গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭

রুখসানা কাজল



মোতি

খিদে নাগে যে। তাই বলে চলে আসবি? কেমন কথা বল তো! এই সেদিন বিয়ে করলি, আজই সব ফেলে চলে আসলি। কি যে করিস ! সর, সরে বারান্দায় গিয়ে বস। চাল ডাল মরিচ রসুন পেঁয়াজ, তেল মাখানো খিচুড়ি থেকে সুগন্ধ ছুটছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে সরে বসে মোতি। মা মিটসেফের ভেতর মাথা গলিয়ে বিস্কিটের কৌটা বের করে একটা বাটিতে ঢেলে দেয়, নে এগুলো খেয়ে গোসল করে আয়। খিচুড়ি হতে আর কতক্ষণ! মোতি দু হাতে হামলে নেয় বিস্কিটগুলো। শিশুর মত একটা হাসি ভেসে যায় ওর মুখে। শুকনো বয়সি মুখ। পুরানো জুতার মত থ্যালথেল করছে মুখের মাংস। চোখের কোণে নির্ঘুম ক্ষুধার সাদাটে দাগ। অনেকগুলো বিস্কিট মুখে পুরে মোতি আমাদের বাড়ির সভ্যতা ভুলে গবগবিয়ে বলে, সত্যি কতিছি বড়ভাবি, এজম্মে আর বিয়ে করবো না। এই খিদের কিরে ! পেটের উপর হাত রেখে ছলছল চোখে মোতি শপথ করে। মা হাসে না। গম্ভীর মুখে চুলোর কাঠ নেড়ে চেড়ে মতির গ্লাসে পানি ভরে এগিয়ে দেয়। ঠোঁটের উপর অস্বচ্ছ লোমে লেগে থাকা বিস্কিটের গুঁড়ো মুছে মোতি পানি খায়। নতুন শাড়ির কড়কড়ে আঁচলে ঠোঁট মুছে ককিয়ে ওঠে, হুজুর আমারে মারিছে। কয়িছে নাস্তিক ডাক্তারের বাড়ি থাকি তুই নাস্তিক হয়ি গিয়িছিস হারামজাদি। কি ইইই --? রহমত মেরেছে এটা সত্যি ? মোতির ফর্সা পিঠে চাক চাক দাগ। আমার মা ছোট ছোট তারার মত চোখে চেয়ে থাকে। মার চোখে বিশ্ব মা। 

মোতি এক শিশু মানুষ। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। যে বা যারা ফেলে দিয়েছিলো কাক শকুনের খাদ্য করে সেখান থেকে ওকে তুলে এনেছিল গ্রামের এক অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। কপাল জুড়ে কালো কালো কাক ঠুকরে দেওয়ার দাগ। কতবার যে বিয়ে হয়েছে বা করেছে তার হিসাব রাখা কঠিন। রহমত হুজুর একা থাকে। খাওয়া দাওয়ার বড় কষ্ট । ষাট পঁয়ষট্টি বয়সে আর শরীর কি ! একজন পরিচর্যাকারী স্ত্রী রেধেবেড়ে ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে এরম হলে চলবে এই শর্তে মোতিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চারদিন আগে বিয়ে করেছে। কারো নিষেধ বারণ না শুনে মোতি বিয়ে করেছে স্বেচ্ছায়। বড়ভাইজান ইফতার করতি আসলি একটা কথা কবো । কি কথা? ভাইজানরে কবো আপনি রোজা নামায পড়েন। কত মাইনসেরে কত উপকার করেন। রহমত হুজুরের লাহান একখান টুপি পরি ওষুধের দোকানি যাতি পারেন না। তালি কেউ আর আপনেরে নাস্তিক কতি পারবি নানে। 

এতক্ষণে মা একটু হাসে। নিভে যাওয়া চুলোর আগুনের মত দু চোখ ভরে আশ্চর্য জ্বলন রেখে বলে, ধর্ম কোনো দেখানেপানা জিনিস নয় রে মোতি। নামায রোজা হজ্জ্ব যাকাত কে কেমন করছে তা তো আল্লাহ দেখছেনই। লোক দেখিয়ে বা জোর করে ধর্ম পালন করতে, করাতে নেই। যা গোসল করে আয়। খেয়ে ঘুম দে। মোতি বিশাল দৈর্ঘ্যের সুললিত সুন্দর শরীরটা তুলে উহ করে ওঠে, তয় বড় ভাবি এটা তো সত্যি তাই না, নামায, রোজা হজ্জ্ব ,যাকাতের লাহান খিদেও আল্লাহ বানাইছে? তয়? যে পারবি সে রোজা করবি, না পারলি না করবি। আল্লাহ্ যা শাস্তি দিবার তাই দিবিনে মাইনসের এত কি ! 

আমি জুট ইজ দ্য গোল্ডেন ফাইবার অফ বাংলাদেশমুখস্থ করার ফাঁকে আল্লাহকে ডাকি, হে জগৎপিতা পরমেশ্বর, হে এক ও অদ্বিতীয় খোদা, সমস্ত শাস্তি ও পুরষ্কার দানের অধিকার একমাত্র আপনার। এ বিশ্ব আপনার সৃষ্টি। দোযখগুলোও। আর অই ইবলিশ শয়তান। যে কিনা আপনার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করার ক্ষমতা ও সাহস রাখে, আমাদের মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষ তাকে কি করে ঠেকাই! আর এই ক্ষুধা? সে তো আপনারই দেওয়া। পবিত্র এই মাগফেরাতের দশ দিনে আপনি দোযখগুলো চিরতরে গুঁড়িয়ে দিন, সব মানুষের অন্তর চিরদিনের জন্যে ভালোবাসায় পূর্ণ করে দিন। আমরা যেনো সবাই সবাইকে সাম্যে, সাধ্যে, ধর্মে, আচরণে সমানভাবে ভালবাসতে পারি। দারিদ্যের কষাঘাতে পেটপিঠ মিশে যাওয়া কল্যাণপুরের অই রিকশাচালক, কর্মক্লান্ত মানুষ যেনো এই তপ্ত দুপুরে এক গ্লাস পানি ও খাদ্য খেতে পারে ! আপনার অজ্ঞাত এবং অসাধ্য তো নয় কিছুই। হে মহাক্ষমতাশালী মহা সৃষ্টিধর, আপনাকে ভালোবেসে ডাকতে চাই। জোরজুলুম নির্যাতনে নয়। আমার মোনাজাত কবুল করুণ আল্লাহ্।