হোস্টেল এইটের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ
হয়ে উঠছিল ।
ঘরে পরার চটি ,স্যান্ডেল ,বাহারের জরি দেওয়া চপ্পল ,কিটো – সব হাপিস ?
আজ এ ঘরের লোকের যায় , তো কাল
ওঘরের বাসিন্দার ।
আরে ! এত চটি
যায় কোথায় ?
দক্ষিন কলকাতার একটা পুরোনো তিন তলা বাড়িতে মেয়েদের
হোস্টেল ।কলেজ সেই সল্ট লেকে ।হোস্টেলে থাকা মেয়ের সংখ্যা এখনও কম । তাই এই বাড়িতে
এঁটে যাচ্ছে ।ডে স্কলারই বেশি ।
কিন্তু এই নির্ঝঞ্ঝাট বাড়িতে এক সপ্তাহ ধরে বড় অশান্তি ।দিন সাত আট
ধরেই মহা ফাঁপরে পড়ে গেছে মেয়েরা ।
সব রকম চটি ভ্যানিস ।মাঝে সাঝে বাথরুমে পড়ার পচা পুরোনো
হাওয়াই চপ্পল ও হাওয়া ।খালি গোবদা স্নিকার্স চুরি হয় না । ভারি সৌখীন চোর ।
সে যাই হোক , মহা
মুশকিলে পড়ে গেছে মেয়েরা ।
প্রথমে এ ওর দিকে সকালে উঠে কটমট করে তাকাচ্ছিল।বেশি
সাজুনিদের ঘরে উঁকি ঝুকি মারছিল লোকে ।তারাও খ্যাঁক খ্যাঁক করছিল খেপে গিয়ে ।
কিন্তু এই ছেঁড়া ফাটা চটিও গায়েব হতে সুরু করতেই সবার মাথায় হাত ।
একি রে বাবা ?
প্রভূত লোকসান হচ্ছে সকলের ।ঘরে পরার হোক চাই বাইরের , চটি হারালেই ত আরেক জোড়া কিনতে লাগে ।হোস্টেলে পড়তে আসা
মানুষদের কতই বাঃ পয়সাকড়ি এক্সট্রা থাকে হাতে ?
দিন সাতেক যেতে যেতে কান্নাকাটি সুরু হয়ে গেল মেয়েদের মধ্যে।
সামনের বাড়ির পুনপুনআন্টির সঙ্গে রোজ ঢুকতে বেরোতে দেখা
হয় মেয়েদের । আন্টি এক গাল হাসেন সব সময় ওদের দেখে ।ওরাও গুড মর্নিং , আফটারনুন ,
ইভনিং বলে হাসে ।
গোলগাল হাসিখুসি আন্টিকে সবারই পছন্দ ।
কলেজের বাস এসে
সকালে মেয়েদের নিয়ে যায় , আবার
সন্ধ্যেবেলায় ফেরতও দিয়ে যায় এসে ।সেই তখনই যত হ্যালো হাই ।
ইদানিং পুনপুন লক্ষ্য করছেন বাচ্চাগুলোর সব মুখ গোমড়া ।কি ব্যাপার ?
সপ্তাহ গড়িয়ে যাচ্ছে , তবু এদের মুড ঠিক হয়না কেন ?
যখনই একদল বেরোচ্ছে হয় গজ গজ করতে করতে ,ভুরু কোঁচানো ,
কপালে ভাঁজ ।
নয়ত উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে ।
আশপাশের মানুষের সাথে নো হ্যালো হাই ।
পুনপুন দেবীর কৌতূহল বেড়েই চলে ক্রমশ ।
আট দিনের মাথায় কান্নাকাটিও অ্যাড হল যখন রাগ রাগ
মুখগুলোতে , আর থাকতে
পারলেন না পুনপুন আন্টি ।একতলার গ্রিলে ঘেরা বারান্দা থেকে ডেকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন।
“ এক্সকিউজ মি, রচনা , বেবি , থোড়া ইধার শুনোগে ডিয়ার –”
এত দিনে এদের অনেকেরই নাম
ধাম জেনে গেছেন পুনপুন।কলকল করে আসা যাওয়া করা এ বাচাগুলোকে কেমন আপনই মনে হয়
তাঁর।
ওনার ডাক শুনে একটু থমকে যায় গ্রুপটা ।ওদের মধ্যে থেকে
বেবি এগিয়ে আসে মুখটা স্বাভাবিক করে নিয়ে ।
“হাঁ বোলিয়ে আন্টি ।”
“ক্যা হুয়া বেটা ? ম্য বহত দিন সে দেখ রহি হুঁ আপ লোক পরেশান হো ।হুয়া ক্যা ?”
