সোনার থালার মত চাঁদ । আজ একাদশী । গতকাল পূর্ণিমা ছিল ।
পূর্ণিমার চাঁদ হয় রূপোলি । আর একাদশীর চাঁদ ? গোল সোনার থালা
যেন । চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে পশুপতি । তাকাতে তাকাতে চোখটা ভরে ওঠে । আহা , চমৎকার চাঁদটি । ছোটবেলায় বুড়ি ঠাকমা বলতো , ‘ কাঁদিস নে পশু , তোকে আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে দেবো ।”
পশুপতি
বলতো ,
“ ও ঠাকমা , চাঁদ দিয়ে
কি করতে হবে ? ” “ খেলবি । ’’ পশুপতি ভাবতো , ভারি মজা তো , চাঁদ নিয়ে খেলা ? তা সে
কেমন খেলা ? ঠাকমা বলতো , “
ঐ লোফালুফি খেলা ! তোর চাঁদ ওর হাতে , ওর চাঁদ তোর হাতে । ” বাহ , বেশ খেলা তো ! কিন্তু চাঁদের গায়ে ওসব কি ? কালো কালো
ছায়া ছায়া ? “
ঠাকমা গো , চাঁদের গায়ে ওসব কি ? কালো কালো , ছায়া ছায়া ? ” ঠাকমা
একটু ভেবে নিয়ে হেসে হেসে বলতো , “ হাতে পেলে
দেখে নিস বাছা । ” পশুপতি চাঁদ দেখতো । একটু একটু ভয় ভয় করতো । কেমন ভূতুড়ে ছায়া । অতো সুন্দর জিনিষটায় ওসব না থাকলেই তো হতো ।
পশুপতির
বয়েস হয়েছে । কত বয়েস ঠিক গুণে বলতে পারবে না সে । জন্মের সময় খুব খরা ছিল । ঠাকমা
বলতো । ঠাকমার কথা খুব মনে পড়ে । ঐ চাঁদের দিকে তাকালে আরও বেশি মনে পড়ে । পশুপতির
আজ সকাল থেকে জ্বর । সারাদিনে কিছু মুড়ি গেছে পেটে । জল খেতেও ইচ্ছে হচ্ছে না । বাড়িতে
কেউ নেই । পশুপতি একা । পাশের ঘরে ছেলে , ছেলের বউ আর নাতিপুতি আছে বটে , ওরা প্রায় দিন কেউ আসে না । সে নিজেই চারটি ফুটিয়ে খায় । মাঝে মাঝে ছেলের বউ একটা
দুটো তরকারি দেয় , মনে হলে , ইচ্ছে হলে
। চলে
যাচ্ছিল একরকম , গতকাল
থেকে জ্বর ।
ছনবাঁশের ঘর ।
ছেলে তার প্ল্যাস্টিক কারখানায় কাজ করে । পুরনো ভিটে । পাশাপাশি দুটো ঘর , দাওয়ায়
দাওয়ায় এঘর ওঘর চলাফেরা চলে । কিন্তু পশুপতি আজকাল ওদিকটায় যায় না । ভালোবাসা নেই , টান নেই , মমতা নেই । ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে সে , বয়সবেলায় হারিয়েছে বউ । ঠাকমা তাকে বড্ড ভালবাসতো ।
আজকাল
সন্ধ্যার পর মাটির দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে থাকে পশুপতি । শুক্লাতিথিতে চাঁদের গড়নে
বদল দেখে দেখে নেশা ধরে যায় । চাঁদের ছোটবেলা , মাঝবেলা , বুড়োবেলা , তারপর আঁধারে আঁধার । কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের গায়ে হেলাফেলার ছাপ । এই যেমন
তার দূর ছাই হওয়া বুড়ো জীবন । গায়ে হাজারটা অসুখ । আজ এই সোনালি চাঁদের গায়ে কালো
কালো ছায়া দেখে পশুপতি আর ভাবে ছোটবেলা থেকে ঐ চাঁদ তার সাথে জড়িয়ে গেছে দিব্যি । আজও
সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও চাঁদ তাকে ছেড়ে যায়নি । কাল থেকে চাঁদের ক্ষয় হবে ।
ক্ষয়ে ক্ষয়ে মিলিয়ে যাবে আঁধারে । তারপর নিশ্ছিদ্র আঁধার অমাবস্যা । মাথাটা খুব
ভারী হয়ে আসে , আর বসে
থাকতে পারে না পশুপতি । মস্ত গোল সোনালি চাঁদ মুখোমুখি তাকিয়ে থাকে । আজ তার গায়ের
কালো কালো ছায়াগুলো বড়ো বেশি স্পষ্ট ,
প্রকট ।