এসএমএসটা পড়েই রাগ ধরে যায় রুমকির। রাগের চোটে প্রথমেই
ভাবে, অসম্ভব!
কিছুতেই
ও যাবে না। থাক পড়ে রুপুর জন্মদিন।
অসহ্য লাগে এদের সঙ্গ ।
অশুদ্ধ উচ্চারণে দুজন পুরুষের অনবরত ফিজিক্যাল ইয়ার্কি আর ছুঁকছুঁক কাঁহাতক সহ্য করা যায় ! রুপু অবশ্য খুব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে কিন্তু রুমকির গা জ্বলে যায় ঘেন্নায়। ধ্যুত
যাবে না ও। পরে স্যরি টরি বলে ভাল কিছু গিফট দিয়ে দিবে।
রাগ ফেলে কনকর্ডের উপর নীচ চষে
ফেলে রুমকি। কদিন ধরেই শক্তি খুব টানছে। ঘরে
একটাও শক্তি চট্টোপাধ্যয়ের বই নেই। দশম আশ্চর্যের ব্যাপার কনকর্ডের কোনো
দোকানেও একটুকরো শক্তি খুঁজে পায় না ও।
অথচ মাথার মগজের কূয়োর ভেতর আজ কদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে “হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য”।
বুকের ভেতর যখন তখন তুমুল বৃষ্টি নামাচ্ছে মন খারাপের
কালো মেঘেরা, ভারী ব্যাপক কষ্টের সেই
রক্তবৃষ্টি। রুমকির খুব কষ্ট হচ্ছে। অকাল বর্ষায় কৃষকের ফসল ভেসে যাওয়ার কষ্ট, নিরন্ন ভাতের হাঁড়ির শূণ্য বুকের কষ্টের মত বুক ভেঙ্গে
কান্না আসছে। কেবলই মনে পড়ে যাচ্ছে আদিত্যকে। চাপ চাপ বিস্মৃতি ঠেলে স্পষ্ট হয়ে
উঠছে আদিত্যের স্পর্শ, ঝগড়া, বিচ্ছেদ, সুখের টুকরো
টুকরো আলোছায়া।
পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গে রুমকি ।
নীচের দোকানগুলো আবার দেখবে একবার । ভেতরের কষ্ট
ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। যেন যন্ত্রণার ঢেউ পেরুচ্ছেএভাবেতিনটে সিঁড়ি নেমে আবার
উঠে আসে কাক প্রকাশনীতে। সাদা কবুতরের মত মেয়েটি হিসাব মেলাচ্ছিল। রুমকিকে দেখে
হেসে ফেলে। ফিঙ্গের মত পনিটেল নেড়ে জানায়,
আপু
সবাই একুশ নিয়ে ব্যস্ত । শক্তি চাইলে আপনাকে কষ্ট করে আজিজে যেতে হবে।
রাগের ভোল বদলে যায় মেয়েটির
চমৎকার সাজানো দাঁত দেখে। দুপাশের ড্রাকুলা দাঁতদুটি ঝকঝক করছে। আদিত্য বলত ড্রাকুলা সুন্দরি। কখনো
ক্ষেপাতো কখনোবা খুব স্বাভাবিক সুরেই রুমকিকে বলত, বোতামটা লাগিয়ে
দাও ত ড্রাকুলা সুন্দরি !
ভীষণ পছন্দের ছিল রুমকির গজদাঁত
দুটো ! ধারও ছিল অসম্ভব । অনায়াসে কুট
করে কেটে ফেলতে পারত কাগজ সূতো, কাপড়, চিপ্স চকোলেটের প্যাকেট আদিত্যর মাখন মাখন বুকের
জমিন। রেগে গেলে কি শীৎকারে এই দাঁত ছিল রুমকির মোহন অস্ত্র।
বুকের কোথাও মেঘ ভেঙ্গে পড়ার
শব্দ হয়। অসাবধান হাতের ধাক্কায় কতগুলো লিটল ম্যাগ ঝাপটে পড়ে যায় কার্পেট বিছানো
ফ্লোরে। রুমকি বিব্রত হাসে।ম্যাগগুলো গুছিয়ে তুলে লজ্জা
পেয়ে বলে , স্যরি পায়রাবতী !
