- ‘একটা গল্প বলনা পিপিয়া’
- গল্প? গল্প আমি একদম বলতে পারিনা, তুই
দিদিয়াকে জিজ্ঞাসা করে দেখ।
- ‘কেন ঠাম্মা তো পারে। রাত্তিরে শুয়ে
শুয়ে রোজ কত গল্প বলে আমায়। তুমি পার না কেন?’
-
ওই তো, দিদিয়াকেও তো ওর দিদামা-ই গল্প শোনাত আর ইসেমশাই। আমি একদম গল্প বলতে পারিনা রে। ঠাম্মা তো
সুন্দর লিখতে পারে, তাই সুন্দর গল্পও বলতে পারে।
- ‘তুমিও তো লেখ। তাহলে তুমি কী পার?’
- হুমমম...আমি তো সত্যি লিখি তাই সত্যি
বলতে পারি।
- ‘গল্প কি মিথ্যে নাকি? সিন্ডারেলা,
স্নো-হোয়াইট সব মিথ্যে?’
- গল্প? গল্প ঠিক সত্যিও না আবার মিথ্যেও
না। ওটা সত্যি দিয়ে বানিয়ে তোলা মিথ্যে। মিথ্যের ভেতরও খুব ভালো করে খুঁজলে সত্যি
পাওয়া যায়।
- ‘তাহলে আমাকে একটা সত্যি বল।’
- সত্যি? সত্যি ভারি কঠিন রে, ছোটদের
শুনতে নেই। বড় হলে সবাই নিজে নিজেই জেনে যায়।
-
‘সত্যি কি ভূত যে ছোটদের শুনতে নেই? আমাদের স্কুলে খুব কঠিন অঙ্ক দেয়, আমি তো করি।
ইঁ ইঁ ইঁ ইঁ...আমাকে সত্যি বল...’
- দাঁড়া, অমন বিচ্ছিরি করে চ্যাঁচাবি না,
কানে লাগে। চুপ করে বোস। ধর একটা মেয়ে ছিল।
- ‘ধরব কেন? মেয়েটা কি সত্যি ছিল না?
তাহলে সত্যি হল কি করে?’
- আচ্ছা, আচ্ছা, একটা মেয়ে ছিল।
- ‘কত বড় মেয়ে?’
- এই ধর কলেজে পড়ে।
- ‘আমি জানি কলেজ কী? স্কুলের পরে কলেজে পড়তে হয়। আবার
ধরব কেন?’
- হুঁ, তুই তো সবই জানিস। আচ্ছা বেশ, ধরতে
হবেনা, কলেজে পড়ে। তো সেই মেয়েটা ভারী গরীব ছিল।
- ‘সিন্ডারেলার মতো? ওর কি স্টেপ মাদার
ছিল?’
-
না রে, নিজের মা-ই। ও রোজ কলেজে পড়তে যেত, তারপর দুটো বাচ্চাকে পড়িয়ে অনেক
রাত্তিরে বাড়ি ফিরত। কলেজ ছিল কলকাতায়, আর ওর বাড়ি ছিল গ্রামে। লেখাপড়ায় খুব ভালো
ছিল। তোর মতো ফাঁকিবাজ নয়।
- ‘আমি সব হোমওয়ার্ক করে রাখি, মাকে
জিজ্ঞাসা কোরো।’
-
বেশ, গুড গার্ল। তো ওই মেয়েটাও সব হোমওয়ার্ক করে ভালো রেজাল্ট করে স্কুল পাস করে
কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেখানেও ভালো রেজাল্ট করত। তো একদিন হয়েছে কি, ও
স্টেশন থেকে নেমে যে রাস্তা দিয়ে ফিরত সেই জায়গাটা বেশ অন্ধকার অন্ধকার ছিল।
গ্রামের লোকজন কতবার বিডিও-র কাছে গেছে, স্থানীয় নেতাদেরকে বলেছে যে ওখানে আলো
লাগাতে। ওখানে বসে যেসব দুষ্টু লোকেরা মদ খায় তাদেরকে সরিয়ে দিতে, তো সবাই হ্যাঁ
হ্যাঁ বললেও, কেউ কথা রাখেনি।
- ‘নেতা কি, বিডিও কী - রাজা-মন্ত্রী? মদ কেমন খেতে?
দুষ্টু লোকেরা মদ খায় কেন?’
