শিউলি ঝরা দিনে
গোধূলির
রঙ ফিকে হয়ে আসছে। অপেক্ষায় অধৈর্য সাঁঝবেলা। সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষে ক্লান্ত
অরুন আজকের মতো বিশ্রামে যেতে চাইছে। মা দুর্গা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে
গেছেন বেশ কয়েক দিন হল। তবুও নীল আকাশের বুকে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘেদের
হুটোপুটি এখনও শরতের মেদুর উপস্থিতিকে জানান দিয়ে চলেছে। বাতাসে একটা শিরশিরে ভাব।
শিউলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে এক সত্তর ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ। মাথা ভর্তি পশম সাদা চুল,
চোখে রিমলেস চশমা, পরনে সাদা পায়জামা আর শ্বেত শুভ্র পাঞ্জাবীর ওপর আলগোছে জড়ানো দুধ সাদা শাল গাছভর্তি
শিউলির সাথে মিলেমিশে যেন সুচিত্রা মিত্র-আমজাদ আলীর অনবদ্য সাঙ্গিতিক যুগলবন্দীর আর এক প্রতিরুপ। নিস্তব্ধতাও বুঝি সময়
সময় প্রবল ভাবে বাঙময় হয়। শহরের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে নিরিবিলি অপরূপ নৈসর্গিক
পটভূমিতে স্মৃতির সরণী বেয়ে অনেকটা পেছনে চলে গেছেন সেই বৃদ্ধ। এমনই শিউলির গন্ধমাখা দিন ছিল সেদিন। শেষ বার
শিউলির ইচ্ছেতে ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল অনির্বাণ। সেই লোহার বেঞ্চ এখনো আছে,
ওরা এখানে বসেছিল। শরীরের অসুস্থতা ওর চোখের দৃষ্টি থেকে
কবিতার চুইয়ে পড়া এতোটুকুও আটকাতে পারেনি। অনির্বাণের মুগ্ধ দৃষ্টি কাঁচপোকার মতো
ওর চোখের তারায় আটকে ছিল। লাজুক হেসে শিউলি বলেছিল, “এইইই, অনিইইইই, তুমি কি আদৌ আমার কথা শুনছ? কি দেখছ আমার চোখে?”। সম্মোহন থেকে জেগে উঠে অনির্বাণ উত্তর
দিয়েছিল, “তোমার চোখ। তোমার চাউনি থেকে
কবিতা ঝরে পড়ে, ঠিক যেমন
এই গাছ থেকে শিউলি। রবীন্দ্রনাথ তোমাকে দেখলে নিশ্চয়ই আরও কিছু অমর সৃষ্টি এই
পৃথিবীকে দিয়ে যেতেন”। শুনে শিউলির গালে সিঁদুরের ছোপ। “যাহ!
বেশি বেশি বলছ। তুমিও কি সুন্দর
কবিতার মতো বললে”। তারপরে
অনির্বাণের কাঁধে আলগোছে মাথা রেখে বলেছিল, “জানো?, এই গাছটা আমার নিজের হাতে
লাগানো। আমি আমার দাদুর সাথে আসতাম। দ্যাখো, কেমন বড় হচ্ছে, কেমন ফুল
ফুটেছে। অনি, একটা কথা
শুনবে?”।
“বলো,
শুনছি তো”।
“আমি চলে
গেলে, তুমি আসবে?
অবশ্য যখন অবসর পাবে? এখানে এলে তুমি আমাকে পাবে”।
শিউরে উঠেছিল অনির্বাণ,
ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল,
“অমন করে বোল না। আমি তোমাকে নিয়েই আসব। শিউলির
গন্ধ আর তোমার চোখ থেকে ঝরে পড়া কবিতাদের আমি একসাথে চাই”।
নাহ! শিউলি চলে গিয়েছিল সেই নীল পাহাড়ের দেশে, যেখান
থেকে আর কেউ ফিরে আসে না। পেছনে ফেলে গিয়েছিল অজস্র মুহূর্ত,
রিনিঝিনি কবিতা, সেতারের মূর্ছনা আর এক নিরুচ্চার শিউলি-শুভ্র প্রেম। পরম মমতায় গাছটার গায়ে হাত রেখে শিউলিকে অনুভব করে চলেছে অনির্বাণ,
নীরব থেকেও অনর্গল কথা বলে চলেছে। একমুঠো ফুল আলতো করে হাতে
নিয়ে আর এক হাত দিয়ে ওদের আদর করল।
“দাদুসোনা, এবার যাবে না? ঠাণ্ডা
পড়ছে। তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে ”
হারিয়ে
গেছিল অনির্বাণ, ওর মন
পারিপার্শ্বিক সব কিছু থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। নাতনী রুমঝুমের ডাকে সম্বিত
ফিরল। সম্পর্কে নাতনী আসলে ওঁর প্রাণের সখী যার কাছে সব উজাড় করে বলা যায়। রুমঝুম
ওর দাদুসোনার আবদার রাখতে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দেরাদুনে এসেছে,
যেখানে ওর দাদুসোনার শিউলি শেষ এসেছিল।
“তোমার
চোখে জল, দাদুসোনা। তুমি কাঁদছ?”।
তাড়াতাড়ি
শালের খোঁটে জল মুছল বিব্রত অনির্বাণ। রুমঝুম খুব কাছে এসে দাদুর বুকে হাত রেখে
নরম করে বলল, “আর একটু
থাকবে? আমি বিরক্ত করলাম?”
পূর্ণ
দৃষ্টি মেলে তাকাল অনির্বাণ। কি অদ্ভুত! রুমঝুমের চোখে শিউলির দৃষ্টি। গাছ থেকে টুপটাপ শিউলি ঝরে পড়ছে আর রুমঝুমের চোখ থেকে কবিতা। সম্মোহিতের মতো
মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছু পল কবিতা পান করে অনির্বাণ সস্নেহে বলল,
“নারে, এবার চল। কাল সকালেই তো আমাদের ফ্লাইট। তোকে জয়েন করতে হবে”। নাতনীর
কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অনির্বাণের মনে হল শিউলিকে সাথে করে ও জীবনের পথে
ফিরছে।