"বৌদি,দুপুরে
ওই কুরিয়ারের ছেলেটা এই প্যাকেটখান দিই গেছে"-সুমনের মা ঘর গোছানোর মাঝেই
প্যাকেটটা ছুড়ে দিল আমার কোলের কাছে। সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরে আমি খানিকটা পিঠটান
দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। তাতে খানিকটা বিঘ্নই ঘটালো এই প্যাকেটখানি। আমি তো
অনলাইনে কিছু অর্ডার দিই নি। তাহলে কি সুব্রত? এর মাঝে বলে রাখি সুব্রতর সাথে আমার
বিয়ে হয়েছে মাস সাতেক হল। দুজনের সংসার যাদবপুরের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে। আমি IT-তে আর ও প্রিন্ট মিডিয়ায়। সে যাই হোক! সুব্রত কিছু অর্ডার দিলে পার্সেল তো
আমার নামে আসা উচিত নয়। তাহলে? খুলেই দেখা যাক না! অ্যাটম বোম তো আর থাকবে না, আর
বাইরে থেকে তো বই জাতীয় কিছু বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্যাকেটের উপর তো কারও নাম
ঠিকানাও লেখা নেই।এরকম একটা প্যাকেট হঠাৎ করে খুলে ফেলাটা কী ঠিক হবে? চারিদিকে যা
হচ্ছে আজকাল! উফ্...আর ভাবতে পারছি না। অনিশ্চয়তা সম্বন্ধে বেশী ভাবলে আমার আবার
বড্ড মাথা ঝিমঝিম করে। তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে বস্তুটিকে প্যাকেট মুক্ত করার
প্রয়াস শুরু করলাম।
এ যেন কাঁচি বনাম
সেলোটেপের কুরুক্ষেত্র। একটা গোটা সেলোটেপের রিলও এই প্যাকিংয়ের জন্য খরচ করা হলেও
আমি একটুও বিস্মিত হব না। সে যাই হোক! অবশেষে কাঁচির জয় এবং প্যাকেটের বেড়াজাল
থেকে মুক্ত হয়ে বস্তুটি আপাতত আমার হাতের নাগালে। আমার অনুমান সঠিক। বস্তুটি আর
কিছুই নয়, নেহাতই একটা বই। বইটির নাম "রঙীন সফর", নীচে বেশ কায়দা করে
লেখিকার নাম লেখা " অদ্বিতীয়া"। আচ্ছা এনারই একটা লেখা সেদিন এবারের পূজাবার্ষিকীটায়
পড়ছিলাম না? হ্যাঁ তাই তো! নতুন লেখিকা কিন্তু দিব্যি লেখেন। মনে হয় আমাদের মনের
কথাগুলোই ছাপা অক্ষরে আঁকা হয়েছে। কিন্তু বই কে পাঠাবে আমায়? দু'এক দিনের মধ্যে
আমার জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী নয়। তাহলে? এমনি সব এলোমেলো ভাবনার মাঝে বইয়ের
মলাটের ভাঁজ থেকে ঝড়ে পরল একটা ছোট্ট চিরকুট। চিরকুটটাতে একটাই শব্দ লেখা। চোখের
রেটিনাটা কেমন টনটন করে উঠল। ফিরে গেছি ফ্ল্যাশব্যাকে।
আজ থেকে প্রায়
বছর কুড়ি আগের কথা। আমাদের মফঃসলের ছোট্ট ইস্কুল। টিনের চালের ক্লাশরুম,টুপটুপ
বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। এখনও পরিষ্কার মনে আছে। অনুপ স্যারের ইতিহাস ক্লাশ চলছিল তখন।
যিনি নিয়মিত ঘন্টা বাজিয়ে ক্লাশে শুরু ও শেষের জানান দেন তাঁকে আমরা ঘন্টাকাকু
বলতাম। হঠাৎই সেই ঘন্টাকাকুর হাত ধরে একটি মেয়ে ক্লাশে এল। রোগা,পায়ে হাওয়াই
চটি,একটু পুরোনো হয়ে আসা স্কুল ড্রেস,হাতে মাত্র দুটো খাতা আর রুগ্ন চুলে দুটো
লম্বা বিনুনি। এসে সেকেন্ড বেঞ্চে মেঘার পাশেই বসেছিল ও। বুঝতেই পারলাম ও স্কুলের
নতুন ছাত্রী। তখন তো নতুন বন্ধু পাতানোর প্রতি একটা প্রবল টান ছিল। এখনকার ফেসবুকে
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর মধ্যে সেই সুখটা নেই। ভাবছি কখন মেয়েটার নাম জানব। ও কি
আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছে? নাকি অন্য কোথাও থাকে? এদিকে অনুপ স্যার অনবরত বলে
চলেছেন মানুষ কীভাবে প্রথম আগুন জ্বালাল... কীভাবে প্রথম চাকা বানাল! কিন্তু
আমাদের মনের উসকানিটাকে আর যে থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ক্লাশ শেষের ঘণ্টা বাজতেই
আমি,মেঘা,তিয়াসা আর অনন্যা প্রায় হামলে পরলাম নতুন মেয়েটির উপর। কি নাম রে তোর?