লিটল ম্যাগে কবিতা দেওয়ার সুতো
ধরেই তো আদিত্য এসেছিল ওর জীবনে। ছন্দ বুঝতে বুঝতে কখন যেন মিলে গেছিল দুজন।
ভাবসাব দেখে রুপু অবশ্য আগেই সাবধান করেছিল,
শোন
রুমকি তোকে তো ভাল করেই চিনি। হ্যাংলা প্রেমে তোর খুব আগ্রহ। আদিত্যদের কিন্তু দিন
আনে দিন খায় অবস্থা। টাকা নাই তো প্রেম নাই কথাটি মনে রাখিস।
আহা দিন আনে দিন খায় !
তারপরেও
এমন লেখা ! রুমকি আরো গভীর ভালবাসায়
আদিত্যকে জড়িয়ে নিয়েছিল।
লিটল ম্যাগগুলো দেখতে দেখতে
নিজেকে বকে রুমকি, কি কেমন লাগে এখন ? ইমোশনের
ঘিয়ে ভাজাপোড়া হয়ে খুব তো বইগুলো ফেলে দিলে আদিত্যর নাম লেখা ছিল বলে। ওগুলো থাকলে
কি এমন ক্ষতি হত শুনি!
কয়েকটি অক্ষরই ত মাত্র !
কিন্তু বইগুলোর পাতা উল্টালেই
যে অক্ষরগুলো রক্ত মাংসের শরীর পেয়ে যেতো ! আর রি রি করে রাগ বেড়ে যেত রুমকির। স্মৃতি হিসেবে
কিছুই রাখতে চায়নি ও। যতগুলো বইয়ে আদিত্যর নাম লেখা ছিল কিছু বিলিয়ে দিয়েছে বাকিটা
ফেরিওয়ালা ডেকে বিক্রি করে সেই পয়সায় এস্প্রো কফি খেয়েছে। সাদা গোলাপি টিস্যু
পেপারে ঠোঁট মুছতে মুছতেসে মুছে ফেলতে চেয়েছিল স্মৃতিময় সব চুমুর উষ্ণতা। তবু কেন
যে রাগে অভিমানে,
ঘৃনায়, বিশ্বাস অবিশ্বাসে এখনো আদিত্য এসে দাঁড়ায় ! মাথা ঝাঁকায় রুমকি, হেট য়ু আদিত্য,
দ্য
ফাকার লুজার – মাই ফুট!
খুঁজে পেতে রিলকের কবিতা নিয়ে
বেরুনো একটি ছোট পত্রিকা কিনে যখন বেরিয়ে আসছে নাকেমুখে নোংরা একজন বিখ্যাত
কবি ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে,
শক্তি
পেলেন ম্যাম ? রুমকি মাথা নাড়ে। ইচ্ছা করে না
ফিরে দেখার । গা গুলিয়ে উঠে এদের দেখলে। বমি
পায়।সাতদিন সাতরাত সাবান ঘষলেও এরা পরিষ্কার হবে না এ জন্মে। কবি কবি ভাব দেখাতে এরা কত রকমের ভাও যে
ধরে ! ভ্যাক !
