গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ভোপাল, হ্যান্টেড কাহিনী--১৫


ভূতুড়ে হাসপাতাল

পাঁচতলা, ইন্দিরা গান্ধী সরকারি হসপিটাল। এটা নাকি ভোপালের ভূতের হসপিটালের ঠিকানা ! এই পাঁচ তলায় ভূত ছাড়া অন্য কারো প্রবেশের অধিকার নেই। পাঁচ তলায় অসুস্থ হয়ে কিছু ভূত নাকি ভর্তি হয়ে আছে। ওখানে ডাক্তার ভূত, নার্স ভূত, ওয়ার্ড বয় ভূত আর রোগীরা যারা বেডে শুয়ে আছে তারা সবাই এক একটা ভূত ! ব্যাপারটা কি আশ্চর্যের, তাই না ? তবু হসপিটালের জ্যান্ত মানুষগুলির বেশীর ভাগের রায় হল, ব্যাপারটা সত্যি !
উঁচু বিল্ডিং হসপিটালের। এখানে চারতালা পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে কর্মরত কিছু ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী এঁরা তো আছেনই। পেসেন্টের প্রায় সবকটা বেডই বলতে গেলে ফুল থাকে। তবে এ রোগীরা সবাই কিন্তু জ্যান্ত মানুষ। ঘরে বেশ অসুস্থ হয়ে যখন বেসামাল হয়ে পড়ে তখনই মানুষ বাধ্য হয়ে হসপিটালে গিয়ে ভর্তি হয়। অমূল্যও এমনি অসুস্থ অসহায় হয়ে বাধ্য হয়েই এই হসপিটালে এসে ভর্তি হল। চারতালার একটা মাত্র বেড তখন খালি ছিল। সেখানেই সে স্থান পেল।
আজ পাঁচ দিন ধরে এখানে অমূল্য ভর্তি আছে। এখন সে একটু সুস্থ আছে, একটু আধটু চলাফেরা করতেও পারছে। ভূতের ব্যাপারটা ও শুনেছে। ও মানে, ভূত আছে বলে। যদিও ও নিজের চোখে কোন দিন কিছু দেখেনি। মনে মনে ভয়ও সে পায় কিন্তু তার চেও বড় কথা, সে একবার নিজের নজরে ভূত দেখতে চায়। সে শুনেছে, ভূত দেখতে পাবার নাকি একটা সময়-ক্ষণ থাকে। আবার সবাই নাকি এ সব দেখতেও পায় না। এ জন্যে বিশেষ বিশেষ রাশির দরকার হয় ! এ সব কিছুই তার শোনা কথা। এই হসপিটালের লিফ্ট আছে কিন্তু তা পাঁচতালা পর্যন্ত ওঠে না। চারতালা পর্যন্ত গিয়ে তা নাকি আপনি আপনি বন্ধ হয়ে যায় ! ভয়ের ব্যাপারটা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছে। ওরা জানে, কোন অলৌকিক শক্তির সংস্পর্শে এসে এখানকার পাঁচতলা সাধারণ মানুষের অগম্য হয়েছে।
গত চার-পাঁচটা রাত সে অসুস্থতার জন্যেই হবে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। আর জেগেছে সেই ভোরে।  আজ রাতে তার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। রাত এগারটা বেজে গেল। চারতলার বেডে শুয়ে আজ অমূল্য পরিষ্কার শুনতে পেলো ওপরে পাঁচ তলায় কেউ যেন কাঁদছে। কেউ কাতর ভাবে কেঁদে যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছিল তার শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে !
হ্যাঁ, স্ট্রেচার টানার, বেড সরানোর শব্দ হচ্ছে, ওপরে কেমন একটা ব্যস্তসমস্ত ভাব মনে হচ্ছে। নার্সের, ডাক্তারের, ওয়ার্ড বয়ের কথাবার্তার অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে। অমূল্য নিজের ওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল। না, কেউ জেগে আছে বলে মনে হচ্ছে না। এমন কি তার ওয়ার্ডের জুনিয়ার ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় অনেকেই টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। এক জন ঢুলু ঢুলু চোখে  ঝিমিয়ে যাচ্ছে।
অমূল্যর কি মনে হল, ও তার বেড থেকে ধীরে ধীরে নেমে দাঁড়ালো। না তার শরীরে দুর্বলতা এখন নেই বললেই চলে। ও আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। না, কেউ তাকে দেখতে পায়নি। এবার সে দরজা পেরিয়ে লনের সামান্য দূরের এক কোনার সিঁড়ির ধারে গিয়ে পৌঁছল। চারদিকে মাঝ রাতের নির্জনতা ছেয়ে আছে। বাইরের আলোটা বেশ কম পাওয়ারের হবে। যেন আলো অন্ধকারের মধ্যে জাগা করে নেবার লড়াই চলছে ! হঠাৎ ওর নজরে এলো একটা ছায়া  ওর ওয়ার্ডের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। অমূল্য থমকে গেলো। তবে কি পাঁচতালা থেকে ভূতেরা চারতালাতেও এসে পড়ে ! ও এবার ছায়ার দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো। কিছু সময় ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হল না। তবে মনে হল, ভূত না, ওর ওয়ার্ডের একটা পেসেন্ট, তার নামও সে জানে, পরিমল। সে হয়ত বাথরুমে গিয়ে ছিল। তবে ওয়ার্ডের ভেতরে টয়লেট থাকতে পরিমল বাইরে গিয়ে ছিল কেন ?
