শিরোনাম
"হ্যালো,এটা ক্লাস ফাইভের অর্ঘ্য ঘোষের বাড়ি?"
"হ্যাঁ,
আমি ওর মা, বলছি,বলুন।"
"আমি
অর্ঘ্যর স্কুল থেকে বলছি,ওর ফি বুকে কিছু প্রবলেম আছে,
আপনাকে ১২টার মধ্যে একবার আসতে
হবে।"
একটু
ইতস্তত করে ইন্দু বলল,"কাল গেলে হবে না ?
আজ ওর বাবা আউট অফ টাউন।,"
"না
না, আজই আসতে হবে, কাল সব সাবমিট
করে, রেজাল্টের কাজ শুরু হবে,না হলে আপনার ছেলের কিন্তু রেজাল্ট পেতে অসুবিধে হবে।"
"ওও, আচ্ছা আচ্ছা, আমি আসছি।"
ইন্দু
খুব তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে, তার আঠেরো মাসের
মেয়েকে সেরোল্যাক গুলে খাইয়ে,পাশের ফ্ল্যাটের মাসিমার
কাছে দিয়ে এসে, অটোর লাইনে দাঁড়াল। গুড্ডি মাসিমার কাছে
ভালোই থাকে। মাসিমা আর মেসোমশাই ভীষণ ভাল মানুষ। এক ছেলে আইটিতে আছে, দক্ষিণে সেটেলড, দুজনের একাকিত্ব গুড্ডি ভরিয়ে
দেয়। মাসিমাকে দেখলেই মেয়ের মুখে একমুখ হাসি, মেসোমশাইকে
একটু ভয় পায়, গোঁফ
জোড়া আর চশমাই কারণ বোধহয়।
এই
সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে, তার গন্তব্যের রুটের
অটো এসে গেল। অটোতে বসেও চিন্তা পিছু ছাড়ে না। সুভাষ কি বলবে আবার কে জানে? মেয়েকে কারুর কাছে ছাড়তে
চায়না একদম। মেয়েকে ছাড়া তো বাবুর চোখে
অন্ধকার। আর মেয়েও হয়েছে তেমনি, বাবা পেলে আর কিচ্ছুটি চায়না।
মাঝে মাঝেই সুভাষ বলে,' যাই বল, গুড্ডি
এসেই বাড়িটা আমাদের আনন্দে ভরে দিয়েছে, আমার কেমন এত
দিনের আটকে থাকা প্রমোশনটা টপ করে হয়ে গেল, লটারিতে
হাউসিং এর ফ্ল্যাট পেয়ে গেলাম।‘
ইন্দু
হাসে, আসলে মেয়েটা সবাইকে জাদু করেছে। কলেজ মোড় আসতেই,
অর্ঘ্যর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এসে গেল। ইন্দু সব কাজ মিটিয়ে ঘড়ি
দেখল এগারোটা পঁয়ত্রিশ,ভাবল আর পনেরো মিনিট পরেই অর্ঘ্যর ছুটি হবে, তবে
ছেলেটাকে নিয়েই যাই সাথে করে। প্রায়ই বলে 'মা, তুমি আর আমাকে নিতে আসো না। সবার বাবা মা আসে, আমার শুধু পুলকার কাকু। মাসিমার বাড়ি ফোন করল, রিং হয়ে যাচ্ছে, কেউ ধরল না। একটু চিন্তায় পড়ল,
আসার সময় অটো থেকে নেমেই ফোন করেছিল, মাসিমা
হেসে বলেছিলেন, "হ্যাঁ গো, তোমার
মেয়ে ঠিকই আছে, আমার কোলে চড়ে ঘুরে এল, তোমার মেসোমশাই তার সাথে ভাব করার জন্য ক্যাডবেরি আনতে গেছে।"
স্কুল
থেকে বেরিয়েই অর্ঘ্যর আনন্দ আর চিপসের বায়না উপভোগ করতে করতেই,
ট্যাক্সি নিয়ে তাড়াতাড়ি
বাড়ি ফিরল ইন্দু। অর্ঘ্যকে নিয়েই পাশের ফ্লাটে গিয়ে বেল বাজাল, একবার, দুবার,তিনবার,
চারবার। কোনো সাড়া নেই। এবার দরজাটা ধাক্কা দিল, ওমা দরজাটা তো খোলা,ভেজানো!! ঘরে ঢুকে দেখল ঘরে
কেউ নেই। মাসিমা,মাসিমা!! করে ডাকতে ডাকতে বেড রুমে ঢুকেই
