মাঘ মাসের এক ভয়ঙ্কর শীতের রাত, সন্ধ্যা থেকে এক নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ভৈরব কাকভেজা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে একটা বাড়ির লোহার গেট
খুলে গাড়ি বারান্দার নীচে এসে আশ্রয় নিলো। রাত বাড়ছে, কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই।
ভৈরব একটা
কারখানায় কাজ করে। ছুটির পরে প্রতিদিনই সে বন্ধুদের সাথে একটা ঠেকে বসে, কয়েক পাত্র চুল্লু গলায় ঢেলে বাসায় ফেরে। বাসা বলতে শহরের বুকে একটা বস্তি এলাকায়
একটা এক কামরার টালির চালের ঘর। পদ্ম তাকে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে চলে যাওয়ার পর
থেকে, সে একাই
থাকে। আজও অন্যান্য দিনের মতো টলতে টলতে বৃষ্টির মধ্যেই সে বাসায় ফিরছিলো। কিন্তু
বৃষ্টির তোড় এত বেড়ে যায়, যে বৃষ্টি মাথায় করে তার আর হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। বাধ্য হয়ে এখানে এসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় চুপ করে বসে
থেকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, কুকুর কুন্ডলী হয়ে শুয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক ভাবেই বৃষ্টির ছাট, ঠান্ডা হাওয়া ও চুল্লুর নেশায়, সে ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।
আরও বেশ
কিছুক্ষণ পরে বাড়ির এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বাইরের লোহার গেট-এ তালা দিতে এসে ঐ ভাবে একজনকে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে, কোনমতে তাকে দাঁড় করিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে, অনেক চেষ্টার পর তাকে কিছু খাবার খাইয়ে কম্বল চাপা দিয়ে
একটা বিছানায় শুইয়ে দেন।
ভোরের দিকে
ভৈরবের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেলে সে ভেবে পেল না, যে সে কোথায় শুয়ে আছে। গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ, সে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে আসতে গিয়ে বাঁ দিকের টেবিলটার ওপর
মানিব্যাগটায় চোখ পড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো তাতে সাতটা একশ’ টাকার নোট। এক মুহুর্ত
সময় নষ্ট না করে, সে টাকাগুলো পকেটে পুরে বাইরে এসে লোহার গেট টপকে রাস্তায় নামলো।
বৃষ্টি
বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের বাসায় ফেরার পথে ধীরে ধীরে তার গত রাতের সব কথা ছবির মতো মনে
পড়ে যায়। টাকাগুলোর কথা ভেবে বেশ আনন্দ হলেও, পুলিশের ঝামেলার আশংকায় চিন্তিত হয়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকে।
ঘরে ফিরে
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে, গুটি গুটি পায়ে বাজারের দিকে এগলো। যাহোক দুটো ফুটিয়ে খেয়ে, কারখানায়
যেতে হবে। বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে টাকা দিতে গিয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো, পকেটে তার নিজস্ব সামান্য টাকা ছাড়াও সাত-সাতটা এক’শ টাকার নোট। মনের আনন্দে চুল্লুর দুটো বোতল কিনে বাসায়
ফিরে এলো।
বাসার
সামনে এই সময়টায় অনেক গোলা পায়রার দেখা মেলে, রোজই এই সময়টায় রাস্তার ওপর উড়ে এসে বসে খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। অনেক সময় আশপাশের
বাড়ি থেকে
কিছু চাল
গম ছিটিয়েও দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা ডানায় আওয়াজ তুলে রাস্তার ওপর উড়ে এসে বসে
খাবার খায়। ভৈরব ঘরে ঢুকে রান্না বসাবার আগে কয়েক পাত্র গলায় ঢেলে নেয়, আজ তার মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে। ব্যাগ থেকে বেশ কয়েক মুঠো চাল, সে তার ঘরের সামনে ছিটিয়ে দেয়। ঝাঁক ঝাঁক পায়রা রাস্তা
থেকে উড়ে এসে তার ঘরের সামনে ভিড় করে।
কিছুক্ষণ পর ভৈরব হঠাৎ লক্ষ করে, যে একটা পায়রার পায়ে খানিকটা সুতো জড়িয়ে গিয়ে পা-টা বেশ
ফুলে যাওয়ায় পায়রাটা ভালোভাবে হাঁটতে পারছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে কোনমতে চাল
খাওয়ার চেষ্টা করছে। এর আগে সে বহুবার এখান থেকে পায়রা ধরে চুল্লুর চাট বানিয়ে পরম
তৃপ্তিতে মাংস খেয়েছে। আজও তার ইচ্ছে থাকলেও পায়রা ধরার মতো শরীরিক অবস্থা ছিল না।
কিন্তু এই পায়রাটা দেখে তার লোভ নয়, হঠাৎ কিরকম মায়া হ’ল। সে ধীরে ধীরে চাল ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে গিয়ে পায়রাটাকে ধরবার চেষ্টা করেও বিফল
হ’ল। শেষে আরও বেশ কিছু চাল ছড়িয়ে, টলমলে পায়ে বেশ কিছু সময় ব্যয় করে, পায়রাটাকে ধরে ঘরে ফিরে এলো। আর সব পায়রা আগের মতোই
ছড়ানো চাল খেয়ে গেলেও, এই পায়রাটা প্রাণ
ভয়ে পাখা ঝাপটে কোনমতে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেও বিফল হ’ল।
পায়রাটার একটা পায়ে সুতো জড়িয়ে গিঁট পড়ে যাওয়ায় ঘা হয়ে
ফুলে গেছে। ভৈরব একবার ভাবলো পায়ের ঐ অংশটা কেউ খায় না, ঘরে তো চুল্লু আছেই, কাজেই পায়রাটাকে কেটে রেঁধে দুপুরটা বেশ কাটানো যাবে। কিন্তু পেটে ঐ বিশেষ জল পড়লে বোধহয় মনটাও জলের মতোই
স্বচ্ছ ও পরিস্কার হয়ে যায়। ভৈরব একটা ব্লেড নিয়ে সব কাজ ফেলে পায়রার পায়ের
চিকিৎসা শুরু করে দিলো। কাঁপা হাতে অনেক কষ্টে ক্ষতস্থানের ওপর সুতোর গিঁট কেটে, জট খুলে, পায়রার পা
বাঁধন মুক্ত করে, দাড়ি কামানোর ফটকিরি, জলে ভিজিয়ে ক্ষতস্থানে ভালো করে ঘষে ঘষে লাগিয়ে, ঘরের
বাইরে আর সব পায়রাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে এলো। তাকে দেখে অন্য পায়রাগুলো উড়ে গিয়ে দূরে
বসলেও, এই
পায়রাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আবার তার ঘরে ঢুকে পড়লো। এইভাবে বার কতক চেষ্টা করে
তাকে বাইরের রাস্তায় অন্য পায়রাদের কাছে রেখে এসে রান্না চাপাবার প্রস্তুতি নেবে, এমন সময় পায়রাটা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে এসে তার কোলে গিয়ে বসলো।
পায়রাটার কৃতজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আদর করতে গিয়ে, হঠাৎ তার
গত রাতের কথা মনে পড়লো। গতকালের দুর্যোগপূর্ণ শীতের রাতে তাকেও তো একজন খাবার দিয়ে
গরম কম্বল দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিল। প্রতিদানে সে তার ব্যাগ থেকে সাতশ’ টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছে। পায়রাটকে বেশ কিছুক্ষণ দুহাতের মাঝে ধরে সে চুপ করে
বসে থেকে, তাক থেকে একশ’ টাকার নোটগুলো নিয়ে কাল রাতের সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।