গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়।

মধু

সেই কোন ছেলেবেলায় তাকে স্বামীর সাথে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ভাল পাত্র পাওয়ায় খুব অল্প বয়সেই বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন আদরের ভাই, হর্ষ তখন কতই বা বয়স, সাত-আট বছর হবে তার থেকে হর্ষ প্রায় দশ বছরের ছোট। 

ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে দয়ামায়া ব্যাপারটা অস্বাভাবিক রকমের বেশী ছিল কোথা থেকে ভিখারী ডেকে এনে চুপিসারে রান্নাঘর থেকে ভাত, রুটি, তরকারী নিয়ে এসে তাদের খেতে দিত মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে পয়সা নিয়ে তাদের দিত গ্রামের সুফলের মা টি.বি. হয়েছে শুনে, বাবার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরি করে তাদের দিয়ে বলেছিল— “ডাক্তার দেখিও এর জন্য পরে ধরা পরে বয়সে বাবার কাছে বেদম মারও খেয়েছিল অথচ টি.বি. রোগটা যে কী, তা কিন্তু সে জানতোও না মা বলতো বড় হয়ে হরিশ চন্দ্র হবে বাবাও তার এই দানধ্যানের লক্ষণটা ভাল চোখেই দেখতেন বাবা তাকে হর্ষবর্ধন বলে ঠাট্টা করতেন ক্রমে ঠাট্টাটা বাস্তব রুপ নিয়ে তার নাম, হর্ষবর্ধনই হয়ে গেল ভাইকে আদর করে সে হর্ষ বলে ডাকতো
বিয়ের পর স্বামীর সাথে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়াতে হয়েছে স্বামীর বদলির চাকরী, ছুটিছাটা নেই বললেই চলে ফলে মাসে মাসে বাপের বাড়ি আসার সুযোগ মিলতো এরপর আবার অফিসের কাজে বিদেশ চলে যেতে হওয়ায়, তাও বন্ধ হয়ে যায় ইচ্ছা থাকলেও নানা অসুবিধায়, আজ প্রায় দশ-বার বৎসর বাপের বাড়ি যাবার সুযোগ হয় নি বৃদ্ধ বাবা-মা, দুজনেই অসুস্থ, হর্ষর কাছেই থাকেন হর্ষর বয়স এখন কত হবে, বছর ছাব্বিশ সাতাশ? হ্যাঁ তাই হবে, তার নিজের বয়সই তো সাঁইত্রিশ

হর্ষর ছেলেটা দুবছরের কিন্তু ছেলেটা পঙ্গু পা দুটো ভীষণ ভাবে বাঁকা অনেক চিকিৎসা করিয়েও কোন লাভ হয় নি ডাক্তার জানিয়েছে সে কোনদিন হাঁটতে পারবে না হর্ষর বিয়েতে সে আসবে বলেও আসতে পারে নি রুগ্ন ছেলেটাকেও একবার দেখতে আসার সুযোগ পর্যন্ত হয় নি এতদিন পরে, দিন দশেক সে দেশে ফিরেছে স্বামী কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছে দক্ষিণ কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটও অফিস- ব্যবস্থা করে দিয়েছে সামনের বুধবার ভাইফোঁটা হর্ষকে সে ভাইফোঁটায় আসতে বলে চিঠি দিয়েছে হর্ষ সম্মতও হয়েছে

জানালার ধারে বসে পার্ব্বতী এইসব কথাই ভাবছিল হর্ষর সাথে অনেক বছর যোগাযোগ নেই ওকে দেখলে চিনতে পারবে তো? এখন কী কী খেতে ভালবাসে, তাও জানা নেই বয়সের সাথে সাথে, রুচিরও তো পরিবর্তন হয় ভাল লাগা না লাগা গুলো বদলে যায় ছোটবেলায় মাছ, মাংসের পোকা ছিল মিষ্টি খেতেও খুব ভালবাসতো তবে তার সবথেকে প্রিয় খাবার ছিল, রুটি আর মধু বাবার বিশ্বাস ছিল মধু খেলে সর্দ্দিকাশি হয় না তাই চাকভাঙ্গা ভাল মধু প্রচুর কেনা , আর তার সবটাই প্রায় হর্ষর পেটেই যেত নাঃ, হাতে আর বিশেষ সময় নেই কালই সব ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে
                                    ২

