গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

সুজনা চক্রবর্তী



চড়ুইভাতি

শীতের আমেজ পড়তেই চড়ুইভাতির সাড়া পড়ে যায় , বছর শেষে এসে প্রাণ খুলে হৈচৈ , বাচ্চাদের পরীক্ষাও শেষ পড়াশোনার চাপটাও  কম তাই একটু রিলাক্স মুডে কিছুটা মুক্তি খোজে । এই ইচ্ছেটা আজ প্রায় নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । প্রতি বছরই দল বেঁধে সব্বাই ! আজকের দিনে তো ব্যাস্ততার পাকেচক্রে মানুষের সাথে মানুষের হৃদয়ের আবেদনটাই গেছে কমে, সেদিক থেকে দেখলে এর একটা সামাজিক মূল্যবোধ অস্বীকার করা যাবে না । প্রত্যূষ সেন তাই এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাচ্ছেন মনে প্রাণে, তাঁকেই ব্যবস্থাপক করে চলে আসছে প্রতিবছরের আপিস পিকনিক , কোন একটা সুন্দর স্পটে , বেশি দূর না এই কাছাকাছিই, একদিনের দূরত্বে যেকোন একটা জায়গায় । আজ প্রায় দশ বারো বছরের পুরনো হয়ে গেল তাদের পিকনিক প্রোগ্রাম ।

এই বছরের প্রোগ্রামেও তিনিই মূল কর্ণধার। অংশগ্রহণকারির তালিকা থেকে , খাবারের মেনু , স্পট, সময়, ঠাকুর, কুকুর মায় সমস্ত বিষয়টাই তাঁকে প্রায় একার উদ্যোগেই করতে হচ্ছে । যদিও অরুণ ভাদুরী, সুলক্ষণা খাস্তগির, মলয় বিশ্বাসরা সাথেই আছেন কিন্তু প্রধান হোতা "মাননীয় শ্রীযুক্ত প্রত্যূষ সেন মহাশয় সমীপেষু "। সবাই তাই একবাক্যে প্রতিদিনই অফিসের শুরু থেকে শেষ "প্রত্যূষ দা" আর "প্রত্যূষ" চিৎকারে মাতোয়ারা । কি ,কখন, কবে, কোথায় প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করেই চলেছে স্টাফেরা , আর প্রত্যূষ সেন অমায়িক বদনে ঝড় সামলাতে ব্যতিব্যস্ত, কোন ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, বিরক্তি নেই, আক্ষেপ নেই । দত্ত সাহেব বিষয়টা জানেন, তাই ইয়ারকি করেই বলেন "যদি প্রত্যূষ বাবুর কাজের প্রতি এর সিকিভাগ মমত্ব থাকতো তবে আমার জায়গা অফিসের বাইরের দিকেই হয়ে যেতো "।

এ হেন প্রত্যূষ সেন মহাসমারহে মহা সমাবেশে এইবার চললেন ব্যাটেলিয়ন নিয়ে অজিত সিংহের গ্রামের বাড়িতে । মেদিনীপুরের কাঁথি অঞ্চলের মানুষ তিনি, তবে আপাতত গ্রামের বাড়িতে কেউই থাকেনা, শুধু একজন কেয়ারটেকার ছাড়া। সেইই বাড়ির যাবতীয় পরিচর্যা করে থাকে । তার কাছে অজিত সিংহই সব নির্দেশই দিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু অজিত এবারের পিকনিক এ উপস্থিত থাকবেন না, তাঁর স্ত্রী হঠাৎই অসুস্থ  হয়ে পড়ায় ।