অমূল্য আবার পাঁচতালায় ওঠার সিঁড়ির কাছে ফিরে গেলো। কান পাতলো, ওপরের হালচাল বোঝার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, এখনো শব্দ হচ্ছে, আগের মত এত শোরগোল না হলেও কথাবার্তা, পায়ের ধুপধাপ শব্দ, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টের বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে !  
ধাপে ধাপে ওপরে উঠে যাচ্ছে অমূল্য। মনে ভূত দেখার আগ্রহ থালেও ধীরে ধীরে ভয়ে ভয়ে ও ওপরে চড়তে লাগলো। ভূত দেখাটাও কি ভাগ্যের ব্যাপার ? না কি দুর্ভাগ্যের ? জানে না অমূল্য। তার বহুদিনের ইচ্ছে আজ বুঝি পূরণ হতে চলেছে ! তার মনে হচ্ছিল যে আজ দূর থেকে হলেও ভূতের দর্শন করতে হবে।  
হ্যাঁ, এখনো চারটা স্টেপ আছে ফিফ্থ ফ্লোরে পা রাখতে। ও দেখতে পেলো এখানেও আলো আছে। যদিও আবছা আলো-ছায়া মিলেমিশে এখানের খেলা করছে যেন ! একটা ভৌতিক পরিবেশই বটে ! আরে ! ওই তো একটা স্ট্রেচার যাচ্ছে না ? হ্যাঁ, তাতে সাদা কাপড়ে জড়ানো পেসেন্ট আছে মনে হচ্ছে। তবে কে সেটা ঠেলে নিচ্ছে তা ভাল দেখা যাচ্ছে না। চোখ দুটো হালকা কচলে নিলো অমূল্য। বোধ হয় আরও পষ্ট ভাবে দেখতে চাইলো সে। ও দেখল, হ্যাঁ, আছে একটা লম্বা মনুষ্য আকৃতির ছায়া, স্ট্রেচার ঠেলে নিচ্ছে। ঘটঘটাঙ ঘটঘটাঙ কানে আসছে স্ট্রেচার চলার আওয়াজ  !
অমূল্য এগতে পারবে কিনা জানে না। আর এগোনো কি উচিত হবে ? তবু সাহস নিয়ে সিঁড়ির ধাপ শেষ করে পাঁচতালার ফ্লোরে পা রাখল। এবার পা টিপে আরও কয় পা সে এগিয়ে গেলো। খোলা দরজা দিয়ে রোগীর কেবিনের স্তিমিত আলো দেখা যাচ্ছে। অমূল্যের কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর ঘোর লাগছে ! সম্পূর্ণ চেতনা যেন তার মধ্যে ছিল না ! সাদা কাপড়ে ঢাকা বেডগুলি তার চোখে পড়ছে। হঠাৎ এক জন রোগীকে  তার বেড থেকে মাথা তুলতে দেখল সে। কিন্তু একি ! এ যে একটা কঙ্কালের মাথা ! আর হঠাৎ কোত্থেকে জোরালো একটা আলো এসে কঙ্কালের মাথার ওপর ফোকাস ফেলল। উজ্জ্বল সে ফোকাস আলোয় অমূল্য মুহূর্তের জন্যে দেখল, কঙ্কালের মুণ্ডটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে ! এবার হঠাৎ আশপাশের সমস্ত আলো নিভে গেল। চারদিকে ঘোর অন্ধকার।  এমনটা কেন হচ্ছে ? আমূল ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে !  তারপর ঠাস একটা কান ফাটা আওয়াজ হল। সে দেখল, হাসপাতালের, আশপাশ লোকালয়ের সব আলোগুলো এক সঙ্গে দপ করে নিভে গেলো ! অন্ধকার, চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। অন্ধকারের মাঝে করা যেন হি হি, হা হা, হো হো করে হেসে উঠলো। তারই মাঝে কে যেন চীৎকার করে উঠলো, কে, কে, কে...? এমনি ইকো সাউন্ডের মাঝে অমূল্য জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
পরদিন নার্স, ওয়ার্ড বয়েরা অমূল্যকে অজ্ঞান অবস্থায় পাঁচ তালা থেকে নামিয়ে আনল। ২৪ ঘণ্টা পরে তার জ্ঞান ফিরল। পাঁচ তলায় সে যে গিয়েছিল তা তার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। সে সেখানে কেন গিয়ে ছিল ? সেখানে সে কি দেখেছে ?
এসব প্রশ্নের উত্তর যেন সে নিজেই খুঁজে পাচ্ছিল না !
এরপর সাহারা নিউজ থেকে রিপোর্টারের দলবল এলো। হাসপাতালের পাঁচ তলায় সত্যি ভূত আছে কিনা তারা তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করল। সন্ধ্যে থেকে রাত একটা পর্যন্ত থেকে তারা হাসপাতালের পাঁচ তালায় অলৌকিক অস্তিত্বের কিছুই উপলব্ধি করতে পারলো না। তা হলে কি সত্যি সেখানে ভৌতিক কিছুই নেই ? হসপিটাল কর্তৃপক্ষ  তবে কেন পাঁচ তালার সবকটা রুম শিকল-তালা দিয়ে বন্ধ রেখেছে ? হসপিটালের কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীদের বেশীর ভাগের মত হল, সাহারা গ্রুপের নিউজ রিপোর্টারের দলবল দেখে ভূতেরা ভয় পেয়ে গিয়ে থাকবে  !