দেখে গুড্ডি বিছানায় ঘুমোচ্ছে। একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবল, কি বেয়াক্কেলে লোক এরা বাব্বা! মেয়েটাকে একা ঘরে রেখে দুজনে কোথায় চলে
গেল?! আর কোনো দিন মাসিমার কাছে গুড্ডিকে রাখব না। মনে মনে গজগজ করতে করতেই বিছানায় এসে,
মেয়েকে কোলে তুলতে গিয়ে একটু চমকে গেল। মেয়েটা কেমন নেতিয়ে
ঘুমোচ্ছে না!! গুড্ডি! গুড্ডি! চোখের পাতা একটু নড়ল! ঢাকা চাদরটা সরিয়ে দেখল,
ডবল ডায়পার পরানো, আর সে যে ব্রান্ডের
ডায়পার পরায় সেটাও নয়! চাদরটায় একটু পটি আর রক্তের দাগ । মেয়েটার পায়েও খানিকটা মোছানো ফিকে রক্ত। কোলে
নিতেই, হাত পাগুলো ঠান্ডা ঠেকল। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল
বুক। ডান পায়ের পাশ দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। প্রচন্ড ভয়ে দুশ্চিন্তায় প্রথমে মাথা
কাজ করছিল না ইন্দুর। তারপর প্রথম যে শব্দটা মাথায় এল, সেটা
"ডাক্তার "। চিৎকার করে অর্ঘ্যকে বলল, "বাবু
লিফটে চ।" পড়িমরি করে পাড়ার ডাক্তারের কাছেগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"ওর কি হয়েছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা ডাক্তারবাবু, আমার মেয়েটা কে বাঁচান!!" ডাক্তার মেয়েটাকে পরীক্ষা করেইবললেন,'কুইক, হাসপাতাল নিয়ে যান। সাথে পুলিশকেও খবর
দিন। ইট'স দা কেস অফ রেপ।" কি কি!!. ঠিক শুনছে তো
ইন্দু? নাকি ভয়ে কানটাই খারাপ হয়ে গেল ওর। গুড্ডি,
গুড্ডি...গুড্ডি.. তখন চোখও
নাড়াচ্ছে না আর। তারপর পাড়ার কয়েকজনের সাহায্যে গাড়িতে হাসপাতাল, ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেট, পোষ্টমর্টেম এর
জন্য গুড্ডির ছোট্ট শরীরটা কোল থেকে নিয়ে চলে গেল ওরা।
তখন....
অর্ঘ্য
মায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরে ভাবছে, বোনের ঠিক কি
হয়েছে? জ্বর?
ও কি খুব পটি করছে? মা কাঁদছে
কেন?
সুভাষ
তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার জন্য প্লেনের চেক ইন এর লাইনে। তার খুব তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরা
দরকার, গুড্ডি কি 'পাপা'
'পাপা' বলে কাঁদছিল তখন? অসহায় মেয়েটার বড় প্রয়োজন ছিল তখন বাবার। সুভাষ ভাল বাবা হতে পারলনা।
ইন্দু
এক ঘন্টার মধ্যে দশ বছর বয়স বাড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে,
আমি তো ফুলপ্যান্ট পরিয়ে দিয়েছিলাম, ফুল
হাতা জামা, মোজা,এমন কি টুপি
অবধি, তবে?
তবে?... মাত্র তো আঠেরো মাস ওর
বয়স, তবে?.. কবে
যেন খবরে শুনেছিল, "দিল্লীর হাসপাতালে এক বছরের
বাচ্চার রেপের কারণে মৃত্যু!"
কাল
খবর ছিল, আজ সেটা ঘরে। কাল গল্প ছিল, আজ সেটা কঠিন বাস্তব। আজ তার বুক খালি, কোল
খালি করে চিরতরে চলে গেল,আদরের গুড্ডি।
বাইরে
তখন সংবাদমাধ্যমের ভীড়, শিরোনামের খোঁজে,
নতুন তাজা খবর পাওয়া গেছে।