গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

পদ্মাবতী রায় চৌধুরী



শূণ্য

মনিরুল গ্রামে ভাগচাষি ছিল৷ অন্যের জমিতে চাষ করত ৷ অত অল্পে সংসার চালানো বড় কষ্ট৷ । এখন সে পার্ক সার্কাসের বস্তিতে বউ ছেলে নিয়ে থাকে ৷ আর ঘরামির কাজ করে নানা জায়গায় ৷ নর্দমার উপর কাঠের পাটাতন রেখে তার দরমার ঘর ৷ এখানে বর্ষায় রেললাইন টপকে ঘরে ময়লা জল ঢুকতে থাকে ৷ নিচটুকুতে ময়লা পোকামাকড় সাপখোপ নোংরা জল ভাসতে থাকে ৷ তক্তপোষের উপরে চাদর বিছিয়ে অনায়াসে তারা মাংস ভাত রসিয়ে খায় ৷ আগে পারত না, ঘেন্নায় খাবার ভিতর থেকে উগরে আসত, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ৷ 

আজ তিনবছর ধরে যে বিল্ডিংটা তাদের কম্পানী তৈরী করছিল , চল্লিশ তলা...আজ তার শেষ ছাদ ঢালাই ৷ কত নতুন মানুষ আসবে ৷ খোপে খোপে তৈরী হবে সুখী গৃহকোণ ৷ মনিরুলদের মত ছাপোষা শ্রমিককে তখন কেই বা মনে রাখে ! বড় যত্ন করে এখানকার প্রতিটা ইঁটে তার ছোঁয়া রেখেছে সে ! কোম্পানী তাদের নুন ভাত জোগায়, তাদের ক্ষতি করবে না সে৷কাজ শেষ করেই আজ নিচে নামবে মনিরুল ৷ সকালেই বড়সাহেবের কাছে গিয়েছিল সে ,কিছু টাকা ধারের বড় দরকার ! এখন যে টাকা সহজে মিলবে না তাও বুঝে এসেছে ৷ 

এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে ৷ হাত লাগিয়ে শেষ সিমেন্টের পোঁচ মারতে লাগলো মনিরুল৷ সব ঘরামি রাজ মিস্তিরিদের মনে আজ উৎসব লেগেছে...নিচে গ্যারেজের কাছে বড় তোলা উনুনে একটু আগেই আঁচ পড়েছে, সে দেখে এসেছে ৷ ছাদ ঢালাইয়ের খাসির মাংসের গন্ধ ভুরভুর করে বাতাসে সুবাস ছড়াচ্ছে ৷ এতদিনের কষ্টের পর কত দামি লোক এসে এখানে থাকবে ৷ আবার জীবনের কত অজানা গল্প তৈরী হবে ৷ ইঁটটা গেঁথে সে দড়িতে বাঁধা ভারায় পা রাখলো...আজ অসম্ভব হাওয়া ৷ নীচ থেকে সব বলছে, - দেকে লাব মনিরুল ! এটুকু হলেই কাজ শেষ... -এ কোন ব্যাপার নয় ...এত হাজারবার উঠলাম লাবলাম...আর এটুকু হলেই তো কাজ শেষ৷ কিন্তু এত উঁচু থেকে পৃথিবীটা এত সুন্দর, এই মায়া ছাড়তে সাধ যায় ! হাত থেকে মাখা সিমেন্টের পাতিলাটা পড়ে গেলো হড়কে ৷ নীচে পড়ছে পাতিলা...আর সেটা ছড়িয়ে মাটিতে কাদার মত লেপ্টে গেলো কয়েক সেকেন্ডে ৷ একি ! এসব দেখতে গিয়ে এত অভিজ্ঞ মনিরুলেরও হিমশীতল ভয়ে পা কেঁপে যায়... সবাই আর্তনাদ করে দেখছে...এবার মনিরুল পা স্লিপ করে চল্লিশতলা থেকে সজোরে নীচে পড়ছে... আর মনিরুল শূন্যে ভাসতে ভাসতে শেষবারের মত হিসাব করে নিচ্ছে ...এখান থেকে পড়ে মরার পর কোম্পানী ছেলেকে একটা চাকরী দেবে, বৌ পাবে দু লাখ টাকা...ছোট ছেলেটার হার্টে ফুঁটো...কাল রাতে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে ৷ অপারেশনটা একসপ্তাহের মধ্যে হলে বাচ্চাটা বেঁচে যাবে... শুধু এখন একটাই আক্ষেপ...ছাদ ঢালাইয়ের মাংস ভাতটা আর খাওয়া হলো না তার...