গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর হান্টেড কাহিনী--১১
                                             
  পিপ্পল বৃক্ষ


জবলপুরের বিটি তিন রাস্তার মোড়ে আজও সেই পিপ্পল গাছ যুগান্তরের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছকে জুড়ে অনেক ভৌতিক কাহিনী আজও স্থানীয় লোকের মুখে মুখে ফেরে। এসব কাহিনীর মধ্যে এক প্রেম কাহিনীর কথা আমার স্মরণে আসছে

এও এক যুগান্তর পার করা কাহিনীই বলতে হয়। কবিনের সময়েও সে পিপ্পল বৃক্ষ ছিল। তেমনি ঝাঁপড়ানো ছিল সে গাছ যেন এক দিকে মাটি আর অন্যদিকে আকাশ ছুঁয়ে নেবার চেষ্টায় সাদা ব্যস্ত। গাছের অসংখ্য ঝুড়ি ডালপালা নিয়ে সে আপন মনে দাঁড়িয়ে থাকতো। আশপাশের লোকরা অনেকেই আবার মানত করেও যেত। মনের অভীষ্ট ফেললে তারা এসে দিনের বেলায় ধুপ ধুনা জ্বালিয়েও যেত। কেউ কেউ পিপুল পাতার ওপর সাজিয়ে ভোগ প্রসাদের পূজা দিয়ে যেত। এক সঙ্গে ভয় ও ভক্তির নিবাস ছিল এই পিপ্পল বৃক্ষের তলা

কবিন যুবক। সেও জানত সব। তবু সে ওই পিপ্পল বৃক্ষের নিচে দিয়েই যাতায়াত করত। তবে হ্যাঁ, রাত দশটার পরে হলে সেও আধ কিলোমিটার ঘুরেই নিজের বাড়ি পৌঁছাত
সেদিন একটু তাড়া ছিল কবিনেরপিপ্পল গাছের কাছে এসে সাইকেল দাঁড় করিয়ে ভাবছিল কোন রাস্তা ধরে ঘরে যাবে। হাতঘড়ি দেখে নিলো, রাত সাড়ে দশটা বাজে। চারদিকে অন্ধকার যেন একটু বেশী। হতে পারে কোন অন্ধকারের তিথি হয়ত সামনে আছে। যাক গিয়ে, একটু তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ফিরতে হবে। কলেজের প্র্যাকটিকালের খাতা জমা দিতে হবে কাল। ভেবে সাইকেলে চড়তে যাবে ঠিক এমনি সময় দেখল, পিপ্পল গাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে তার রাস্তার ওপরেই কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। ভয় হল তার, সে তবু দাঁড়ালো। এদিকেই আসছে ছায়াটা--সাইকেল ছেড়ে ছুটে কোথাও কবিনের আর পালানো হল না। অগত্যা চোখ ফেরাতেই সে দেখতে পেলো, আরে, নাজ না ! কিন্তু সে এখন কোথায় ? আরও কিছু যেন ভাবার ছিল কবিনের কিন্তু ভাবনা কিছুতেই সে যেন আগে নিয়ে যেতে পারছিল না। নাজ তার কাছে এসে গেলো। হাসল, কথা বলে উঠলো, কি রে কোথায় যাচ্ছিস ?

চারদিক অন্ধকারের মধ্যেই কবিন নাজকে কিন্তু দেখতে পার ছিলও আর নাজ এক কলেজেই পড়ত না পড়ত না, পড়ে।
একটু আগে যতই অন্ধকার ছিল না কেন, এখন চারদিকে তাকালে মনে হবে, না, আজ পূর্ণিমা হবে। কিন্তু এত আলো কেন ? এদিকে তো স্ট্রিট লাইট নেই ! কিংবা কবিন কি কোন অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ! না, এমন চারদিকের পরিস্থিতি হলেও সে কিন্তু নাজ আর সুন্দর একটা রাত ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিল না। শুরুতে ও একবার চমকে উঠে পেছনের দিকে তাকিয়ে ছিল বটে। কিন্তু সে যখন তার সামনে থেকে ডাক শুনতে পেলো তখন--
--হি হি হি, সামান্য হাসির সুর কানে এলো। চমকে সে দিকে তাকাল কবিন
--এই কবিন, আমি রে আমি, নাজ--
--তুই এখানে এখন ? কবিন কিছু যেন একটা ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো।
--তোকে দেখলাম, তুই এ রাস্তা ধরবি কিনা ভাবছিস, তাই--