যাই হোক যথাবিহিত যথাদিনে যথাসময়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন, প্রায় একশত জন মানুষ, স্টাফ এবং তাঁদের পরিবার পরিজন সমেত । অজিত সিংহের কেয়ার টেকারই সমস্ত দোকান  বাজারের ব্যবস্থা করে রেখেছে, তাই আর মালপত্তর লটরপটর বেশি নেই, সবাই মিলে উপস্থিত হওয়াটাই এখানে মোদ্দা ব্যাপার । এবারের পিকনিক পর্ব দুইদিন ধরে, শনিবার আর রবিবার, তাই শনিবার খুব ভোরের ট্রেনে সবাই । হৈচৈ, গান, গল্পের খোশমেজাজে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে, সবার চোখে মুখে বাঁধন ছেড়া পাগলপারার উল্লাস , যা প্রতিদিনের চেনা মানুষটাকে একদমই অন্যভাবে চিত্রিত করছে । গন্তব্য যতো এগিয়ে আসতে লাগলো আকাশ অন্ধকার ভেঙ্গে আলোর বন্যা বইয়ে দিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে হুড়মুড় , আর মানুষগুলো খুশিতে তালে তাল রেখে ডগমগ হয়ে উছলে পড়ছে ।

যথাসময়ে কাঁথি স্টেশনে ট্রেন, কেয়ার টেকার নাথু নির্ধারিত লাল গনগনে আগুনের মতো একটা জামা গায়ে নির্দিষ্ট জায়গাতেই নিবিষ্ট মনে অপেক্ষমান, সবাইমিলে তাকে অনুসরণ করে মিনিট পাঁচেক হাটতেই একটা সেকেলে পেল্লায় বাড়ি ! ইয়া বড়ো ঠাকুর দালান ! বড় বড় থামে সুন্দর কারুকাজ করা বিশাল সব ঘর ! মস্ত একটা হলঘর, সংলগ্ন বারান্দা, তারপর উঠান, একপাশে ছোট ছোট ঘর বেশ কয়েকটা, ওগুলো নাকি দাসদাসীদের জন্য ! দেওয়াল জুড়ে দামী ফ্রেমে বাঁধানো বিরাট আকারের পূর্বপুরুষের ছবি! পুরনো দিনের মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র! একটা বিশাল দম দেওয়া ঘড়ি , এখনও সঠিকভাবে টাইম দিয়ে যাচ্ছে ! উঠানের পরে একফালি বাগান, হরেকরকম ফুলের রঙিন ছবিতে, অনেক পাখির কলকাকলিতে । পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি, পরিপূর্ণ, রম্য  পরিবেশটা নাথুর তত্থাবধানে। বাড়ির আকার আকৃতি দেখে সবারই চোখ ছানাবড়া, বোঝাই যাচ্ছে অজিত সিংহের পূর্বপুরুষরা এককালে জমিদার, কিম্বা রাজার কর্মচারীটারি ছিলেন।যেমনটা গল্পে নাটকে দেখা যায় শোনা যায় প্রায়শই, কিন্তু বাস্তবে কল্পনাতীত।  

প্রত্যূষ সেনের সাগরেদরা আগেই সব ব্যবস্থাপনা করে গিয়েছেন, সেই মতো যে যার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেই চলে যান সানবাঁধানো প্রশস্ত দীঘির জলে হাত মুখের ধৌত করতে, শহরের মানুষের কাছে খোলামেলা ভাবে স্নান করতে অসুবিধা হলে বাড়ির ভেতরে যে কলঘর আছে সেইখানেই ছুটল বাকি সবাই । একবারে চটজলদি, তারপর হলঘরে শতরঞ্জি পেতে প্রাতরাশ । ফুলকো লুচি আর শীতের নূতন আলুর কষা, সঙ্গে এই অঞ্চলের মিষ্টি, যেমন স্বাদ তেমনি গন্ধ, আহাহা ! আহার তুমি এমনটা কেন নয় রোজ রোজ !

