ব্রাত্যজনের
রুদ্ধসঙ্গীত
সেলের
বাইরে বেদী-ঘেরা এক গাছের নীচে বসেছিল রিয়াজুল । ছলছল চোখ তার । অনেকদিন বাড়ি থেকে
তাকে কেউ দেখতে আসেনি । সেই মাস খানেক আগে এসেছিলো তার বৌ । দেখেই খুব কেঁদেছিল সে
। অনেক খুনের আসামী রিয়াজুল নিজেও সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেনি । দুজনের চোখের জলে
সেদিন উদাস হয়েছিলো খুব জেল-প্রাঙ্গণ ।
একে-একে
অনেকের বাড়ির মানুষ এসে তাদের মানুষকে দেখে চলে গেলো । অনেকে আসছে । মাইকে বারবার
নাম ধরে বলছে,''আপনার ইন্টার্ভিউ আছে । গেটের
কাছে আসুন ।''
কিন্তু
রিয়াজুলের বেলায় শুধু শূন্যতা । তবু সে সজল-চোখে কান পেতে রয়েছে কখন বলে-- ''রিয়াজুল শেখ । পিতা লেট নাসির শেখ । নাকাশিপাড়া থানা । আপনার
ইন্টার্ভিউ আছে । গেটের কাছে চলে আসুন ।''
সে
আর হচ্ছে কই । দেখতে দেখতে বেলা একটা হয়ে গেলো । রিয়াজুল ভাবতে থাকলো,আজকে কি আর আসবে ? মনে হয় না । বড় অভিমানে রিয়াজুল
এও ভাবল,আর কোনোদিন এখানে কাউকে আসতে হবে না । এভাবেই তো
চারবছর কেটে গেলো এখানে । আরও কত সময় যাবে ।
এসব
ভেবে যখন রিয়াজুল উঠতে যাচ্ছে,ঠিক তখুনি মাইকে
তার নাম ঘোষণা হল । সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো । চোখের জল হাত দিয়েই মুছতে থাকলো ।
কে
এক আসামী তাকে হেসে বলল,''আমি কইছিলাম না তুমার
বিবি আইজ আইব ? দেকলা তো । যাও পরাণডা ভইরা বিবির লগে কতা
কইয়া আসো । কি কইলা আমারে বল কিন্তুক ।''
তার
কথা শুনে রিয়াজুল এক-মুখ হেসে উত্তর দিলো,''কে
আইছে কে জানে । তবে মুন বলতাছে বিবিই হইব । আসি । সব কবানে আমি তুমারে ।''
তারপরেই
রিয়াজুল দ্রুত গেটের দিকে এগোতে থাকলো ।
তারপর
দেখা হল । কিছু কথা হল রিয়াজুলের সঙ্গে তার স্ত্রী সাবিনার । কিন্তু সে কথায় আর
কতটা তৃপ্তি পাওয়া যায় ? দুজনের মাঝখানে জালের
বেড়া । ব্যবধান বেশ । সময়ও বড় অল্প ।
সাবিনা
অশ্রু-সজল চোখে রিয়াজুলকে বলতে থাকলো,''আমি
তো আগেই আসতে চেয়েছিলাম গো । কিন্তু ছেলেটার জ্বর হয়েছে । সারছেই না । হেমুডাক্তার
আর ওষুধ দিতে চায় না । দিতে চাইবেই বা কেন ? ঠিকমতো পয়সা
দিতে পারি না তাকে । দু'বাড়ি কাজ করে যা পাই,তাতে আমাদের সংসারই চলে না । তোমার মা খুব রাগ করে আমার ওপর । কষ্ট পায়
। গালি দেয় আমাকে খুব । আমি যে কি করি ।''
সাবিনার
কথা শুনে রিয়াজুল ফুঁফিয়ে উঠলো তখন ।
সাবিনার
কথাগুলো শুনে রিয়াজুল অঝোর-ধারায় কাঁদতে থাকলো ।
ঝাপসা-চোখে
অস্ফুটে বলল,''কি পাপ যে করছি আমি । আইজ বুজতে
পারতাছি । পোলাডা আমার বুজি যাইব গা এমন কইরা । গিয়া আইর দেকতি পামু না অরে বুঝি ।
আল্লারে ডাহ । তিনি যদি কিসু সুরাহা করেন ।''
আর
সামান্য কিছু কথা বলার পর জেলের এক পুলিশ এসে বলল রিয়াজুলকে,''সময় শেষ । এবার নিজের ঘরে চলে যাও ।''
ইচ্ছা
থাকলেও থাকার উপায় নেই রিয়াজুল আর সাবিনার । তাই চোখ-ভরা জল নিয়ে নিজেদের পথ বদলে
দিলো বুক-ভরা হাহাকার নিয়ে । আবার কবে আসবে,সে
কথাও জানা হল না রিয়াজুলের ।াপেছনে তাকাতেই জেলের দুর্ভেদ্য গেট ।
তারপর
রিয়াজুল সেই গাছের নিচে এসে আবার বসলো । বৃষ্টি পড়ছিল তখন । কিন্তু উঠতে চাইলো না
সেখান থেকে । চোখের বৃষ্টি ধোয়ার চেষ্টা করছিলো বুঝি ঈশ্বরের বৃষ্টি দিয়ে ।
রিয়াজুলকে
একা-একা বৃষ্টিতে বাইরে ভিজতে দেখে ছুটে এলো সেই আসামী তার ঘর থেকে । তারপর সে এসে
তার হাত ধরে বেদী থেকে তুলতে চাইলো । কিন্তু রিয়াজুল উঠতে চাইলো না ।
বৃষ্টি-ধোওয়া
চোখের জল নিয়ে বলল,''আমারে এহানে এগডু
শান্তিতে থাকতি দাও গো । আমি আর এগডু শীতল হতি চাই আইজ ।''
তখন
সে বলল কষ্টের হাসি হেসে,''বৃষ্টির দিন এখন ।
রোজই বৃষ্টি হইব । আইজ আর নয় । অন্যদিন ভিজো আবার ।''
উত্তর
দিলো রিয়াজুল,''আইজ যে বৃষ্টি হইতাছে,সে আমারে কিসুদিন শান্তিতে রাখব । তুমি বুজতি পারতছ না কিসু ।''
''সব
বুজছি গো আমি । সব বুজছি । তাইলে এগডা কাম করি । আমিও ভিজি তুমার লগে । আমার
ব্যাতা কম বইলা মনে কর ? আমার মা মরছে অনাহারে কদিন আগে ।
এ কতা কাউরে কইছি ? মানাইয়া লইছি সব । চল,দুজন মিইল্যা খুব ভিজি আইজ । কেউ না করলিও আমরা সরবো না এহান থেইক্যা ।
খুব কষ্ট গো । আমারও খুব কষ্ট ।''
কিন্তু
দুই পুলিশের রক্তচক্ষু দুজনকে সরিয়ে দিল সেখান থেকে একটু পরেই ।
এক
পুলিশ কড়া চোখ করে দুজনকেই বলল,''তোমাদের কিছু
হলে কে দায় নেবে ? আমাদের চাকরী খেতে চাও নাকি ? ঘরে যাও এক্ষুনি । নইলে কপালে বেদম মার আছে তোমাদের ।''
কি
আর করা । রিয়াজুল আর সেই আসামী তাদের ব্যথা আপ্রাণ আড়াল করতে করতে নিজেদের ঘরের
মধ্যে চলে গেলো । পরের কাহিনী জেলখানার নিত্যদিনের ।