একদিনও আড্ডার ঠেক-এ না গেলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না । অফিস থেকে
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই হিরোহোন্ডার হর্ণ ।
স্বপ্নময় এসে হাজির । একসঙ্গে চাকরী করার সুবাদে সবসময়ের বন্ধু স্বপ্নময় । মাঝে
মাঝে গিন্নী বিরক্ত হয়ে বলে – তোমার বন্ধুদের কি বাড়িঘর নেই । আমি শুধু হাসি আর
মনে মনে ভাবি স্বপ্নময়কেও একই কথা শুনতে হয় হয়ত । জামা গলিয়ে বেড়িয়ে পড়ি ।
আড্ডার ঠেক মানে শহরের মেইন রাস্তার ধারে একটা পিসিও বুথ সাথে
মিনারেল ওয়াটার কোল্ড ড্রিঙ্কস স্ন্যাকসের প্যাকেট ইত্যাদির দোকান । মালকিন এক
বয়স্কা মহিলা ও তার যুবতী মেয়ে । এই দোকানের ঠিক পাশের বন্ধ দোকানটাও ওদের ।
সেটারই আলোআঁধারি চওড়া সিড়িতে আমাদের আড্ডাস্থল । আমাদের মত চল্লিশোর্ধ মানুষেরা
বসলে কমবয়সীরা দখল করতে পারবে না । যুবতী মেয়ের কথা ভেবেই মালকিন নিজেই চাইতেন
যাতে আমরা ওখানে বসি । সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অব্দি চলত কথার জলসা । রাজনীতি প্রেম
খেলাধুলা পরচর্চা সব ধরণের আলোচনা ।
স্বপ্নময়ের বাইকে চড়ে কখনও চলে যেতাম জুবিলি পার্কের স্পারে যেখানে
তিস্তার অপরুপ সৌন্দর্য্য মন কেড়ে নেয় । স্পারের শেষ মাথায় একটা গাছ জল ও জমির
সীমান্তরক্ষীর মত দাঁড়িয়ে । সেচদপ্তরের বানিয়ে দেওয়া কংক্রীটের বেঞ্চে বসে কেটে
যেত সময় । রাতে হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফেরা । ভরা পূর্ণিমায় আকাশজুড়ে চাঁদের মোহিনী
আলো ভেসে বেড়ায় তিস্তার বুকে আর স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল যেন এক হয়ে যায় ।
দোলের সময় এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকি । সক্কাল সক্কাল বাজার করে এনে
ঘরে বসে যাই । টিভি দেখে লেখালেখি করে দিন কেটে যায় । ছেলের বন্ধুরা আসে । পায়ে
আবির দিয়ে প্রণাম করে কেউ । মিষ্টিমুখ করে হৈহুল্লোর করে বেড়িয়ে যায় । বিশেষ কারণ
ছাড়া সন্ধ্যায় আজকাল কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে
করেনা আজকাল । জীবন যত বাড়ে স্বজনবান্ধব হারানোর মাত্রাও বাড়ে ।
রাতে হর্ণের আওয়াজে ধড়মড়্ করে উঠি । সেই চেনা ডাক । পাঞ্জাবীটা
গলিয়ে বেড়িয়ে পড়ি বাইকে চেপে । ফিসফিস করে যেন বলে – চ আজকে চাঁদের আলোয় আড্ডা দেব
। আমিও খুশি কারণ কতদিন বাদে আবার যাচ্ছি । বাঁধের ওপরে বাইকটা স্ট্যান্ড করে
স্বপ্নময়ের পিছু ধরলাম ওই গাছটার দিকে । হঠাৎ দেখি স্বপ্নময় যেন হাওয়ার মত মিলিয়ে
গেল । তখনও গাছটার কাছে যেতে বেশ কিছুটা পথ বাকী । চমকে উঠে দেখলাম গাছের নিচের
বেঞ্চে বসে স্বপ্নময় আমাকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে । আমি চেয়ে দেখি একদম মাঝ আকাশে
বিশাল চাঁদ । তবে তো এখন মাঝরাত !
হুশ ফিরল । স্বপ্নময় তো কয়েক বছর হল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছে
! ওর ছেলেটা চাকরী পেয়ে গেছে । স্ত্রীও সরকারী চাকরি করে । তাছাড়া কর্মরত অবস্থায়
মারা যাওয়াতে প্রাপ্য অনেক টাকাও পেয়ে গেছে পরিবার । যাত্রী নামিয়ে জীবনের ট্রেন
আবার স্বাভাবিক ছন্দে ও গতিতে এগিয়ে চলে সব পেছনে ফেলে ।
আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুট্ দিলাম উল্টোদিকে । চিৎকার করে
বললাম – ক্ষমা করে দে বন্ধু। আমার ছেলেটার সবে পড়াশোনা শেষ হল । এখনও বেকার । আর
কটা দিন ...আর কটা দিন...