বাড়ি কোথায়? আগে কোন স্কুলে পড়তিস? ব্যাগ কই তোর? টিফিন আনিসনি? এমনই হাজার প্রশ্ন
বানে নতুন মেয়েটি প্রায় জর্জরিত। সে কিন্তু মোটেও ঘাবড়ে যায়নি। বরং আমাদের হাতে
হাত মিলিয়েছিল সেই প্রথম দিনেই। ধীরে ধীরে জানলাম মেয়েতির নাম রাই। টিফিনটা সেদিন
ভাগ করেই খাওয়া হল। বাড়ির কথা সেভাবে আর জানা হল না প্রথম দিন। স্কুল ছুটির ঘণ্টা
বাজলেই রাই এক ছুটে ক্লাশরুম থেকে মাঠে , সেখান থেকে মেইন গেট পেড়িয়ে... ব্যাস আর
দেখা গেল না রাইকে।
পরেরদিন থেকে ও
আমার পাশেই বসত। আমাদের এই ছোট্ট মফঃস্বলে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু রাইকে
আমার এই দশ বছরের জীবনে একবারও দেখেছি বলে মনে পরে না। খুব চনমনে, খোলামেলা,
দুষ্টুমিতে ভরপুর একটা মেয়ে। ঠিক যেন এক দমকা হাওয়া কিংবা গাছের পাতায় খেলে বেড়ানো
এক চিলতে রোদ্দুর। ও সবচেয়ে মজা পেত লোককে চমকে দিয়ে। এই ধরা যাক মিনতি মিসের
ভূগোল ক্লাশ। ম্যাপ, গ্লোব, নাম ডাকার খাতা সব হাতে নিয়ে দিদি আসছেন। আচমকা রাই
দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসেই বলল “ধাপ্পা”। ব্যস! ম্যাপ, গ্লোব যে যার মত ছিটকে
ছড়িয়ে গেল। দিদি তো রেগে আগুন। সেদিনের মত রাইয়ের জায়গা ক্লাশরুমের বাইরে। কিন্তু
সে মেয়ের কি আর লজ্জা আছে? আবার পরেরদিন আমি গেছি কলঘরে মুখ ধুতে। এমনিতেই শোনা
যেত কলঘরের পেছনের বাগানে নাকি শাঁকচুন্নির উৎপাত। যদিও বড় হয়ে জেনেছিলাম বাগানের
সাপের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতেই বড়দের এই গল্প ফাঁদা। সে যাই হোক, কলঘর থেকে
বেড়তেই রাই আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল “ধাপ্পা”। আমি তো ভয়ে কেঁদেই ফেলেছিলাম। আর
আমার কান্না দেখে সে মেয়ের কি হাসি! এভাবেই আমাদের একসাথে হেসে খেলে বেড়ে ওঠা। তবে
স্কুল ছুটির পর রাইকে এক মুহূর্তের জন্যও দেখা যেত না। জিজ্ঞাসা করলেই বলত – “মা
অপেক্ষা করে যে! কখন বাড়ি ফিরে মাকে গিয়ে ধাপ্পা বলব মা তার অপেক্ষা করে রে”।
একবার পুজর ছুটির
ঠিক আগের দিন,সেদিন আমরা সবাই নতুন জামা পরে স্কুলে আসতাম, আমরা ঠিক করলাম পিকনিক
করব। সবার বাড়ি থেকে কিছু না কিছু আনার দায়িত্ব। আমার মা বাড়ি থেকে লুচি করে দিল
আমাদের পাঁচজনের জন্য। মেঘা আনল আলুর দম, অনন্যা ফুলকপির তরকারি আর তিয়াসা মিষ্টি।
রাই যথারীতি এল খালি হাতে। পুরনো একটা জামা, সেটাও ওর দেহের তুলনায় বেশ বড়। আমরা
তো অবাক। এটাও ওর কোন নতুন চমক নাকি? মেঘা তো প্রশ্নটা করেই ফেলল – “কিরে? নতুন
জামা কই?” রাই নির্বিকার চিত্তে বলেছিল “পুরনো জামা নষ্ট না হলে নতুন জামা তো শুধুই বিলাসিতা”। ক্লাশ ফাইভের মেয়ের