“ আরে আন্টি , ছোটা সা প্রবলেম । ফিরভি । ছোড়িয়ে ।”
পুনপুন আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যান , “ না না
বোলতো সহি –”
এবার কটক থেকে আসা বাঙালি মেয়ে রচনা এগিয়ে আসে।
“আন্টি গো , সব্বার চটি ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে ,
সবার ।”
“চটি ? কি রকম চটি ?”
এইবার সবাই একসংগে কলকল করে এগিয়ে আসে পুনপুনদের এক তলার দিকে
।তামিল,
তেলেগু ,গুজরাটি , হিন্দি সব
ফ্লেভার মিশে গেল কলরবে ।
শুনতে শুনতে পুনপুন অস্যার্থ বুঝলেন।
ভাল চকচকে নতুন চটি ,পুরোনো ছাতাপড়া বাথরুম যাবার চপ্পল ,জরির ফুল লাগানো কোলহাপুরি ,একশ টাকা
দামের হগ মার্কেটের ফুট পাথের কায়দার বাহাদুরি –মোদ্দা কথা পৃথিবীর যত রকম চটি হয় , সবই টপাটপ
চুরি যাচ্ছে মেয়েদের ঘর থেকে । না ,
থুড়ি প্যাসেজ থেকে ।কেউ কোন
দিন ভুলে রাতে দরজার বাইরে রেখে শুয়ে পড়লেই সকালে প্যাসেজ থেকে গায়েব ।
অথচ রাতে ত বাইরের কাঠের গেট বন্ধ করে দেয় দারোয়ানজি ।তার ওপর
বাইরে কোলাপ্সিবল গেট ও আটকানো থাকে ।তবু ।
গত সাত দিনে কত চটি যে চুরি গেল! সব চে আশ্চর্য কান্ড , ছেঁড়া পচাগুলো ও যে চুরি হচ্ছে ।ও দিয়ে কার কি কাজ হচ্ছে ?
নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে মেয়েরা ।কান্না পাচ্ছে সবার ।সবাই লিমিটেড
পকেটমানিওয়ালা। বাড়িতে কে কত বার চাইবে ? কিন্তু চটিও তো না হলেই চলে না । তীব্র সমস্যা।
পুনপুন ও অবাক হলেন । তারপর বললেন , আচ্ছা একটা দিন সময় দাওনা একটু ,
আর সবাই খেয়াল করে রাতে চটি ঘরে ঢুকিয়ে
রেখো ।
মেয়েরা গুনগুন করতে করতে বাসে উঠে গেল ।
পুনপুন বাড়িতে ঢুকে কাজের মেয়েকে বললেন আজ খাওয়াদাওয়া সব
দোতলার বারান্দায় দেতো বাবা ।
দোতলায় জাফরির পুরোনো বারান্দা । প্রায় বুক অব্ধি উঁচু ।
সেখানে বেতের গোল টেবিল আর বেতের চেয়ার রাখা। তাতে কেউ বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখা
যায়না । কিন্তু যে বসে আছে, সে জাফরির
ফাঁক দিয়ে বাইরেটা দেখতে পায় ।
পুনপুন আজ এইখানে থানা গাড়লেন । নজর সামনের বাড়ির দিকে ।
কিছু যদি সন্দেহজনক চোখে পড়ে ।
ব্রেকফাস্টের পর পেপারে চোখ বোলাচ্ছিলেন পুনপুন ।হঠাৎ চোখ পড়ল
সামনের দিকে ।
আরে, সুইটি না ? হ্যাঁ তো
। রচনার রুমমেট । একই ক্লাসের মেয়ে। ওদের মত অত কথা বলে না । কেমন গোঁজ হয়ে থাকে
মেয়েটা ।নতুন আসার পর একবারই ডেকে নামটা জেনেছিলেন পুনপুন। তারপর থেকে রাস্তার ও
পাশ দিয়ে হেঁটে কথা বলা এড়িয়ে যায় ।অ্যাটিচুড বুঝে পুনপুন ও আর কথা বলেন না ।
ওকে দেখে অবাকই হলেন পুনপুন । সঙ্গে একটা কাপড়ের বেল্ট
গলায় বাঁধা একটা খুদে কুকুর ছানা ।আরেক হাতে একটা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট
।সামনের বড় নোংরা ফেলার ভ্যাটটা অব্ধি এদিক ওদিক চেয়ে এগিয়ে এল মেয়েটা ।
হাতের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিল নোংরার মধ্যে। ছোট্ট কুকুর নিচে নেমে টয়লেট সারতেই আবার তাকে
তুলে নিয়ে পা চালিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সুইটি ।
হাতের পেপারটা টেবিলে রেখে এবার সিধে হয়ে বসলেন পুনপুন।
বিকেলে হই হই করতে করতে মেয়েরা বাস স্ট্যান্ডে নেমেই দেখল পুনপুন
আন্টি দাঁড়িয়ে ।
ওদের কথাগুলোকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন পুনপুন।
“সুইটি কলেজ যায়নি কেন ?”