এরপরেই ছুটলো ছাড়া গরুর দল চরে বেড়াতে দলবদ্ধভাবে । সব পাখির মতো পাখা মেলে নীল আকাশের মেঘের সাথে । কেউ কেউ তাশ পিঠোচ্ছে আমোদে আহ্লাদে, কোথাও চলছে খোশমেজাজে খোশগল্পের মজলিস, সঙ্গে গান, বাজনা, কবিতা, বাহ সে এক দারুণ পরিবেশ প্রতিদিনের যাপনের ছক পাল্টে । বাড়ির আর এক দিকে রান্নাঘরে নাথুরাম সর্দার তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে, এলাহি ভোজ বাঙালি কায়দায় । ভাত, ডাল, বেগুনি, শুক্তো, মাছের মুড়োর ঘন্ট, ধোকার ডালনা, মাছের কালিয়া, পাঠার মাংস -- সে এক মহাযজ্ঞ । চিৎকার চেঁচামেচি হৈহট্টগোল মিলিয়ে আমরা সবাই রাজার দেশে ।
দুপুরে জম্পেশ করে খানাপিনা করে আবার আড্ডা, ঘোরাঘুরি, তারপর বিকাল গরিয়ে রাত । যে যার নির্দিষ্ট বিছানায় শুয়ে দেদার গল্প রাত দুটো পর্যন্ত, টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয়, বা মোমবাতি মিছিলে। ছোটদের আর মেয়েদের আলাদা বিভাগ, আর বড়দের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা সহ অন্য ঘরে আলাদা বিভাগ । রাত গভীর হলে সব্বাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিঃসাড়ে, অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে ঘরের বাইরে বাড়িরটার পিছনের বাগানে নিঝুম দ্বীপে। মাঝে মাঝে রাতচড়া কোন পাখির ডাক, কোন সরীসৃপের ঘষে ঘষে চলে যাওয়া, কিম্বা কোন চারপেয়ের ছুটে চলা। জোনাকির রিমঝিম আলো। অনেক গাছের মাথা ছুঁয়ে একফালি চাঁদ লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। ফুরফুরে বাতাস বইছে ঘন অন্ধকারের মধ্যে, ঘরে অনেক মানুষ শুয়ে আছে তাই শীতের রাতেও জানালাটা খুলে রাখা হয়েছে সাপোকেশনের ভয়ে । থমথমে পরিবেশ । সময় বয়ে যাওয়া নিশিরাত, বাঁকা চাঁদ আকাশে ।

বড় ঘরির বিকট শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান সময় জানিয়ে যাচ্ছে প্রতিটামূহুর্ত । ঠান্ডাটাও জমিয়ে দিচ্ছে হাত পা, গুটিসুটি মুড়ি দিয়ে সর্বাঙ্গে সবাই নিথর, নিস্তব্ধ । তারপর কখন পাখির ডাকের সাথে জানালা দিয়ে নূতন সকাল, নরম আলো কুয়াশা কেটে কেটে, উষ্ণ ওমে ছুঁয়ে দিয়ে । গাছপালা সব ঝাপসা হয়ে চোখের সামনে । রে রে করে উঠে পড়ল সব্বাই, কেউ একটা পলও নষ্ট করতে চায় না, আজ বিকেলেই ফিরে যেতে হবে তাই যতক্ষণ যতটুকু আনন্দ পারে ব্যাগ ভরে নিয়ে যেতে চাইছে ।

যে যার মতো পালা করে প্রাতকৃত ও স্নানাদি সম্পূর্ণ করতে করতেই হাজার গল্পের মধ্যে ভেসে যেতে লাগল । কথার যেন ঢেউ জেগেছে, কে জানে কেন কখন কে অম্লানবদনে কি বলে উঠলো তো আর একজন উল্লাসে গেয়ে উঠল গান 'তারেনানানানা'। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একসাথে ভেসে যাচ্ছে আবেগের বশে, নির্মল আনন্দের অন্তরঙ্গ সম্পর্কে । বেচারা নাথুরাম সাঙ্গপাঙ্গ সাথে নাজেহাল, দফায় দফায় ফরমায়েশি পালন করে চলেছে নির্দ্বিধায়, সহস্র হাতের তাগদ নিয়ে, 'সিংহী বাবুর আপিসের লোক বলে কতা, তাদের আপ্যায়নের ত্রুটি হলে কি রক্ষা আছে বাপু '!