অন্ধকার ঘরে কপালের ওপর হাত রেখে হর্ষ শুয়ে আছে আলো জ্বালতেও ভাল লাগছে না দিদির চিঠি পেয়ে সেও খুব খুশী সেও চায় অতীত ভুলে গিয়ে আবার আগের মতো সুন্দর একটা জীবন শুরু করে কিন্তু পারছে কই? একটা তীব্র পাপ বোধ তাকে চব্বিশ ঘন্টা কুরেকুরে খাচ্ছে তার স্থির বিশ্বাস, তার পাপেই আজ তার ফুলের মতো সুন্দর ছোট্ট নিষ্পাপ ছেলেটাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে ছেলের কষ্টে সব সময় সবিতা মনমরা হয়ে থাকে গত দুবছর সবিতার মুখে কখনও হাসি দেখেনি ছেলের কষ্ট হবে ভেবে কোথাও যেতে পর্যন্ত চায় না একবার ভেবেছিল ভাইফোঁটায় সে নিজে দিদির বাড়ি যাবে না, কিন্তু সবিতার কথায় সে রাজী হয়েছে, এবং দিদির জন্য ভাল একটা শাড়ীও কিনে এনেছে অন্ধকার ঘরে একা একা এইসব কথা ভাবতে ভাবতে, অনুশোচনায় তার চোখে জল এসে যায় মনে পরে যায় তার দুর্মতির কথা
গ্রামের অশিক্ষিত সহদেব, ছোট একটা কারখানায় সামান্য কাজ করে কোন মতে বউ মেয়ে নিয়ে দিন কাটাতো কিন্তু আর পাঁচটা কলকারখানার মতো, তার কারখানাও শ্রমিক অসন্তোষে বন্ধ হয়ে যায় এর ওপর তার একমাত্র মেয়েটার চোখের একটা কঠিন রোগের চিকিৎসায় তার বাজারে বিস্তর ধারদেনা হয়ে গেছে হণ্যে হয়ে ঘুরেও নতুন কোন চাকরী জোগাড় করতে পারে নি সে নিজে কয়েকবার সহদেবকে টাকাও দিয়েছে, তার মেয়ের চোখের চিকিৎসার জন্য একদিন চোখের ডাক্তার জানান মেয়েটার চোখে একটা জরুরী অস্ত্র্রপচার করা প্রয়োজন, এবং সেটা যত শীঘ্র সম্ভব করা দরকার। তা নাহলে মেয়েটার চিরতরে অন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বাধ্য হয়ে সহদেব রাস্তায় রাস্তায়, ট্রেনের কামরায়, মেয়ের চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য করার অনুরোধ নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। রাতে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে আসে তার স্ত্রীও পাঁচটা বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছার কাজ নিয়েছে ফলে তারও বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায় সারাদিন তাদের ছোট্ট ঘরে বাচ্ছা মেয়েটা একাই থাকে দিনের শেষে তাদের যা আয় হয়, তার অধিকাংশই মেয়ের চিকিৎসার জন্য একটা বাক্সে রেখে দেয় হর্ষ একদিন তাদের সাবধান করে দেয়— “সারাদিন বাড়িতে কেউ থাকে না, টাকা পয়সা ওভাবে ঘরে না রাখাই ভাল কোথাও লুকিয়ে রেখ

তার পরামর্শ মতো টাকাপয়সা একটা কৌটতে রেখে, কৌটটা বাড়ির লাগোয়া একটা ভাঙ্গাচোরা ইঁটের স্তুপের ভিতর লুকিয়ে রাখা শুরু হ প্রতিদিন রাতে সহদেব কৌটতে টাকা রেখে, কৌটটা আবার যথাস্থানে রেখে দেয় বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা থেকেও সে তার পাওনা টাকাপয়সা পেয়ে যায় সেই টাকাও ঐ কৌটয় রেখে আসে
এইভাবে প্রায় মাস তিনেক কেটে যায় মেয়েটার চোখের যন্ত্রনাটাও বেশ বেড়েছে দৃষ্টিশক্তিও আগের থেকে অনেক কমে গেছে সবকিছু এখন সে ঝাপসা দেখে

একদিন হর্ষ দুপুরবেলা অফিস থেকে ফেরার পথে মেয়েটাকে দেখতে যায় এর আগেও সে অনেকবার ফেরার পথে মেয়েটাকে দেখতে গেছে বাড়িতে তার বাবা-মা কেউ নেই চোখে আলো লাগলে কষ্ট হয় বলে, সে দরজা জানালা বন্ধ করে, ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল হর্ষ দরজা খুলে মেয়েটার ঘরে ঢুকে তার পাশে কিছুক্ষণ বসে তাকে আদর করে, সান্তনা দেয়, তারপর আবার দরজা বন্ধ করে অন্যান্য দিনের মতো চলে আসে

