বিপদের
সময় কেউ কাছে থাকলে মনে হয় কেউ যেন আমার অসহায় অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করছে। তার সান্নিধ্যে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয় । এক তৃপ্তির
নিঃশ্বাস নিয়ে চোখের পাতা জুড়িয়ে আসে । যেন মনে হয় অনেক দিন ঘুমোই নি এবার
স্বস্তিতে ঘুমোই। আমি নিশ্চিন্ত। এবার আমার ঘুমোবার পালা
আমি যে গল্পটা বলছি এটা উড়িষ্যার বরগড় জেলার কথা । বরগড়
পশ্চিম উড়িষ্যা তে অবস্থিত এক কৃষি প্রধান জেলা। এই জেলাকে উড়িশ্যার ভাতের হাঁড়ী
বলা হয় । কারন বরগড়ে প্রচুর ধান উৎপাদন হয়।
কালিয়া-পানি
গ্রামের এক চাষি পরিবারের ছেলে সুদামা । বাবা বৃন্দাবন সাহু , মা রাধামণি সাহু। এরা দুজনেই শ্রী কৃষ্ণের ভক্ত , তাই ছেলের নাম সুদামা রেখেছিলেন সাধ করে । খুব শান্ত স্বভাবের ছেলে সুদামা । পড়াশুনো কিন্তু সেরকম করতে
পারলোনা । ক্লাস সেভেন অব্ধি পড়েই , পড়া শুনোয় ইতি । স্কুলের মাষ্টার মশাই ঠাট্টা করে বলেন, “কিরে
সুদামা তুই কৃষ্ণের দেখা পেলি নাকি ?”
না
মাষ্টার মশাই কৃষ্ণের দেখা কি অত সহজে পাওয়া যায় । তিনিত দর্পহারি
মধুসূদন । মানুষের দম্ভ কে এবং অহংকারকে শ্রী কৃষ্ণ আদৌ সহ্য করতে পারেন না । তিনি
তাই তার দর্প চূর্ণ করার প্রয়াস করেন । আমি এক অতি সাধারণ চাষি পুত্র আমাকে কি
কৃষ্ণ তাঁর সান্নিধ্য দেবেন ?
ওরে তুই ত
এই বয়েসে তত্বের কথা কইতে আরম্ভ করেছিস। সাধু সন্ন্যাসী হবি নাকি ?
সংসারে
থেকে সব দুঃখ কষ্ট সহ্য করে মানুষ ভগবৎ চিন্তায় নিমগ্ন থাকলে অতি অবশ্যই শ্রী
কৃষ্ণ প্রসন্ন হন । তাকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। সাধু সন্যসী হওয়ার প্রয়োজন কি আছে ? সব ই ত
তাঁর কৃপা । আমি সংসারে থেকেই তাঁকে মনে মনে ডাকি । তিনি যেদিন আমার ডাক
শুনবেন সেদিন আমার নাম সার্থক হবে ।
কথাগুল
মাষ্টার মশাইকে অনুপ্রাণিত করল । তিনি বলেন বাঃ । পড়াশুনো না কর ভগবৎ চিন্তায় মন নিবেশ
করেছিস । ভালো তোর মঙ্গল কামনা করি। এটা বজায় রাখিস।
সুদামা
সঙ্গে সঙ্গে ধড়াস করে মাষ্টার মশাইয়ের পায়ে পড়ে গেল। গড় হয়ে প্রণাম করল ।
আশীর্বাদ
করি ভালো থাকিস বাবা। মাষ্টার মশাই সত্যি প্রীত ।
এই হল সেই
সুদামা । সরল ভগবৎ বিশ্বাসী এক সাধারণ ছেলে । সকলকে সম্মান করে । বাবা বলেন ভক্তের ভগবান । তাকে মন প্রাণ দিয়ে ডাকলে তিনি
অবশ্যই শোনেন। তিনি ত অন্তর্যামী ! তাই না মাষ্টার মশাই ?
