেব জোরে জোরেই বলেন,
“না থাক, কোন দরকার নাই, আমি আজ আর ধ্যানে বসবো না। তুই বরং আমাকে এক গ্লাস জল এনে দে, জল খেয়েই আমি একবার বিষ্ণুলোকে যাব খুব জরুরী কাজ আছে”। মহাদেবের কথা শুনে পার্বতীর গা পিত্তির জ্বলে যায়, তিনি উচ্চ কণ্ঠেই বলতে থাকেন, “সরস্বতী তোর
বাপকে বল যেখানে খুশী, যার কাছে খুশী যাক, কিন্তু যাবার আগে বাজার হাট করে দিয়ে যাক, তা
না হ'লে এত বড় গুষ্টির পিণ্ডি চটকাব কি করে। ওর কি,
যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে। ছাই পাঁশ খাবে, যেখানে সেখানে পড়ে থাকবে। আজ একবার নন্দী ভৃঙ্গী আসুক না, ঝাঁটা মেরে তাড়াবো দুটোকে”। মায়ের এই রুদ্র
মূর্তি দেখে সরস্বতীর তো ভিরমি খাবার জোগাড়। বাবার সাথে তার খুব ভাব, তাই সাহস করে সরস্বতী বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “মায়ের
কি হয়েছে বাবা, এমন করছে কেন ? সকাল
থেকে দুঃখ দুঃখ, রাগী রাগী মুখ নিয়ে নিজের মনে কাজ করে
যাচ্ছে। আমি এক দু'বার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে
ফিরে এলাম। একবার তো লক্ষ্য করলাম মায়ের চোখে জল”। মহাদেব
মেয়ের কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ বাজারের থলি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
বাজার থেকে ফিরে থলিটা নামিয়ে রেখে মহাদেব সটান রান্নাঘরে গিয়ে
পার্বতীর দুটো হাত ধরে বলেন, “ক্ষমা করে দাও
প্লিজ, আর কক্ষনো এমনটা হ'বে না।
আর তা ছাড়া এত লক্ষ বছর পার করে এলাম, কখনও কি এমন ঘটনা
ঘটেছে ? আমি যে তোমাকে অনেক ভালবাসি। তাও ভাবছি তোমার
সাথে এমনটা কি করে করলাম। তুমি আমায় মাফ না করলে আমি যে মর্মে মরে যাব। ভক্তের
সাধনায় আমি এমনভাবে মুগ্ধ হয়ে নিবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে বাড়ী ফেরার কথা ভুলেই
গেছলাম। তোমার ব্যথাভরা, বেদনার্ত মুখটা আমি দেখতে পারছি
না। বুকের ভিতরটায় আমার যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে। দয়া করে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আর
আবার তুমি স্বাভাবিক হয়ে যাও”। পার্বতীর পক্ষে আর
বেশীক্ষণ রাগ বা দুঃখ পুষে রাখা সম্ভব হয় না। তিনি ভাবেন সত্যিই তো তিনি তো এই
লক্ষ লক্ষ বছরে কখনও, কোন অবস্থাতেই তাঁকে অবহেলা করেন নি।
সুখে, আনন্দে, ঐশ্বর্যে, ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছেন তাঁর জীবন। উত্তরে পার্বতী কিছু বলার আগে
মহাদেব আরও বলেন, “তুমি তো জগদম্বা, ভুবনেশ্বরী, ত্রিভুবনই তো তোমার বাসস্থান। এই
কৈলাস পর্বতে না হয় আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ পার হয়ে গেছে, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তো এখনও আমাদের বিয়ের তারিখটা পার হয়ে
যায়নি”। পার্বতীর জবাবের অপেক্ষা না করেই মহাদেব
পার্বতীকে নিজের কাঁধের উপর চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে আকাশপথে দ্রুতগামী রকেটের মত
উড়তে উড়তে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরের সৈকতে নিয়ে গিয়ে কাঁধ থেকে
নামিয়ে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে পার্বতীর দিকে বাড়িয়ে ধরে হাসি মুখে বলেন, “হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। মেনি মেনি হ্যাপি রিটারন্স অব দি ডে”।