- তা বলতে পারিস। এখন তো আর রাজা-মন্ত্রী
নেই, আছে সরকার। ওরা সব সরকারের লোক। মদ হল একরকম লিকুইড, খায়। কোল্ড ড্রিঙ্কস নয়।
বিচ্ছিরি খেতে। ওসব কেউ কেউ খায় যাদের ভালোলাগে। দুষ্টু লোকেরাও খায়। খেলে যা নয়
তাই মনে হয়।
- ‘বললে কী করে? তুমি খেয়েছ? তুমি তো দুষ্টুমি কর না।’
-
হ্যাঁ, টেস্ট করেছি, বললাম তো বিচ্ছিরি খেতে। তারপর একদিন হয়েছে কি, ওই অন্ধকার
রাস্তা দিয়ে মেয়েটা আসছে আর দুষ্টু লোকেরা ওকে ধরে নিয়ে একেবারে আঁচড়ে, কামড়ে, সে
এক বিভৎস অবস্থা।
-
‘ওরা কি মদ খেয়ে রাক্ষস হয়ে গিয়েছিল? তোমার সত্যি বিচ্ছিরি। ঠাম্মার গল্পই ভালো।
সিন্ডারেলা, স্নো-হোয়াইটে বিচ্ছিরি একটা স্টেপ মাদার থাকে কিন্তু পরে ভালো একটা
প্রিন্স চলে আসে। তোমার সত্যিতে প্রিন্স নেই?’
-
না রে, সত্যিতে কোনও প্রিন্স থাকে না। আর যদি থাকেও তাহলে সত্যিকারের প্রিন্সদের
গল্পের প্রিন্সদের মতো অত সাহস থাকে না। তুই ঠিক বলেছিস, ওরা তখন রাক্ষস হয়েই
গিয়েছিল। তারপরে তো লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে হৈ হৈ করে গিয়ে দেখে মেয়েটা মরে
পড়ে আছে আর রাক্ষসগুলো সব পালিয়েছে। মেয়েটার বাবা তখন কাঁদতে কাঁদতে পুলিশে গিয়ে
নালিশ করল।
-
‘তারপর পুলিশ এসে দুষ্টু লোকগুলোকগুলোকে মারল তো? আমি জানি পুলিশেরা দুষ্টু লোককে
মারে। আমি যখন খেতে চাই না তখন ইনাই মাসি বলে, তুমি খাচ্ছ না তো, আমি মাকে বলে
দেব। আরও দুষ্টুমি করলে বলে, পুলিশ এসে মারবে। আর তক্ষুনি আমি লক্ষ্মী হয়ে সব খেয়ে
নিই।’
-
নারে ওটাও গল্প। সত্যি সত্যি পুলিশের লোকেরা এসে মেয়েটাকে নিয়ে গেল। আর বাকি যারা
দুষ্টুদের শাস্তি চাইছিল তাদের বকাবকি করে বলল, একদম গোল কোরো না, তাহলেই ধরে জেলে
পুরে দেব। তারপর পরেরদিন সেই নেতা এলো। এবার আরও নরম করে মেয়েটার বাবার হাতে অনেক
টাকা, হাজার হাজার টাকা দিয়ে বলল, যা হবার তো হয়েই গেছে, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে
ওরা। আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনারা বরং ওকে এনে পুড়িয়ে ফেলুন, আমরাই সব ব্যবস্থা
করে দিচ্ছি, আপনার কোনও চিন্তা নেই। থানা-পুলিশ এসব করলে বুঝতেই পারছেন কখন কি
হয়...। ওরা তো এলাকারই ছেলে। আমি দেখছি ওই রাস্তাটায় দু-চারদিনের মধ্যেই আলো
লাগিয়ে দেব। আপনার একটা ছেলে আছে না বড়? ওকে আমার কাছে একটু পাঠিয়ে দেবেন, দেখছি
সরকার থেকে একটা চাকরি যদি দিতে পারি...।
-
‘আর দুষ্টুদের শাস্তি দেবে বলল না? অ্যাঁ, অ্যাঁ, অ্যাঁ ঠাম্মার গল্পে তো দুষ্টুরা
শাস্তি পায়। রাজা হলেও পায়। জানো না তুমি, কিচ্ছু জানো না। বিচ্ছিরি সত্যি। তোমার
সত্যি আমি আর শুনব না।’
-
হ্যাঁ রে, সত্যি বিচ্ছিরিই হয় তোকে তো আগেই বললাম। তাও দুষ্টুদের শাস্তির জন্য
গ্রামের লোকজন লড়েছিল রে অনেক, কিন্তু কিচ্ছু হলনা। মেয়েটার বাবা-মা, দাদাই তো
টাকাপয়সা নিয়ে, চাকরি নিয়ে সেই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। ওদেরও দোষ
ছিলনা। দুষ্টুগুলো আর সেই মন্ত্রী তো ওদের মেরে ফেলার ভয়ই দেখিয়েছিল। মরা মেয়ের
জন্য মরার থেকে নিজেদের জন্যই বাঁচা ভালো মনে হয়েছিল ওদের।
সত্যি,
সত্যি সত্যিই খুব বিচ্ছিরি। যত বড় হবি দেখবি সত্যিগুলো চারদিক থেকে কেমন চেপে বসছে
আর গল্পেরা আবছা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এসব সত্যি তো শুনতে হয় না রে। মেয়েরা আপনিই জেনে
যায়, নিজে নিজেই।