মুখে এসব শুনে কেউ ওর পেছনে হেসেছিলাম, কেউ বা বলেছিলাম “হুঃ,বেশী বেশী”। সে যাই
হোক! বললাম “খালি হাতে এলি যে? আজ তো পিকনিক। তার কি হবে?” ও বের করল প্লাস্টিকে
মোড়া একদলা কদবেলের আঁচার। উফ্! লুচির সাথে হেব্বি জমেছিল। আরও একটা জিনিস এনেছিল
ও। ফ্রকের কোঁচড়ে এক থোকা শিউলি ফুল। বলল- “শিউলির গন্ধ ছাড়া পুজোর পিকনিক হয়
নাকি?” আমরা অনেক কিছু এনেছিলাম কিন্তু ওর আনা দুটো জিনিস যেন পিকনিকে অন্য মাত্রা
দিয়েছিল।
এভাবেই পাল্লা
দিয়ে চলতে থাকল আমাদের পড়াশোনা আর দুষ্টুমি। অনন্যা বরাবরের ফার্স্ট গার্ল। কীসব
ভয়ঙ্কর রকম নম্বর পেত। আমার কিন্তু রেজাল্টের দিনগুলোতে ওকে বেশ হিংসা হত। রাইকে
কখনও কাউকে হিংসা করতে দেখিনি। ওর মধ্যে ঋণাত্মক অনুভূতিগুলোই যেন ছিল না। রাই
ফার্স্ট না হলেও পড়াশোনায় খারাপ না। অঙ্কে অনন্যা খুব ভালো। একশোর কম পাওয়ার কথা ও
যেন ভাবতেই পারে না। একবার হল কি ক্লাশ সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় অনন্যা অঙ্কে
বিরানব্বই আর রাই একশ। সেদিন খুব কেঁদেছিল অনন্যা। আর রাই? ও অঙ্কের রাকা
দিদিমণিকে গিয়ে বলেছিল – “আমার চাইনা একশ,যে নম্বর বন্ধুকে কাঁদায় আমার সে নম্বরে
কাজ কি?” সেদিনও আমরা রাইকে ভুল ভেবেছিলাম। ভাবলাম অ্যাটেনশান সিকনেস থেকেই হয়তো
রাই এসব করে। ওকে বুঝতে আরও বছর দুই লেগে গেছিল আমাদের।
এভাবেই আমরা বেড়ে
চলেছি। প্রতিটা দিন নতুন নতুন রং নিয়ে আসে আমাদের জীবনে। এই দিনটার কথা খুব বেশী
করে মনে পরে আমার। সেদিন কি কারণে স্কুলে হাফছুটি হয়েছিল। আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে
স্কুলের পেছনের পুকুর ধারে কিতকিত খেলার পরিকল্পনা করছি । পুকরধারে পৌঁছেই দেখলাম
আমাদেরই স্কুলের ক্লাশ টুয়েলভের ছাত্রী মালবিকা দি একলা বসে। রাই যথারীতি মালবিকা
দিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল – “ধাপ্পা”। সেদিন কিন্তু মালবিকা দি চমকায় নি। মুখ
ফেরাতে দেখলাম অঝরে কাঁদছে । কেন জানিনা। জিজ্ঞাসাও করিনি । আমরা আমাদের খেলায়
ফিরলাম। হঠাৎই একটা আওয়াজ ‘ঝপাং’। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাইও ছুটে গিয়ে জলে
ঝাঁপ দিল মালবিকা দিকে বাঁচাতে। আমরা ততক্ষণে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করছি। রাই বেশ ভাল
সাঁতার জানত, তাই ও বেশ কিছুক্ষন ভাসিয়ে রাখতে পেরেছে মালবিকা দিকে। তারপর বেশ
কয়েকজন মিলে ওদেরকে তুলে আনে। সে যাত্রায় মালবিকাদি বেঁচে গেল। সেদিনই বুঝেছিলাম
সবাই রাই কি! পরেরদিন স্কুলে এসে মালবিকা দিকে ক্লাশ নাইনের পুচকি রাই বলেছিল –
