গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮

মনোজিৎকুমার দাস

কমললতা                                                                                                                          জলজঙ্গল ঘেরা এক বিশাল অঞ্চল। দক্ষিণে নবগঙ্গা আর কুমোর গাঙ , উত্তরে গড়াই নদী আর এই দুই গাঙের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে হানু গাঙ।                                                                                                                                                                  বছরের দশমাস মাঠঘাট জলমগ্ন , ফসলের মাঠ বন্যায় ধৌত , ফসল নেই জলে আছে মিঠে জলের কৈ ,মাগুর ,পুঁটি ,খয়রা আর রুই কাতলার পোনা । জলজ উদ্ভিদের মধ্যে শাপলাশালুক ,কচুরিপানা, চেঁচো আরো কত কী ! বনবাদারে শুকোর , শেয়াল, সাজারু ,নাপারু ,বন বিড়াল ,গোলবাগা ,বাগডাসা , চিনে জোক , ঘুই সাপ ,ধোড়া সাপ, কাঁকড়া ইত্যাদি। আর পাখপাখালির মধ্যে জলে পাতিহাঁস, পানকৌড়ি, কাইম, বেলে হাঁস,বক,কাঁদাখোঁচা, কচ্ছপ ইত্যাদি আর ডাঙ্গার গাছের ডালে ডাহুক, পেঁচা, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়ুই আরো কত প্রাণি! এবাড়ি থেকে ওবাড়িতে ,এপাড়া থেকে ওপাড়ায় যেতে পেরতে হয় বাঁশের সাঁকোয় । তালের ডোঙ্গা ,কলার ভেলা ,নৌকায়ই জলজঙ্গল ঘেরা এই অঞ্চলের একমাত্র যোগাযোগের বাহন । এখানে ছেলেদেরই পড়াশোনার কথাই ভাবা যায় না মেয়েদের কথা ছেড়ে দিতে হয় । এমন একটা অঞ্চলের এক গ্রামের মেয়ে কমললতা। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় কমললতা তাই। দুই ভাইয়ের এক বোন। জলজঙ্গল ঘেরা অঞ্চলের কলকাতার সাথে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম গোয়ালনন্দ মেইল।শিয়ালদহ টু গোয়ালনন্দ ভায়া পোড়াদা।