সারাদিনের পর এমন আচমকা প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেল মেয়েরা ।রচনা বলল, “বলছে শরীর খারাপ । কিন্তু ওর ত ব্যাপার ।হয়ত ইচ্ছে করছে না , তাই যাচ্ছে না । কেউ দেখতে পারি না ওকে । ছাড়ুন ।যা খুশি
করুক । ”
“ওর কুকুর আছে তোমরা জানো ? ”
“কিইই ?”
সমবেত এক্সক্লামেশানে ফেটে পড়ল মেয়েরা ।
পুনপুনকে নিয়ে চলল হোস্টেলে । সবাই মিলে ডাকতে বিরক্ত মুখে বেরিয়ে
এল সুইটি ঘর থেকে , “ক্যা হুয়া ?”
“তুমহারা পাপ্পি কিধর হ্য সুইটি ?”
ভুত দেখার মত চমকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মেয়েটা । তারপর মারাঠি হিন্দি
ইংরেজি মিশিয়ে গালি দিতে থাকল পুনপুনকে । সবাইকে দু হাতে ধাক্কা মেরে নিজের ঘরে
ঢুকে যাবার চেষ্টা করছিল।
মেয়েরা হাত চেপে ধরে আটকে ফেলায় নিষ্ফল আক্রোশে কেঁদে ফেলল শেষে ।
পুনপুন মাথা ঠান্ডা করে এগিয়ে গেলেন ।আস্তে আস্তে বললেন, “বেটা মুঝে বোলো, ডরো নহি ,ম্য সামহাল লুঙ্গা ।”
“ক্য সামহালেগা, হাঁ ? অব বাহার
নিকাল দেগা নয়া উসে ? ইতনে গাড়ি চলতে রোড পে, রানোভার হো যায়েগি ---”
কেঁদে ফেলে বদমেজাজি মেয়েটা ।
“ কিউঁ ছোড় যাতে স্লিপার্স বাহার ?
আপনে আপনে কামরে মে রাখ নহি শকতে? ছোটে হ্য
।ইতনে প্যসা নহি হ্য মেরা কি সব কো ওয়াপাস করুঁ –”
এবার বেবি এগিয়ে আসে। বাকি সবাই চুপ করে গেছে মেয়েটার কান্না দেখে
। “কুছ প্যসা দেনে নহি হোগা ।পাগল । তুনে তো নহি চবাই না ?”
বাকি সবাই হেসে ফেলে ।
পুনপুন বলেন, “
বেটা ডগি মুঝে দে দো । মেরা উও কাম করতে হ্য বাবুয়া , বহুত দিন সে বোল রহি হ্য সেফটিকে লিয়ে এক ডগ চাহিয়ে । আকেলি রহেতি
হুঁ না । সামনেই রহেগা । জব চাহে মিলো আকে ।”
দৌড়ে এসে পুনপুনকে জড়িয়ে ধরে সুইটি । অনেক সরি বলে কাঁদতে কাঁদতে ।
সবাইর চোখে জল ।সকলের এত্ত হাগস আর আদর করার
মধ্যে রচনা একটা আমাজনের বাক্স নিয়ে আসে । সিঁড়ির তলার জিনিসপত্রের গুদাম থেকে
দারোয়ানজি খুঁজে বের করেছে একে।
গলায় সুইটির জিনসের কাপড়ের বেল্ট বাঁধা খুদে ডগি প্রানপনে ছোট্ট
ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বলে , “
ভৌ ভৌ” , আর চকচকে
চোখে এদিক ওদিক চেয়ে ভাবে , ইসশ কত্ত
চটি চারদিকে ।