“দিদি, হেরে গিয়ে মরলে তো মরেই গেলে, জিতে গেলে দেখবে মরে গিয়েও বেঁচে থাকার সুখটা
খুঁজে পাওয়া যায়”।
এই দিনের পর
থেকেই রাইয়ের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দুটোই বেড়ে গেছে। রাই কিন্তু একইরকম। একে
ওকে “ধাপ্পা” বলে চমকে দেয় আর তার পরেই খিলখিলিয়ে হাসি। আমি আর রাই এখন অভিন্ন
হৃদয়। দুজনে দুজনকে ছাড়া থাকাই দায়। টিফিন ভাগ থেকে শুরু করে আন্যুয়াল ফাংসান
সবেতেই আমাদের জুটি সেরা।
আবারও এক বৃষ্টির
দিন, সেই অনুপ স্যারের ইতিহাস ক্লাশ। ঘণ্টা কাকু এসে স্যারের অনুমতি নিয়ে রাইকে
বাইরে নিয়ে গেলেন। সেদিনের মত রাই আর ক্লাশে ফিরল না। রাইয়ের ব্যাগটাও আমিই বাড়ি
নিয়ে ফিরলাম। শুধু সেদিন কেন, পরের দিনও রাই অনুপস্থিত। দুদিন, তিনদিন এভাবেই
কাটল। রাইকে ছাড়া আমাদের ক্লাশরুমটাও কেমন ঝিমিয়ে আছে। কেউ গাছ থেকে এটা ওটা পাড়ছে
না, ধাপ্পা বলে ভয় দেখাচ্ছে না, এমনকি ক্লাশ না করার ধান্দায় চক লুকিয়ে রাখারও কেউ
নেই। উফ, এভাবে দিন কাটে নাকি? রাই কখনও ওর বাড়ির কথা কিচ্ছু বলেনি যে গিয়ে খোঁজ
নেব। অগত্যা গিয়ে ধরলাম আমাদের ঘণ্টাকাকুকে। কাকু মাথা নিছু করে বলল – “রাইয়ের মা
মারা গেছেন, তাই ও হয়ত ক’দিন আসবে না স্কুলে”। আমার হাত পা কাঁপছিল, বুঝতে
পারছিলাম না কি বলব। শুধু মায়ের টানেই তো রোজ বাড়ি ফিরত রাই। ইস,রাইয়ের বাড়িটা যদি
চিনতাম! ওর বাড়িতে আর কে কে আছে? কিছুই তো সেভাবে বলেনি কখনও।
এভাবেই প্রায়
উনিশ দিন কেটে গেছে, রাই আসেনা। কুড়ি দিনের দিন রাই স্কুলে এল। উসকোখুসকো চুল,
হাতে পোড়ার দাগ, মাথার পাশে কালশিটে। চোখ মুখ দেখে তো চেনাই যায়না। কোথায় গেল সেই
চনমনে রোদ্দুরটা ? এতো শুধুই একতা কালো মেঘের দলা,একটু ধাক্কা খেলেই অঝোরে ঝড়ে
পরবে।
সেদিনই টিফিন
টাইমে জেনেছিলাম রাইয়ের গল্পটা। বড় রাস্তার ধারে যেখানে টাউনে যাওয়ার ট্রেকার ছাড়ে
, তারই বাঁ পাশে সাদা সাতমহলা বাড়িটাই রাইয়ের ঠিকানা ছিল। ওর মা ওই বাড়িতে কাজ
করতেন। রাই জানেনা ওর বাবা কে! ওর মাও বলেননি কখনও। তাই বাবা ডাকটার সঙ্গে ওর কোন
সম্পর্ক তৈরি হয়নি। ওর মা অনেক লড়াই করেছিলেন রাইকে স্কুলে পাঠানোর জন্য। এখন
বুঝি, ওর জিতে যাওয়ার নেশাটা ওর মায়ের থেকেই পাওয়া। রাই এখন বাড়ির সব কাজ সামলে
স্কুলে আসছে। হাতের পোড়া দাগ, মাথার পাশের কালশিটে সবই তার প্রমান। শেষে আমার হাত
ধরে কেঁদে বলেছিল – “মাধ্যমিকটা যে আমায় দিতেই হবে”। এই প্রথম রাইকে কাঁদতে
দেখেছিলাম। রাই এখন অনেক চুপচাপ। সেই চনমনে ভাবটা যেন ঝিমিয়ে গেছে। কথাও বলেনা খুব