এক সময় কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী । কমললতাদের গ্রামের অনেকেই কলকাতা শহরে কাজকর্ম করতে যায় ,কমললতার বাবা গিরিন বছরের দশ মাসই কলকাতায় থাকে। বাপ কলকাতায় কী কাজ করে তা কমললতা জানে না। তবে কমললতা লোক মুখে শুনেছে তাদের গ্রামের যারা কলকাতায় যায় তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করে। কেউ কেউ নাকি পোস্তগোলার ভূষিমালের আড়তে বস্তা সেলাই করে। তবে তাদের গ্রামের গিরিশ সিকদারের নাকি কালীঘাটের সোনার বেনেদের সাথে দহরম মহরম , এ সব কমললতার শোনা কথা । তার নাকি ইংরেজ মহলেও আনাগোনা আছে ।এ কথাটা কমললতার বিশ্বাস হয় না।                                                                                                    কিন্তু এক সময় বিশ্বাস হবার একটা কারণ খুঁজে পায় কমললতা ,তাদের গ্রামের বড়তলা এস্টেটের  জমিদারী তিনি নাকি ইংরেজদের সাথে দেনদরবার করে কালীঘাটের ছোটখাট সোনার বেনে ভুবন সেনকে কিনে দিয়েছিলেন ,আর এজন্য বেনেমশাই গিরিশ সিকদারকে জমিদারীর এক আনা অংশ দিয়েছিলেন । তাদের দেখাদেখি দাসেদের বাড়ির মদন দাসের কাকা রসময় প্রথমে নাকি কলকাতায় যায় এবং পয়সাকড়িও উপার্জন করেন ভালই । মদনের ছেলে মতিকে তিনি কলকাতায় নিয়ে ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি করে দেয়। অন্যদিকে গিরিশ সিকদার  গ্রামের অনেক ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে যায় । কমললতার বাপ তাদের মধ্যে একজন ছিল। সেকালে ছাওয়ালদের লেখাপড়ার  স্কুল না থাকলেও তাদের পাড়ায় বঙ্কা রাহুত ছেলেদেরকে তার পাঠশালায় পড়াতো । মেয়েরা লেখাপড়ার কথা ভাবতেই পারতো না ।
গ্রামের মানুষেরা নৌকোয় জানিপুর যেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে খোকসা স্টেশনে পৌঁছে গোয়ালনন্দ মেইল ধরে কলকাতায় যেত।                                             কমললতার বাপ গিরিন সেবারই প্রথম কলকাতায় যায় রসময় দাসের সঙ্গে । গিরিন বঙ্কা রাউতের পাঠশালায় লেখাপড়া করে যা শিখেছিল তাতে গিরিন কলকাতার পোস্তাগোলার আড়তে খাতা লেখার কাজ পেয়ে যায় । বাপ কলকাতায় কাজ পাওয়ায় কমললতা বেজায় খুশি হয়। এক সময় তার ইচ্ছে হয় বাপের সাথে কলকাতা যাওয়ার। বছরে একবার কমললতার বাপ বাড়িতে আসে বর্ষা মৌসুমে। কমললতার বাপ যে টাকাকড়ি কলকাতা থেকে উপার্জন  করে নিয়ে আসে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কলকাতা মুখো হবার কথা ভাবে না ।
কমললতার মা একথায় সুন্দরী ,মায়ের চেহারা অবিকল পেয়েছে কমললতা। মায়ের মতো টিকালো নাক ,মায়ের মতোই ফর্সা। কমললতা ভাবে ,তার মত বয়সে মাও হয়তো আরো সুন্দরী ছিল।
গায়ের মেয়ে বউরা শাড়ি পরে । শায়া ,ব্লাউজ নাকি পরে কলকাতার বড় ঘরের বউঝিরা কমললতা শুনেছিল সিকদার বাড়ির ছোট তরফের মেয়ে চারুলতার কাছ থেকে। চারুলতারা সবাই কলকাতায় থাকে। বাপে সঙ্গে চারুলতা এই নিয়ে দুবার গ্রামের বাড়িতে এসেছে।ওর বাবা কেন যে ওর মাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসে  না তা কমললতার বোধগম্য হয় না । বিষয়টা বাবাকে জিজ্ঞাসা করবে বলে ভাবলেও কিন্তু করতে পারে না। তবে লোক মুখে সে শুনেছে চারুলতার মা নাকি ওর বাবা শম্ভু সিকদারের রক্ষিতা। চারুলতার মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাবার পর ওই রক্ষিতার কাছে সে মানুষ!
চারুলতার মতো পোশাক পরতে কমললতার ইচ্ছে হয়। কমললতা ভাবে ,তার বাবা কেন তার মা ও তাকে কলকাতায় নিয়ে যায় না ! তবে কি বাবারও কলকাতায় রক্ষিতা আছে। বউবাচ্চাকে কেউ অজ পাড়াগ্রামে ফেলে রাখে?                                              

মা কেন বাবাকে চাপ দেয় না কলকাতা যাবার জন্য।কমললতা বুঝতে পারে তার শরীরে পরিবর্তন হচ্ছে পশ্চিমপাড়ার তাঁতিদের বোনা লাল শাড়ি পরে এসেছে ছোটবেলা থেকে ।একই বয়সের মেয়েরা বুকে পেঁচিয়ে রাখা শাড়ির আঁচল মাজায় বেঁধে এক বয়সী ছেলেদের সঙ্গে বৌছি খেলে বিকেল হলেই ,কমললতা একদিন খেলার সময় বুকের থেকে শাড়ি আঁচল সওে গেলে নিজের বুকের দিকে চোখ পড়তেই সে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ।তারপর থেকে কমললতা ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যাওয়া বন্ধ করে ।

সে বছরে পুজোর আগে চারুলতা গ্রামের বাড়ি আসে বাবার সঙ্গে ।চারুলতাকে দেখে কমললতা অবাক হয়। ও এই কয়দিনে এত বড় হয়ে গেছে ! সে ভাবে , সেও কি ছোটটি আছে !চারুলতার গায়ে রঙিন ব্লাউজ , পরনে শাড়ি । সে ভাবে , তাকেও চারুলতার মতো এখন থেকে ব্লাউজ পরতে হবে ।মাঝে মাঝে বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল অজান্তে সরে গেলে তার এককালের খেলার সাথী ছেলেগুলো তার বুকের দিকে লোভী দৃষ্টি তাকায় , এতে কমললতা কেন যেন লজ্জা পায় । সে ভাবে , বুকের কাপড় সরে গেলে লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্যেই চারুলতা তার উঠন্ত স্তন দুটো ব্লাউজের আড়াল ঢেকে রাখে।
বাবা তো কলকাতায় থাকে ,মা ও তার জন্য কেন তার বাবা শায়া ব্লাউজ কিনে আনে না! চারুলতা কেন যেন কমললতার মনে কথা বুঝতে পারে না। সে তাকে বলে,‘ ,গ্রামের মেয়েদের লজ্জা নেই আমি প্রথমবার গ্রামে এসেই বুঝেছিলাম । তোর বাবা আস্ত একটা শয়তান ,সেই মিথ্যে করে রটিয়েছিল যে আমার বাবার রক্ষিতা আছে ,অথচ সে নিজে কলকাতায় রক্ষিতা রেখে সংসার করছে আর তোদেরকে এই হালে রেখেছে ।

