ইনবক্সে
অচেনা মেসেজ ! আজকাল
অবশ্য এসবে অভ্যেস হয়ে গেছে রাইয়ের । বছর দুয়েক আগে দাম্পত্যজীবন থেকে ফাঁকি দিয়ে
আচমকা সজল চলে গেল । এখন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই এতবড় বাড়িতে দিন কাটে শূন্যতায় । তবু ভাগ্যিস কনভেন্টের শিক্ষকতার চাকরীটা ছিল ।
নইলে বাপের বাড়ি থেকে এতদূরে এই ভিন রাজ্যের এই পাহাড় ঘেরা ছোট্ট ছবির মত শহরে একাকীত্ব যেন
গ্রাস করে ফেলত ! অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলটা নিয়ে দোতলার
নিরিবিলি ব্যালকনিতে বসে আত্মীয়স্বজনদের সহানুভুতি ও সবার অকৃত্রিম ভালবাসায় যেন
পথ চলা ।
বিরক্তির
সঙ্গে খুলতেই অবাক হয়ে দেখল রাজার মেসেজ ! তা প্রায় ৩০/৩৫ বছর তো হবেই । কুমারীকালে ওর সঙ্গে অনেক
জলসায় গান গেয়েছে । এক মাথা চুল আর রোগাটে গড়ন সেই চেহারার বদল হয়েছে বটে তবে
চিনতে একদম অসুবিধা হয়নি রাইয়ের । ওদের বাড়িতে এসে গানও গেয়ে গেছে রাজা । এখনও মনে
আছে সেই গান দুটো “ভালবেসে
সখি” আর “যে ছিল আমার স্বপনচারিণী”।
ওর সঙ্গে সম্পর্ক খুবই সহজ ছিল রাইয়ের । রাজাও কোনদিন তেমনভাবে কিছু বলেছে বলে মনে
পড়েনা রাইয়ের । শুধু একটা আলগা ভাল লাগা ছিলই । মেসেজের উত্তরে কুশল বিনিময়ী একটা উত্তর দিয়েছিল
রাই । ব্যস্ ।
পরদিন
ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ফোন এলো রাজার । অনেক কথা হল দুজনায় । বাড়ি ফিরে এসেই রাজাকে
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্টেড হয়ে গেল ।
এরপর
থেকে প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপে ফোনে রাই যেন প্রাণ ফিরে পেল । রাজার কথার যাদুতে
কবিতায় গানে ভরে উঠলো শূন্য প্রহর গুলো । ইচ্ছে করেই রাজাকে জানায়নি ওর একা হয়ে
যাওয়ার কথা । হয়তবা নিজেকে একটা লক্ষনরেখার শাসনে বেঁধে রাখার ইচ্ছেতেই । রাজা
কিন্তু সেই পুরোণোদিনের কথার মধ্য দিয়ে অকপটভাবে বলে দিয়েছে যে ও রাইয়ের প্রেমে
পাগল ছিল । এও বলেছে যে- বয়স মানুষকে অনেক সহজ করে দেয় । এখন এসব কথা বলাই যায়
কারণ সে সময় শুধু মধুর স্মৃতির সুবাস বয়ে আনে । রাই বুঝতো রাজার সরলতা । তাই বাধা
দিত না আবার এড়িয়ে যেত না । প্রতিদিন একটা অদ্ভুত মোহে অপেক্ষা করত একটা ফোনের ।
সারাদিনের ফিরিস্তি শোনা আর বলা ।
আজ
প্রায় ছমাস বাদে গতকাল সমস্ত বলয় ভেঙে রাজাকে জানিয়ে দিয়েছে যে ওকে সংসারে একা
ফেলে রেখে সজল চলে গেছে না ফেরার দেশে । রাজার প্রতিক্রিয়া শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেল
রাই ।অন্তহীন অনুশোচনায় বারবার বলতে লাগলো – কেন আমি বলতে গেলাম অকপটে সব কথা । আমি
জানি তোমার ভরা সংসারে আমার একথাগুলো বিঁধবে না তোমায় বরং ছোটবেলার পুতুলখেলার
স্মৃতির মত আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হবে । একবারও যদি জানতাম কখনোই বলতাম না ।
আজ
বহুদিন পর বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দোতলার ব্যালকনিতে বসে অনেকক্ষন শিশুর মত কাঁদলো রাই
। বাপের বাড়ি , মেয়েবেলার
সেসব গান নাটকের দিনগুলো,ইউনিভার্সিটির
হোস্টেলজীবন । অবশেষে পরিযয়ী পাখির মত উড়ে এসে বাসা বাঁধা আর সজলের চলে যাওয়া ।
কান্নায় যে এত সুখ আছে জানতনা সে । বুকের ভেতরটায় যেন পুরো আকাশটা দেখতে
পাচ্ছে আজ ।
কি
করে বোঝাবে রাজাকে যে ওর সরল সান্নিধ্য
ছাড়া যে একটা দিনও চলেনা রইয়ের । কারণ এই মানুষটি ঝড়ের মত এই মাঝবয়সে এসে
জানিয়ে দিয়েছে – জীবন
শুধু চলে যাওয়ার জন্য নয় , জীবন জীবনের কাছে ভীষনভাবে ফিরেও আসতে চায়
।
ভাদ্রশেষের
বিকেলের অস্তরাগে রাঙা একটা দলছুট্ মেঘ হারা উদ্দেশ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে । সামনের বড়
গাছটায় ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব ছাপিয়ে বেঁজে ওঠে রিংটোন ।