হ্যাঁ তোর
বাবা ঠিক কথাই বলেন। তবুও পড়াশুনোটা প্রয়োজন রে । ওটা যে বিদ্যা দেবী সরস্বতীর
আরাধনা ।
দেবী
সরস্বতী কি সবার ওপর প্রসন্ন হন মাষ্টার মশাই ! আমার ওপর তাঁর কৃপা হলনা । তাই পড়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি। আমি
কৃষ্ণ প্রেমি । তাঁর ভজন কির্তনে নিজেকে মসগুল করে রাখি। আমাদের বাড়ীতে মা বাবা আমি সকলে হরি কির্তন করি। আমাদের
হরির কৃপায় সংসার চলে যাচ্ছে । ওই পড়াশুনো আমার দ্বারা হলনা। কি করি ! সুদামা
স্কুল ছেড়ে আজ চলে যাচ্ছে । বাবার কাজে সাহায্য করবে ।
ওর বাবার
৭ একর জমি । পুরোটাতেই সেচের সুবিধা আছে। বছর কাবারি যা ফসল হয় তাদের ছোট পরিবারের তাতে হেঁসে খেলে চলে যায় । ধান , মুগ , কলাই ,সর্ষে , সূর্যমুখী , আনাজ পাতি সব ওই ক্ষেত খামার থেকে আসে । বৃন্দাবন সারা দিন ক্ষেত খামারের কাজ
সেরে সন্ধ্যাতে বাড়ি ফেরে । ধানের চাষ তাদের ভালোই হয়। সেচের সুবিধা তাই ফসল অমল
ভালো হয়। ফি বছর সুদামা বাবার সঙ্গে ট্র্যক্টারে ধানের মণ্ডিতে ধান বিক্রি করতে যায় । সরকার তাদের কাছ
থেকে ধান কেনেন । টাকা ওদের ব্যাঙ্ক এর খাতায় জমা পড়ে ।
বেশ দু পয়সা লাভ হয় । তাই দিয়ে তাদের সারা বছরের চাষ
আবাদের খরচ , সংসারের যাবতীয় সব খর্চা চলে যায়। ধান চাষের পর রবি চাষে সর্ষে , সূর্যমুখী , মুগ ,কলাই নানা রকমের আনাজ যেমন বেগুন, শসা , মূলো , টমাটো , ধনেপাতা , এ ছাড়া পটল , কুমড়ো , লাউ , ঝিঙে , করলা ত আছেই । এই সব ওদের জমিতে হয়। ফসল ভরা ক্ষেত দেখলে মনটা ভরে যায়।
সুদামা বাবার সঙ্গে ট্র্যাকটারে সবজি মণ্ডিতে যায় তরি তরকার বিক্রি করতে । জমিতেই
একটা উঁচু যায়গায় বৃন্দাবন একটা ছোট্ট পাকা ঘর বানিয়েছেন। ফসল পাহার দেওয়ার জন্য
কাজের লোক আছে । ও
মাঝে মধ্যে ওইখানে থাকে। কখন বৃন্দাবন , কখন সুদামা ওই ছোট্ট ঘরে থাকে। ঘরের ওপর সোলার প্যানেল আছে তাতেই সারা দিন যা চার্জ হয়
রাতে লাইট পাখা চলে। একটু দূরে একটা টয়লেট আছে। পাসে একটা ছোট্ট পুকুর । এই বছর
মাছের চাষ হচ্ছে সেখানে। মাছের চাষে অনেক লাভ হয়। তবে তারা ত বৈষ্ণব তাই মাছ খায় না
কি ধরে না। জেলে এসে নিয়ে যায় পুকুর থেকে । বাবার খুব একটা সায় ছিলনা মাছ চাষের
ব্যাপারে ; ব্লকের ফিশারি অধিকারি বাবাকে অনেক বোঝানোর পর বাবা অনিচ্ছা সত্যে রাজি হন।
পুকুরে রাজ হাঁস ছাড়ার ইচ্ছা ছিল আমার । মা সরস্বতীর বাহন । কিন্তু সেটা হলনা ।
পুকুরের ধারে নারকোল গাছ আছে তিরিশ টা । এই বছর ফলন হবে
। এ ছাড়া একটা আমের বাগান আছে । তাতে পঞ্চশটা আম্রপালি প্রজাতির আমের চারা লাগান