একটা। শুধু পাতার পর পাতা লিখে চলে কীসব! আমি একদিন লুকিয়ে পড়েছিলাম ওর খাতাটা।
মনের কথাগুলোই যেন গল্প হয়ে ফুতে ওঠে। কিন্তু সব লেখার নিচেই ওর কায়দা করা একটা
অটোগ্রাফ ঠিক থাকত।
মাধ্যমিকের
রেজাল্টের পর বাবার খুব ইচ্ছা আমি টাউনের কোন এক নামি স্কুলে ভরতি হই। বেশ ভাল
নম্বর আমাদের সবার। আমি, মেঘা, তিয়াসা আর অনন্যা তখন নিয়মিত ছোটাছুটি করছি। তিনটে
স্কুলে ফর্ম তুলেছি কিন্তু ইচ্ছা চারজনে একই স্কুলে পড়ব। রাই চুপচাপ। ও আর পড়বে
না। কেই বা পড়াবে ওকে? আশে পাশের দুএকটা ছোট ছোট বাচ্চাকে পড়ানো শুরু করেছে রাই।
আমার জ্যাঠতুতো দাদা একটা স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক, যদিও স্কুলটা একটু দূরে তবুও।
দাদা বলেছিল রাই চাইলে ওই স্কুলে ভর্তি হতেই পারে, রাই রাজি হল না। অনেক বোঝালাম
কিন্তু ও রাজি হয়নি।
আমাদের স্কুল
শুরু হয়ে গেছে। স্কুল আর কোচিংয়ের চাপে প্রায় ওষ্ঠাগত প্রাণ। তার উপরে শনি-রবি
নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত করছি জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতির জন্য। তবু আমি নিয়মিত
রাইয়ের খোঁজ নিই। রাই এখনও সেই বাচ্চাগুলোকে পড়ায়। ভেবেছিলাম পরের বছর জোর করে ওকে
আবার স্কুলে ভর্তি করব। নাহ, সেটা আর হলনা। একদিন শনিবার রাতে বাড়ি ফিরে দেখি
টেবিলের উপর রাখা একটা চিঠিঃ
“লুকিয়ে গেলাম
কিছুদিনের জন্য। ভাবিস না, দেখবি আবার কোন একদিন হঠাৎ করে এসে ধাপ্পা দেব”।
আমরা দিক্বিদিক
শূন্য হয়ে রাইকে খুঁজেছিলাম কিছুদিন। থানা,পুলিশ কিচ্ছু বাকি রাখিনি।আমি লুকিয়ে ওর
বাড়িও গেছিলাম খোঁজ নিতে কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
“টুংটাং” – কলিং
বেলের আওয়াজে আমার ঘোর কাটল। সুব্রত ফিরল। ঘরে ঢুকেই আমার হাতে চিরকুটটা দেখে বলল
– “কী গো? পুরনো কারও প্রেমপত্র নাকি”? আমি বললাম – “প্রেমপত্রই বটে”। সুব্রত আমার
হাত থেকে বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল –“আরে! এ যে অদ্বিতীয়া
দেবীর অটোগ্রাফ। উনি নিজে তোমায় বইটা পাঠিয়েছেন? জানো এত কম বয়সে লেখার জগতে এরকম
সাফল্য সহজে দেখা যায়না। কি হল? কিছু তো বল? চেন না কি ওনাকে? হঠাৎ উনি তোমায় বই
পাঠালেন যে? এই আমায় একটা ইন্টারভিউ অ্যারেঞ্জ করে দাও না প্লিজ। ওনার এখন হাই
ডিমান্ড, পাবলিক হেব্বি খাবে..প্লিজ...প্লিজ”
কিন্তু আমি তখন
কিছু শোনার বা বলার মত অবস্থায় নেই। একদৃষ্টে চিরকুটটার দিকে থাকিয়ে আছি।
চিরকুটটায় লেখা ছিল – “ধাপ্পা”।
লড়াইটা
তো রাই জিতে গেছে কিন্তু এবার আমার লড়াইয়ের বাকি গল্পটা যে জানতে হবে।