এক দারুণ ভালোলাগা আমেজ জড়িয়ে সবাই যখন খুব খুশিতে ভরে ফিরে আসার সময়ের অপেক্ষায় মন মেজাজ খারাপ করে বিষাদ সুরে আচ্ছন্ন, খাবার জন্য চটজলদি করতে থাকে, খাওয়ার পরেই রওনা দেবার তোড়জোড় ভাবনায় , গোলটা বাঁধে ঠিক তখনই । হুড়মুড় করে  ঢুকে পড়ে এক দঙ্গল অপরিছন্ন ছোটলোকের বাচ্চা । সবার চোখে তীব্র ক্ষিধের ক্ষোভ, জীভ দিয়ে অমৃতের স্বাদ পাওয়ার অদম্য বাসনায় কেবলই চেটে যাচ্ছে ঠোঁট, চোখে পিঁচুটি , দাঁতে লাল ছোপ, উষ্কখুষ্ক চুল তেল ছিড়ুনিহীন , মুখের প্রতিচ্ছবিতে শতাব্দীর তৃষ্ণা, ছেড়া জামাকাপড়, গ্রামের হাভাতের দল। সমস্ত অঞ্চলটা ভরে যাচ্ছে বিশ্রী দুর্গন্ধে! নাক টিপে ধরে যে যার । যারা খেতে বসেছিল সবেমাত্র প্রথম ব্যাচের জন্যে সব্বাই তড়িঘড়ি উঠে পড়ে পালিয়ে বাঁচে সাত তাড়াতাড়ি ।

বাচ্চাগুলো কাল থেকেই ঝোপের আড়ালে বসে অপেক্ষা করতে করতে লক্ষ্য করছিল ব্যাপারস্যাপার , লোভী মনটাকে পারেনি সামলাতে আর । পাশের গ্রামের ছেলে মেয়ে সব, খুব গরীব , মায়েরা লোকের বাড়িতে কাজ করে, আর বাবাগুলো দিন মজুর, কখনো কাজ থাকে কখনো থাকেনা, রোজগারের কোন উপায় থাকে না। যাদের সাধ্যতে কুলায় তারা মহকুমা শহরে চলে আসে কাজের সুযোগ সুবিধার জন্য, কিন্তু সেখানেও বা কোথায় কাজ!  থমকে যায় জীবন যাপন ।

ফল যা হবার তাই, আর্ধেকদিনই আধ পেট খেয়ে কিম্বা না খেয়েই থাকতে হয় । কখনো সখনো কেউ খাবার দিলে পেট ভরে, না হলে কেবলমাত্র জল খেয়েই ! তাই বাচ্চাগুলো চলে আসে গ্রাম ছেড়ে, সারাদিন ঘুরে ঘুরে খুটে খায়, তারপর রাতে ফিরে যায় গ্রামের মানুষ গ্রামেই, আর এ বছরের বন্যা পরিস্থিতিতো ওদের অবস্থা আরও সঙ্গিন করে দিয়েছে । নাথুরাম আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা পাহাড়ায় ছিল কাল থেকেই , ওদের চোখ এড়িয়ে তাই বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। কিছুক্ষণের জন্য ওরা একটু অসাবধান হতেই ব্যাস তক্কে তক্কে থাকা ছেলের পাল এক্কেবারে উঠোন বারান্দা পেরিয়ে হলঘরের সামনে হাজির, যেখানে সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা ।

আর এসে পড়তেই হুলস্থুল ! সব যেন দেখামাত্রই আর্তনাদ করে উঠলো ভয়ে বিপর্যয়ে! বাচ্চাগুলোও থ মেরে গেছে ভয়ে, দুদিন ধরে শহরের বাবুরা এসেছে এখানে মজা করার জন্য, কত্তো কত্তো ভালো ভালো খাবার খাচ্ছেন, তাই এসেছিল যদি কিছু খাবার খেতে পারে ! কিন্তু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এখন না পিটুনি খায় এইবার, কিম্বা পুলিশের হাতে তুলে দেয় চোর বলে । স্টাফেরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সব হলঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে থাকে ঠ্যালাঠেলি করে , আর ছেলেমেয়েগুলো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে আড়ষ্টতায়, ভয়ে, সংকোচে,লজ্জায় । কোথা থেকে যে কি হয় ?