নাজ কবিনদের বাড়ির টা ঘর পরেই থাকে। মাঝখানে কেন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল ব্যাপারটা এ মুহূর্তে কবিনের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না। ওর সঙ্গে ছোট বেলা থেকেই তার চেনা জানা। নাজ দেখতে খুব সুন্দরী। ঘর থেকে বাবা মা কবিনকে সাবধান করে দিয়েছিল, এই নাজের সঙ্গে কিন্তু বেশী মেলামেশা করিস না। ওরা জাতিতে মুসলমান। তাই মনে মনে যাই থাক, সে আর বেশী একটা এগোয়নি নাজের দিকে, তবে নাজের দিক থেকে একটু টান যেন সে বরাবরই অনুভব করতে পারত। বেশ অনেক দিন আগে হবে নাজকে লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে দু এক দিন সে কলেজে যাতায়াত করেছে, অবশ্য সেটা বিশেষ প্রয়োজনে।
চারদিক বেশ প্রসাধনী গন্ধে ম ম করছিলো। কবিন জানে নাজ বরাবরই সাজগোজ করতে ভালবাসে। ওর পাশে যত বারই সে ঘেঁষেছে তত বারই মন ভরপুর গন্ধ বরাবরই তার আশপাশে পেয়েছে। আজ নাজের প্রসাধনী গন্ধ তাকে কেমন যেন মাতোয়ারা করে তুলচ্ছিল

--নে সাইকেল চালা--সাইকেলের পেছনের সিটের দিকে গিয়ে নাজ কবিনের দিকে তাকিয়ে বলল
--তুই এখানে কি করে এলি ? কখনও সম্বিৎ ফেরার মুহূর্তে কবিন যেন বাস্তবে ফিরে আসছিল, আবার মোহময় পরিবেশে সে ফিরে যাচ্ছিলো।
নাজ কিছুটা হেঁয়ালির মত বলল, ওই তো ভাবলাম আজ আমি তোর সাথে একটু সময় কাটাবো, কথার মাঝখানে মাঝখানে নাজ একটু বেশী হাসছিল, হি হি হি, করে।
 না, কিছুতেই চলছে না, সাইকেল কেন যেন ভীষণ জাম হয়ে গিয়ে ছিল
--আজ রাতে তোর সাইকেল চলবে না, আমি জানি।
--কেন ?
--এমনি চাঁদনী রাতে তোকে কেন যেন খুব ভাল লাগছে রে !
--কি বলছিস তুই ?
--ঠিকই বলছি, নাজ বলল, সাইকেল রাখ ! আয় আমরা ওই পাথরের ওপরে একটু বসে নিই।
কবিন কি ভাবছিল কে জানে, সে কিছু না বলে চারদিকে স্বাভাবিক চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলসত্যি জ্যোৎস্না রাত, নাজের গায়ের সুরভী গন্ধ, তাকে আরও মোহিত এক সুন্দরী নায়িকার মত লাগছে। নাজ কিছু না বলে ধীরে ধীরে পা পা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার মাঝে মাঝে সে তার আধ মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে কবিনের দিকে হাসি মুখে তাকাচ্ছিলপিপ্পল গাছের একেবারে পাশটাতে আধ মিটার উঁচু একটা পাথর, দেখলে মনে হবে ওদের দু জনের বসার জন্যেই বুঝি বানানো ! অরা দুজন সেই পাথরের ওপরে গিয়ে পাশাপাশি লাগালাগি হয়ে বসল।