নিজের বৌবাচ্ছা থাকতে রক্ষিতা রেখে স্ফুর্তি করার খবর পেয়ে কমললতা মরমে মরে যায়। বামনপাড়ার কালা গোসাইয়ে ছাওয়াল পদা কমললতাকে একলা পেয়ে বুকের শাড়ির মধ্যে হাত গলিয়ে তার বুকের সদ্য বেড়ে উঠা ছোট্ট ছোট্ট স্তন দুটোয় হাত দিলে সে এক ঝটকায় তার  হাত সরিয়ে দিয়ে তাকে গালিগালাজ করে কমললতা।                                                                       সেদিন সে কালা গোসাইয়ের কাছে পঞ্চগব্যকে মন্ত্রপুত করাতে গিয়েছিল ঠাকুমার কথায়। দক্ষিণপাড়ার শিবুদার মেয়ে সলোকা তাদের কুয়ো ছুঁয়ে দেওয়ায় নাকি ক্ুঁয়োর জল অচ্ছুত হয়ে গেছে। ঠাকুমার এক কথা কালা গোসাইয়ে মন্ত্র পড়া পঞ্চগব্য কুয়োয় না দিলে পারে জল সুদ্ধ হবে না। কমললতা ভেবে পায় না এ কেমন বিধান। শিবুদার এতটুকু মেয়ে সলোকার হাতে কি রোগব্যধির বীজ আছে! শিবুদাদের পদবী সরদার। আসলে তারা বুনো সম্প্রদায়ের মানুষ।

 পদার কান্ডকে কমললতা মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। সে ভাবে, কালা গোসাইয়ের ছাওয়াল পদা বাপকা বেটা! বাড়িতে পদার মা থাকতেও কালা গোসাই বুনো ও বাউড়ি পাড়ার বউঝিদের চরিত্র নষ্ট করে বলে তার বদনাম প্রায়ই শোনা যায়।  তার ছাওয়াল এমনটা করবে তা ভেবে অবাক হবার কিছু নেই! অবাক হবার বিষয়, নষ্ট বাওনের মন্ত্র পড়া পঞ্চগব্য কুয়োয় ঢাললে জল শুদ্ধ হবে কিভাবে! কমললতা ভেবে পায় না!

কমলতার মনে কষ্ট লাগে ঠাকুমা যখন মাকে বাউরি পাড়ার কেষ্ট বাউরিকে কলাপাতায় উঠনে ভাত খেতে দিতে বলে। কেষ্ট বাউরি ভাত খাওয়ার পর  উচ্ছিষ্ট খাবার সহ কলাপাতা তাদের বাড়ির  পূব পাশের আবর্জনার মাঝে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গোবর জল ছিটিয়ে খাবার জায়গাটা লেপে দেয়,  তা ঠাকুমার মন:পুত না হওয়ায় মাকে আবার জায়গাটা ভাল করে নিকিয়ে বাড়ির পাশের সিকদারদের এঁদো পুকুর থেকে ডুবিয়ে আসতে হয়।

কমললতার বেজায় হাসি পায় ওই সব অচ্ছুতদের ছোঁয়া কিছ ঠাকুমা না খেলেও কিন্তু ঠাকুমা তাদের হাতে দুধ দই, গুড় খেতে আপত্তি করে না । ঠাকুমা আখ ভাঙানো শুরু হলে মাশালের ইয়ার মন্ডলকে খবর পাঠায় সরের গুড় পঠিয়ে দেবার জন্য। কমললতার মনে হয় তার মাও যেন ঠাকুমার গোড় পাচ্ছে। কমললতার মা ,কাকি আর ঠাকুমা শামিজ পরে। সে আরো ভাবে, সে তার মা ঠাকুমার কারণে নস্ট বাওনদের সামনে শাড়ির নিচেয় ব্লাউজ পরতে পারবে না। কমললতা ঠিক করে তাকেও তার মায়ের মত শাড়ির নিচে শামিজ পরতে হবে । চারুলতা এক সেট ব্লাউজ শায়া কমললতা দিতে চাইলে তা সে নেয় না ব্লাউজ পরলে গ্রামের ছেলেবুড়ো টিটকারী দেবে আর নষ্ট বাপমায়ের নষ্ট পোলাপানের লোভনীয় দৃষ্টি থেকে তার অপাপবিদ্ধ স্তন দুটোকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই সে চারুলতাকে বলে,' আমি ব্লাউজ শায়া চাই নে। আমি মায়ের মতো শামিজই পরব।'