ভাঙ্গাচোরা ইঁটের স্তুপের পাশ দিয়ে আসার সময় কৌতুহল বশত সে দাঁড়িয়ে পরে ইঁট সরিয়ে তিনটে কৌট দেখতে পেয়ে কৌটগুলো খুলে দেখে, তিনটে কৌটই টাকায় ভর্তি সে বুঝতে পারে মেয়ের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকাই সহদেব সঞ্চয় করেছে কৌটগুলো আবার জায়গা মতো রাখতে গিয়ে, হঠাৎ তার মধ্যে কী রকম একটা পরিবর্তন আসে কৌটগুলো জায়গা মতো না রেখে, ইঁটগুলো আগের মতো সাজিয়ে রেখে, কৌট তিনটে নিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে তখনও সে বিয়ে করেনি নিজের ঘরে এসে সমস্ত টাকা বার করে গুনে দেখে পঁচিশ হাজার তিনশসাতাত্তর টাকা আছে একবার মনে হল কৌটগুলো সস্থানে রেখে আসে, কিন্তু তার মধ্যে বোধহয় একটা ঘুমন্ত সত্ত্বা বাস করতো সেই সত্ত্বা এতদিন পর জেগে উঠে তাকে বলে— “তুমিই বা কত রোজগার কর? টাকাগুলো রেখে দাও, তোমারই কাজে লাগবে সারা জীবন কী এভাবেই কাটাবে? তোমারও তো সংসার হবে, বুড়ো বাবা-মাকে দেখতে হবে তোমার টাকার প্রয়োজন নেই”?
মূহুর্তের লোভ তাকে পেয়ে বসে টাকাগুলো সে নিজের কাছে রেখে দেয় সে জানে সহদেব তাকে কোনদিন সন্দেহ করবে না
সেদিন রাতেই সহদেব কাঁদতে কাঁদতে তাকে ডাকতে আসে তার মুখে সব কথা শুনে, নির্লিপ্ত মুখে সে সহদেবের সাথে ইঁটের স্তুপের কাছে গিয়ে টাকার কৌট খুঁজতে শুরু করে সেখানে কিছু না পাওয়া যাওয়ায়, সহদেব কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়
এরপর আর সে টাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি ফলে যা হবার তাই হ মেয়েটা আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে গেল সহদেবও কীরকম একটা পাগলাটে হয়ে যায় সব সময় চুপ করে বসে থাকে তার স্ত্রী পরের বাড়ি কাজ করে কোন মতে সংসার চালায়
মৌমাছির তিল তিল করে মৌচাকে মধু জমানোর মতো, সহদেবও তিল তিল করে কৌটগুলোয় টাকা জমিয়ে ছিল মৌমাছির বহু কষ্টে সঞ্চয় করা মধু যেমন মানুষ সুযোগ মতো কেড়ে নিয়ে নিজের ব্যবহারে কাজে লাগায়, হর্ষও সেইরকম সহদেবের বহু কষ্টে সঞ্চয় করা টাকা, নিজের ব্যবহারের জন্য নিয়ে নেয়

এরপরে হর্ষ বিয়ে করে সবিতাকে নিয়ে আনন্দেই দিন কাটে তারপর তাদের সন্তান আসার বছর খানেক পর থেকে তার এই পরিবর্তন একটা তীব্র পাপ বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তার ধারণা, তার পাপেই তার বাচ্ছাটা সহদেবের মেয়ের মতোই পঙ্গু হয়ে জন্মেছে অথচ এই পাপ, এই অন্যায়ের কথা কাউকে বলে সে হাল্কা হতেও পারছে না সবিতাকেও নয়
সবিতা এসে আলো জ্বেলে দেওয়ায়, সে সম্বিত ফিরে পায়

                                   

নির্দ্দিষ্ট দিনে হর্ষ দিদির বাড়ি ফোঁটা নিতে যায় দিদিকে শাড়ী দিয়ে প্রণাম করে দিদি খুব খুশী হয়ে তাকে ফোঁটা দেয় অন্যান্য খাবার দেবার আগে, ভাই এর সব থেকে প্রিয় খাবার, রুটি ও অনেকটা মধু এনে ভাইকে খেতে দেয়
ডুকরে কেঁদে উঠে হর্ষ শুধু বলে—“ মধু খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি রে মধু খাওয়া পাপ, মৌচাক থেকে মৌমাছির বহু কষ্টে সঞ্চিত মধু আনাও অন্যায়, পাপ ওটা সরিয়ে রাখ
ভাইফোঁটার আনন্দ নিমেষে মলিন হয়ে যায় কিছু না বুঝে পার্ব্বতী শুধু অবাক হয়ে হর্ষর দিকে তাকিয়ে থাকে ভাই এর কান্নায় তারও চোখে জল এসে যায়