কবিনের মধ্যে আলাদা কিছু ভাবনা ছিল না--ঘটমান বর্তমানই যেন তার সবকিছু !  সে চারদিকে একবার তাকাল। তার মাঝে নাজ বলে ওঠে,  একটা কথা  ভাবছিলাম---কি কথা ?
খানিক স্তব্ধতার পর নাজ ধীরে বলে উঠলো, আমি তোকে ভাল বেসে ফেলেছি রে--
কবিন এবার নাজের দিকে তাকাতে চেষ্টা করলো। নাজের আয়ত দুটি চোখ, ঢুলুঢুলু  মায়ায় যেন ঝুঁকে পড় ছিলওর পরনে সবুজ ফিনফিনে একটা শাড়ি। কপালে টিপ, চাঁদনীতে জ্বলজ্বল  করছে। ওর মুখমণ্ডল এত উজ্জ্বল চকচকে আগে তো কবিন কোন দিন লক্ষ্যই করেনি !
--কি দেখছিস ? আমায় পছন্দ না ? বলে আবার খিলখিল হেসে উঠলো নাজ।
--দেখছি আজ তোকে খুব ভাল লাগছে রে ?
--তবে তোর হাতটা দে না !
--কি হবে ?
হাসল নাজ,  ছুঁয়ে  দেখি আমার প্রেমিকের হাত !   
কবিন তার হাত দিয়ে নাজের হাতটা ধরল, বাঃ, বেশ হালকা, মোলায়েম, নাজের হাত, মেয়েদের হাত বুঝি এমনি হয় ? কবিনের মধ্যে শুধু প্রেমিকের ভাব জেগে উঠছিলওরা উভয়ে উভয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এদিকে কে জানে বাইরের জগতের কতটা সময় কেটে গেছে !

এমনি কত সময় কেটে গেছে কবিন তার কিছুই জানে না. ওর ঘুম-তন্দ্রা যখন কাটল ও দেখল ও পিপুল গাছের তলায় শুকনো পাতার ওপরে শুয়ে আছে। তার আবেগ আবেশ তখনও যেন পুরপুরি কেটে ওঠেনি। গাছের তলা ঝাঁপানো শাখা-প্রশাখার অন্ধকারে ছেয়ে রয়েছেতবে চারপাশ থেকে ভোরের আলো তার চোখে এসে ধরা পড়ছিলনাজের কথা মনে হল তার। আর মনে পড়তেই একটা প্রচ্ছন্ন হালকা সুগন্ধ তার নাকে এসে ঠেকলকিন্তু, কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো নাজ তো বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছে ! মনে হতেই দিনের চৈতন্যে সে ভরপুর হয়ে যেন জেগে উঠলো। ধড়ফড় করে সে উঠে দাঁড়াল, দ্রুত সে এগিয়ে গেলো নিজের সাইকেলের কাছে আর বিনা বাক্যব্যয়ে সে সাইকেলে চড়ে ঘরের দিকে রওনা দিলো।  

ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায় নি। সে দিনের ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন কবিন নিজের অজান্তেই কি না সে তা জানে না নাজের প্রেম পিপাসাতেই হবে, রাতের অন্ধকারে গিয়ে হাজির হয় সেই পিপ্পল গাছের তলায়। আজকাল প্রতিদিন সে নাকি নেশায় থাকে ! নবীনের মা-বাবা, আশপাশের পারা-প্রতিবেশী সবাই জেনে গেছে কবিনের এ ঘটনার কথা। কিন্তু অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও তাকে প্রকৃত নেশা থেকে ছাড়াতে পারলেও অশরীরী নাজের প্রেমের নেশা থেকে কেউ তাকে ছাড়াতে পারেনি।

এ ঘটনা বহুদিন আগের, আজ সময়ের ব্যবধানে জীবনের কত পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে কবিনকে কেউ আর চেনে না। তার বাবা মা ভাই বোন কে আছে, কে নেই, কেউ তার খোঁজ রাখে না।    
শোনা যায় আজও নাকি এক বৃদ্ধ পাগল রোজ রাতে শুয়ে থাকে সেই পিপুল বৃক্ষের তলায়। দূর থেকে পথ চলতি লোকদের কানে ভেসে আসে সে বৃদ্ধের ফিসফাস কথার আওয়াজ। সে বৃদ্ধ যেন কারও সঙ্গে কথা বলে চলেছে ! তবে আজ আর কেউ বলতে পারে না যে সেই পাগলই অতীতের সেই কবিন কি না !