কোত্থেকে নাথুরাম ছুটে আসে লাঠি হাতে সঙ্গে তার বিশ্বস্ত সাগরেদরা, হেই হেই করে এই বুঝি বাচ্চাগুলোকে --- দুই একজনকে কান ধরে হ্যাঁচকা টানে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে একবারে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে,বাচ্চারা বুঝি মরেই যাবে এইবারে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে কি যে করছে নাথুরাম! আর এক বাড়ি মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবলই দেখে যাচ্ছে সবকিছু বিরক্তিকর চোখে মুখে, ঘৃণার অভিব্যক্তিতে । ওদিকে পাতের উপর খাবার উন্মুক্ত, দুই একটা মাছি সুযোগ বুঝে রসাস্বাদন করছে আর চক্কর দিয়ে ভোঁ ভোঁ আওয়াজে সঙ্গত করেই যাচ্ছে । একেবারে তুলকালাম লঙ্কাকাণ্ড !

প্রত্যূষ সেন কোথায় যেন ছিলেন, চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পড়িমড়ি ছুটে এসে অবস্থা দেখে হতভম্ব, ভিরমি খাওয়ার যোগার, হঠাৎই সম্বিত ফিরে এলে চিৎকার করে ওঠেন তিনি গলা ফাটিয়ে, "এই হতভাগা নাথুর বাচ্চা না বাচ্চা, কি করছিস কি? মরে যাবে যে শালার বাচ্চারা, থাম, থাম, থাম এই লগে, কি হয়েছে কি ? ওরা করেছেটা  কি ? দে, দে ওদের ছেড়ে দে । তোদের কি মায়াদয়া বলতে কিচ্ছুই নেই ? আর এতোগুলো মানুষ কি সব বোবা বুদ্ধু নপুংসক ! দাঁড়িয়ে আছে আর মজা লুটছে ? শহরের মানুষের মানসিকতা কি মরে গেছে, অন্ধ হয়ে গেছে ? " সবাই গলা মিলিয়ে ওঠে এবার একে একে, থেমে গিয়ে নাথুরাম বাচ্চাদের নামে নালিশ জানাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, প্রত্যূষ সেন থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর দিকে, সাগ্রহে জানতে চান তাদের কথা ।

এতক্ষণে একজন সহৃদয় মানুষকে পেয়ে কেঁদে ফেলে সবকটাই একসাথে । তিনি মাথার চুলে আঙ্গুলের আলতো কেলি করতে করতে বললেন, "কাঁদলে কি করে জানা যাবে কি চাও হে তোমরা, চুরিটুরি করতে আসোনিতো বাপেরা "? একটা ছেলে আমতা আমতা করে স্বীকার করে সবকিছু, কিভাবে তারা কাল থেকে অপেক্ষা করছে, কিভাবে ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে, কেনইবা ঢুকেছে সব সব, সে আর এক গল্প ! সব শুনে প্রত্যূষ সেন সবার সঙ্গে একটুখানি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, আজ আমাদের ফলারের চড়ুইভাতির আয়োজন হোক, আর যা যা রান্না হয়েছে গ্রামের দুঃখি মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে । আমাদের সাথে সাথে ওরাও একদিন পিকনিক করুক তবে এইবেলা, পেট ভরে খেয়ে যাক ভালো ভালো খাবার, মনে রাখুক শহুরে বাবুদের। সব্বাই একসাথে তালি দিয়ে উঠল প্রাণ খুলে একটা আনন্দের ময় দিনের সাক্ষী হয়ে। বাচ্চাদের ডেকে বলা হল, "যা যা ডেকে নিয়ে আয় সবাইকে বাড়ি থেকে, আজকে আমাদের বনভোজন হবে তোদের সবার সাথে "।
ঝড় থেমে খুশির  তুফান বয়ে গেল সমগ্র  অঞ্চলেই, সবাই ছুটল বাড়ি ------- 

তারপর ? তারপর সে এক অপার্থিব ভালোলাগা, মানুষ আসে আর শহর থেকে আসা মানুষদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে যায়, চোখ ছলছল করে । এ এক অদ্ভুত পাওয়া সবার কাছে, স্বর্গ কোথায় ? কেমন ? জানা নেই কারো, কিন্তু এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে মনে হলো "মাটিতে বুঝি আজ স্বর্গ এসেছে নামি" । এরপরে এক বুক ভালোবাসা ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এলো সবাই মোহিত হয়ে কাঁথি ছেড়ে, হাওড়া স্টেশনে। তুলনাহীন একটা পিকনিকের ছবি নিয়ে ।।।।।