হয়েছে দু বছর আগে । বাবা নিজে লাগিয়েছেন। ড্রিপ লাগিয়ে সেচের সুবিধা করা হয়। সরকার
আম চাষের প্রসারের জন্য সার কীটনাসক সব দিয়েছেন । ড্রিপ সেচের মাধ্যমে প্রত্যেক
চারা গছে ড্রিপ লাগান হয়েছে। আমাদের নিজেদের সাব মার্সিবিল লিফট পাম্প আছে। ওই
দিয়ে আনাজ , কলা, আম , নারকোল
চাষে সেচের সুবিধা করা হয়।
চাষের
জন্য আমাদের পুরো সময়টা কি ভাবে কেটে যায় বোঝাই যায়না। সারা দিন কাজে থাকি আর
সন্ধ্যে হলে ঘরে কির্তন হয় । কৃষ্ণ নামে মুখরিত হয় আমাদের বাড়ির চতুরপার্শ । পাড়ার কিছু ভক্ত আসেন । খোল
কির্তনে কৃষ্ণ পদাবলির গান করেন মা আর পাসের বাড়ির কাকিমা সঙ্গে বাবা , আমি। এই
ভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল। আমাদের সুখের সংসার দেখে গ্রামের কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক
হিংসায় জলে। তারা ফন্দি আঁটে আমাদের সুখের কাঁটা হওয়ার ।
বাবা
কিছুই বোঝেন না । একদিন খবর আসে আমের চারা গুলো সব মরে গিয়েছে। বাবা
হন্তদন্ত হয়ে ছোটেন আম বাগানে। দেখেন আজব কাণ্ড গাছগুলো সব হলদে হয়ে গিয়েছে। অরচ
ড্রিপ চলছে। ড্রিপ চললে গাছ জলের অভাবে কখনই মরবে না । অনেক টাকা খরচ হয়েছে এই আম
বাগানের জন্য। বাবা সঙ্গে সঙ্গে হর্টিকালচার অধিকারীর কাছে নিজে জান। উনি এসে বলেন
কীট নাশকের সঙ্গে কেউ তৃন নাশক মিসিয়েছে কারন কাছেই তৃন নাশকের খালি শশি পড়ে ছিল। এমন তৃন
নাশক আছে যা গাছকে সম্পুর্ণ জালিয়ে দেবে।
এটা ত
পুলিশ কেস। নিজে অধিকার মহাশয় পুলিশে খবর দিলেন । এফ আই আর হল। অনুসন্ধান হল কিন্তু ফল কিছুই
হলনা। আমাদের মালিকে জিজ্ঞাসা করাতে সে কিছুই উত্তর দিতে পারলনা। পুলিশের জেরায় সে
নিগ্রহিত হল কিন্তু বাবা বুঝলেন আসল অপরাধী ও নয়। পুলিশের বড় কর্তাকে বলেন ওকে
মারধর না করতে । ও সত্যি নিরীহ। পেটের দায়ে আমার কাজ করছে ও কেন এসব করবে? এ অন্য লোকের কাজ।
বাবা মনে মনে ভাবেন ওই মাছের চাষে কৃষ্ণ অসন্তুষ্ট
হয়েছেন। তাই মাছের চাষ সম্পূর্ণ বন্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। এটা হয়ত মনের ভুল কিন্তু
মানুষের মন ত । কি করা যায়। মনে পাপ ছোঁয় । সকলে বোঝালেন । বাবা একবার সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন মানে আর ওই চাষে মন দেবেন না। আম গাছগুলো বাবা অনেক সখ করে লাগিয়েছিলেন ।
আমার খুব কষ্ট হল। মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর , পর শ্রী কাতর বুঝি না ! মাছ গেল , আম গেল। এরপর নারকোল চাষ !
