গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আফরোজা অদিতি

বন্ধনজুটি

   মন খারাপ বাবুর। জীবনের প্রথম কাজটি কেঁচে গেল। এভাবে কেঁচে যেতে পারে ভেবেছিল একবার তবুও মনের ভেতর ছোট শিখা নিয়ে জ্বলতে শুরু করেছিল আশার প্রদীপ। মনে মনে হাসে বাবু। ওটা আশার প্রদীপ ছিল না ছিল কুপি বাতি। টিমটিমে আলোর কুপি বাতিতে ছিল না তেল; সলতেও ছিল ছোট।
   সব কিছু না জেনে না বুঝে হাত দিয়েছিল কাজে, যা করা উচিত হয়নি। বাবু ঠিক ঘটক নয়; বন্ধুর অনুরোধে ওর এক কলিগের ভাইয়ের সফরসঙ্গী জুটিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে জীবনবৃত্তান্ত দিয়েছিল একটি মেয়ের। জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে কথাবার্তা বলার সঙ্গে সঙ্গে চাউর হয়ে গেছে জুটি মেলাবার কথা। কলিগরা যারা একটু কাছের তারা তো ওকে ডাকতেই শুরু করেছে ঘটক বাবু খন্দকার। সেই সঙ্গে বলল,‘বন্ধনজুটি’ নাম দিয়ে একটি এজেন্সি খুলতে। বিবাহ বন্ধনের ঐ প্রতিষ্ঠানের এমডি কে? এমডি হবে বাবু খন্দকার। ঘটক পাখি ভাইয়ের মতো নাম ছড়িয়ে পড়বে জেলায় জেলায়। ভালো কাজ; দুটি অধরা জীবনের মিলন ঘটানো খুবই ভালো কাজ। কিন্তু প্রথমটিই গেল কেঁচে, কিছুই হলো না।

   ওতো ঘটক পাখি ভাই হতে চায়নি, হতে চায়নি ম্যাচমেকার, শুধু চেয়েছিল একটু সাকসেস। জীবনের প্রথম কাজের সাফল্য কে না চায়। কিন্তু ঈশ্বরের নিয়ম বোধহয় এটাই; ওর জীবনে সাফল্য এতো সহজে আসে না। একবারে সাকসেসফুল হতে পারে না কখনও। বিয়েটা এমনি এক বিষয় যেখানে যার জুটি লেখা থাকে সেখানেই হয়! একবার ওয়াজ শুনেছিল যে পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে যে নারীর সৃষ্টি, সেই নারী পুরুষেরই বিবাহ হবে। এই নাকি নিবন্ধন!

   একথা বিশ্বাস করে না বাবু। ওর মনে সবসময়ই একটি প্রশ্ন আঙুল উঁচিয়ে আছে, যে নারী বা পুরুষের একের অধিক বিয়ে হয় তাদের পাঁজরের হাড় কয়জনের কীভাবে মেলানো হয়? বা হয়েছে ? বিস্ময়কর এই কথা মনে হলে হাসি পায় বাবুর কিন্তু এখন পাচ্ছে না। বুকের মধ্যে এক কষ্টবোধের জন্ম হচ্ছে। কষ্টবোধের জন্ম হচ্ছে ঐ মেয়েটার জন্য! দেখতে পরীর মতো  না হলেও সুন্দর। গতকাল ফোন করেছিল পাত্র পছন্দ হয়নি মেয়ে। ফোন পাওয়ার পর থেকেই মন খারাপ ছিল, এখন ছবি-বায়োডাটা ফেরত দেওয়ার পরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছে না। ছবি দেখে যদি পছন্দ না হবে তাহলে ঘটা করে মেয়ে দেখতে যাওয়া কেন? মেয়েটি সেলাই জানে, লেখাপড়াতে ডিঙিয়েছে শেষ ধাপ। চাকরি করে। তাহলে! অযোগ্য কোথায়!