সরে
আসে কিছু না বলে। দেড় তলার ছাদে রক সর্দারের মত এক টাকলা কবি পীর হয়ে বসে আছে মোসাহেবসহ।
টাকলা ক্ষণিকের আবেগে শক্তির বই দিতে চেয়ে
বেমালুম ভুলে গেছে। পাশ কেটে চলে আসে ও। আজিজেই যাবে। শক্তিকে তার চাই ই চাই ।
আজকেই। এখুনি। এই মূহূর্তেই।
আমাকে বিয়ে করতে পারবে আজ এখুনি ? আদিত্যর চেক শার্টে চুঁইয়ে পড়ছে ধবল আমন্ত্রণ।
রুমকি হেসে লুটিয়ে পড়েছিল।
খুব হ্যা । কি এমন শক্ত কাজ। বিয়েই তো মাত্র । চলুন।
চলুন।
আদিত্য সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল
গরিব হয়ে যাবে কিন্তু। এই যে রানী ফড়িঙয়ের মত রংগীন
উড়াল, ইচ্ছামত টাকা খরচ – পারবে নাআর।
রুমকি আদিত্যর হাত ধরে বলেছিল,
আমি
গরিব হব আদিত্য।
কনকর্ডের লাস্ট সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল ।
তিনবার জুতো খুলে গেল পা থেকে।
আদিত্যর হাত ধরে সিঁড়ি ভাঙতে, রাস্তা পেরুতে,
লম্বা
পথে পা মেলাতে কি যে আনন্দ ছিল। একটু হেলান দিয়ে
দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে উহ আহ করা! আজন্মের লতাগাছ
রুমকি। আগে কাঁটা ছিল না। এখন কাঁটাযুক্ত কুঞ্জলতা। ভালবেসে কেউ কাছে আসতে চাইলেই কাঁটাগুলো
পটপটিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আড়ালে অনেকেই বলে, মুডি। কি আছে এত
মুড দেখানোর। ঐতো একটি দুটি ছক্কাপাঞ্জা কবিতার বই!
তার
দেমাগে একেবারে কবি শামসুর রাহমান !
নীচতলায় সুন্দর করে সাজানো
পরিচিত দোকানটিতে ঢুকে জানতে চায়, শক্তি এনেছেন ?
না
নেই । তিনমাস ধরে বলেই যাচ্ছে ফুরিয়ে গেছে
দিদি। এই ত আনব শিগগীর।
অনেকগুলো গালি দিতে দিতে বেরিয়ে
আসে রুমকি। পাশ থেকে একজন লেখক প্রকাশক ফাজলামো করে,
ও
দিদি শক্তিতে কি পাবেন গো ? মদের জালা চাইলে
আরো অন্নেক্কেই আছেএ এ—ন্নোতুন-- পুরান্নো – হাতে গরম
রুমকি হেসে ফেলে –না রে আমার শক্তিই
চাই।
দুষ্টুটা ত্যাদরামো করে, ওরে দিদিরে চা দে,
চা
দে। চেনি এট্টু বেশি ফেলিস। তিন সত্যি
দিদি, এই শক্তিদাদার কসম, বড় শক্তিহীন নাগচে গো তোমারে !
রুমকি হেসে বেরিয়ে আসে। লম্বা
ফাঁকা নির্জন করিডোর। ছায়া ছায়া আলো আঁধার। এই সময়ে একা হাঁটতে ওর খুব ভাল লাগে। অনেক কালের প্রিয় অভ্যাস। এরকম ঝুম নিধুয়া
একাকি সময়ে নৈঃশব্দ্য গাঢ় ঘন হয়ে কাছে আসে
ওর। নোখের নেইলপালিশ ছুঁয়ে গোড়ালি জুড়ে শুয়ে থাকা রূপার মলে সশব্দে চুমু খায়।
রুমকি চকিতে আয়নাঘরের দরোজা খুলে দেয়।
শব্দহীন চপলতায় আয়নাঘর থেকে
বেরিয়ে আসে শিশু রুমকি, বালিকা রুমকি, কিশোরি রুমকি, ভুলভরা তরুণী রুমকি। মাত্র কয়েক সেকেন্ড ! চোখের জলে ভিজে রুমকি হাগ্ করে ওদের, ভাল আছিস রুমকি?
এইতো
চেষ্টা করছি। দেখিস সব ভুলে যাবো একদিন। সব!
ঝেঁপে নেমেছে বৃষ্টি। সন্ধ্যার
অন্ধকারকে গহন গভির করে অঝোরে কাঁদছে
আকাশ।যেমন খুশি ভাড়ায় রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েরুমকি।নামুক বজ্রবৃষ্টি।আকাশ ভেঙ্গে নেমে আসুক মেঘ কিশোরীর
দল।রুমকিকে ভিজিয়ে দিক। সম্বৎসরেররুক্ষতাকেটেযাকতুমুলমেঘবৃষ্টিতে।রুমকিও কাঁদুক। বুকের পাঁজর খুলে দিয়ে কেঁদে হাল্কা হোক ওর অভিমান।