বাবার
সখের আম বাগান নষ্ট হওয়ার দিন থেকে বাবার মনে কষ্টের শেষ নেই। তিনি মন মারা হয়ে
থাকেন। সব ই কৃষ্ণের লীলা। “আমি পাপ
করেছি মাছের চাষ করে”এটাই বাবার ধারনা। কিন্তু বৈষ্ণব রা কি মাছের চাষ করেন না ! কি জানি
হয়ত তাই। বাবা আর আগের মতন কীর্তন করেন না। এটা ভ্রান্ত ধারনা মৎস্য অধিকারী
বাবাকে বোঝালেও বাবা তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে তাঁকে হাত জোড়করে বলেন , “আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি নাচার।” অগত্যা উনি চলে যান।
মৎস্য
দফতর এবং হর্টিকালচার বিভাগ থেকে দুই অধিকারী কে কৈফিয়ত তলব করা হয়। কোন
পরিপ্রেক্ষিতে চাষি হতোৎসাহিত হয়েছেন তার সম্পূর্ণ বিবরণী দিতে। এ দিকে আমাদের
পাঁচ একর জমিতে যে ধান চাষ হয়েছিল তা সম্পূর্ণ কীট দ্বারা আক্রান্ত । কৃষি দফতরের
অধিকারীরা বলেন বাদামী পোকা আক্রান্ত ফসলে ভাইরাস আক্রান্ত করেছে সম্পূর্ণ ফসল কে।
সম্পূর্ণ ফসল জমিতে পুড়ে গিয়েছে। এর কোন প্রতিকার নেই। ঠিক সেই দিন বাবা সম্পূর্ণ
ধান ক্ষেতে আগুন জালিয়ে ফসল পুড়িয়ে ফেলেন।
বাড়িতে
ফেরেন সম্পূর্ণ আলাদা বাবা। চোখে জল । মা জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে? কোন উত্তর দেন না। সেদিন ই রাতে বাবা কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আসলে আমাদের বেশ
কিছু ঋণ ছিল ষ্টেট ব্যাঙ্কে । সুধে আসলে সেটা অনেক হয়েছিল । বাবা ফসল বিক্রয় করে
সব ঋণ শোধ করতেন কিন্তু কৃষ্ণের ইচ্ছা বাবাকে তাঁর নিকটে নিয়ে যাওয়ার ।
বাবার
শরীরে বিষ প্রক্রিয়াতে সম্পূর্ণ নীল হয়ে গিয়েছিল। সারা গায়ে কৃষ্ণ নামাবলি মুড়ি
দিয়ে তাঁর সরির মুড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ এসে পোষ্ট মটমের কথা বলাতে সারা গ্রাম
উৎক্ষিপ্ত হয়। এই নিদারুণ করুন দৃশ্যে আমি ভেঙে পড়ি । মা কান্না থামাচ্ছেন না। আমি
কি সান্ত্বনা দেব মাকে? বাবার ওই কথাটাই মনে পড়ছে ঃ “বিপদের সময় কেউ কাছে থাকলে মনে হয় কেউ যেন আমার অসহায় অবস্থা থেকে আমাকে
উদ্ধার করছে। তার সান্নিধ্যে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয় । এক তৃপ্তির নিঃশ্বাস
নিয়ে চোখের পাতা জুড়িয়ে আসে । যেন মনে হয় অনেক দিন ঘুমোই নি এবার স্বস্তিতে ঘুমোই।
আমি নিশ্চিন্ত। এবার আমার ঘুমোবার পালা ...............” ।