    কয়েকদিন আগে গিয়েছিল মেয়ের বাড়ি; পাত্র, পাত্রের ভাই ভাবী আর ও-নিজে। বাবু সেলাই জানে না তবুও বলতে পারে রঙের কম্বিনেশন আর সেলাই দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। রান্না সেদিন মেয়ে একাই করেছিল। সে খাবারের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে যেন বাবুর! এতো কাজের যে মেয়ে তাকে পছন্দ নয় ভাবতেই রাগের জন্ম নেয় ওর মনের মধ্যে। মেয়েদের বায়োডাটা দেওয়া, মেয়ে দেখানো দেখে মনে হয় এ সমাজ সেই অন্ধকার মধ্যযুগেই পড়ে আছে আজও। একবিংশ শতাব্দিতে দাঁড়িয়েও সেই পুরানো সংস্কার আঁকড়ে ধরে আছে সকলে! এসব পরম্পরা মেনে চলছে পরিবার সমাজ। ও এসবের পক্ষপাতি নয় ও! মেয়ে দেখানোর বিপক্ষে জেনে তো এক বন্ধু বলেই ফেলল, তুই তো কখনও ঘটকালি  তো নয়ই বিয়েই করতে পারবি না। মেয়ে যদি না দেখা হয়, মেয়ের সঙ্গে যদি কথা না হয় তাহলে কেমন করে মেয়ের সঙ্গে জানাজানি হবে। অন্ধবিশ্বাসে কী জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া যায়?

   তোর কথাই ধর, তোর বিয়েতে কী করবি; তুই তো মেয়ে পছন্দ করে রাখিসনি তাহলে! বিয়ে তো তোকে মেয়ে দেখেই করতে হবে। হাজার হোক বিয়ে হলো এক জীবনের ব্যাপার; বউ বা স্বামী হলো জীবনসঙ্গী। বাবুর মন একটু নরম হয়। তারপরেও মনে হয় সারা জীবনের ব্যাপার বলে ঘটা করে মেয়ে দেখতে হবে! রাতে একবার দিনে একবার। এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চুল খুলে, পা দেখে হাত দেখে তারপর না করা। বাবুর রাগ সপ্তমে উঠতে থাকে। মনে মনে বলে, এই মেয়ে পছন্দ করলে না, দেখবো কোন ঐশ্বর্য রাই, সুস্মিতা না বিশ্বসুন্দরী আগবানি দারোগা জুটাতে পারো তোমরা!

   ভালো চাকরি করে বাবু। বিয়ে করেনি এখনও। মেয়ে পায়নি তা নয়, বিয়ের কথা চিন্তা করেনি এ পর্যন্ত। ওরা চার ভাই বোন। ও সকলের ছোট। বড় তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে, চুটিয়ে সংসার করছে। আর ওর পেছনে বিয়ে কর বিয়ে কর বলে ঘ্যানরঘ্যানর করছে। মা তো প্রতিদিন খাবার টেবিলে বলছে একবার! মা-কে বলেছে একটু সবুর করো মা, চাকরিটা একটু গুছিয়ে নেই। মা তবুও একটা বলেই চলেছে।

  অফিসের কাজে মন দিতে পারছে না বাবু। কী করবে তাই ভাবছে, কী জবাব দিবে মেয়ের ভাইয়ের কাছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বিষয়টা মনের ভেতর জলছাপের মতো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। কাজে মন দিতে পারছে না! ভুল হচ্ছে বারবার। সামনে ফাইল নিয়ে চুপ করে বসে আছে ও।

   পিয়ন এসে বলে, স্যার ফোন। ফোনের কথা শুনে চমকে ওঠে, মেয়ের ভাই নয় তো। মেয়ের ভাইকে কী বলবে! চন্তা করতে পারছে না! ওর কী চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। এক একবার এক এক কথা মনে হচ্ছে। একবার ভাবল যদি ভাই ফোন করে তাহলে ভাইকে বলবে, ছেলে জানায়নি এখনও! একবার ভাবল বলবে, গার্জেন লেভেলে আলাপ-আলোচনা চলছে, নাকি সরাসরি বলে দিবে মেয়ে পছন্দ হয়নি ওদের! আর একটা পাত্রের সন্ধান করছি দাদা! গোলমেলে এসব কথা ভাবতে ভাবতে ফোন ধরে বাবু। ঠিকই ধরেছে মেয়ের ভাই। বাবু এতক্ষণের গুছিয়ে রাখা কথাগুলো বলতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজের কথায় নিজেই অবাক হয়! বাবু নিসংকোচে বলা কথায় নিজেই আশ্চর্য হয়! নিজের শ্রবণেন্দ্রীয়কে বিশ্বাস করতে পারছে না ! মেয়ের ভাইকে এক নিঃশ্বাসে  বলে চলেছে, ও পাত্র থাক না দাদা, আমাকে কী পছন্দ নয় আপনাদের, বিশেষ করে অমৃতার!