'কত না রংবাহারি
ফুলের মালায় খোঁপাটি মনের মত সবাই সাজায় ।' এটি একটি
গানের লাইন । লাইনটির মধ্যে ভুল থাকতে পারে আবার ঠিকও হতে পারে । কিন্তু এই
বাক্যবন্ধের মধ্য দিয়ে যে কথা বলবার প্রয়াস , তা হল আমরা
সকলেই নিজেকে ভালবাসি। নিজেকে সর্বদা সুন্দর করে সাজাতে চাই । আমরা আসলে খেলার
পুতুল । কোনও একজন আমদের পিছন থেকে নাড়াচ্ছে , তাই আমরা
নাচছি ।
বিজনের অফিসে এখন বিরাট সমস্যা দেখা
দিয়েছে । শূন্যপদে লোক নিয়োগ না হওয়ায় প্রচুর ভ্যাকেন্সি । কাজ চালানো দুষ্কর । সব
পোর্টারদের পদ । বাঙ্গালীরা আগে এই রকম জায়গায় কাজ করা পচ্ছন্দ করত না । এখন কাজ
নেই।তাই তারাও ঝাঁপিয়ে পরেছে এই কাজ করবার জন্য । রীতিমত মারামারি কাটাকাটি অবস্থা
।কে কার ছেলেকে ঢোকাবে , কেউ আবার ভাগনাকে - এই
নিয়ে তুলকালাম ।আরে বাবা আগে ব্যবস্থাটা হোক । মানে ওপর মহল থেকে অর্ডারটা আসুক !
বিজন এই সরকারি দপ্তরটির প্রধান । ওপর
মহল থেকে যেমন যেমন অর্ডার আসবে সে তেমন তেমন প্রয়োগ করবে । পরিভাষায় লেখা
নির্দেশনামার মধ্যে আবার অনেক রকম মারপ্যাঁচ থাকে । অর্থাৎ গোলগোল অর্থ ,
ইহাও হয় আবার উহাও হয় । ঠিকমত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে আবার
এক বিপদ । অফিসে যুযুধান দুটি সংগঠন - বাম ও ডান । এক পা এদিক ওদিক হলে তারা ছিরে
খাবে ।
ঠিক সেটাই হল । এমন নয় যে বিজন কারো
সাথে আলোচনা না করেই অফিসে ছ' সাত জন পোর্টার
নিয়োগ করল । মোটামুটি ব্যালান্স মেনটেইন করেই সে নো ওয়ার্ক নো পে ভিত্তিতে কুলি
লাগিয়াছিল । অফিসে সদস্য সংখ্যার নিরিখে যেহেতু বামেদের সংখ্যা বেশি তাই তাদের
থেকে চার জন মানে তাদের চার নিকট আত্মীয় এবং যারা ডানপন্থী তাদের থেকে তিনজন নেওয়া
হয়েছিল । একমাস বেশ হেসেখেলে কাটার পর আবার গণ্ডগোল বাঁধল ।
প্রথম নির্দেশ থেকে বিজন জেনেছিল ওপরওয়ালা বশ
পরিস্থিতি বিচার করে বলেছেন যেমন প্রয়োজন হবে তেমন বাইরে থেকে কুলি নিয়োগ করে
কনটেনস পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।বিজন তার অধস্তন কর্মীদের সেই রকমই নির্দেশ
দিয়েছিল ।এই অফিসে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজ হয় । সাতটি শিফটে কাজ হয় ।প্রায়
কারখানার মত ব্যাপার । হই হই রই রই কাণ্ড ।
অফিসের কর্মী অঢেল । যাদের আত্মীয়রা কাজ
পেলনা তারা বিজনের শত্রু হয়ে গেল । আর শত্রু হল ইতিপূর্বে নিজুক্ত কিছু পোর্টার
।যাদের গালভরা নাম ডি আর এম । না,না ডেপুটি রেলওয়ে
ম্যানেজার নয় এরা হল গিয়ে ডেলি রেটেড মজদুর । এরা সকলে একত্রিত হয়ে ওপরে প্রধান
অধিক্ষকের কাছে দরবার করল ।
প্রথম ফোনটা যখন এল তখন বিজন টেবিলে ছিল
না । পাশের টেবিলের অজয় ফোনটা ধরেছিল । জলদগম্ভীর স্বরে বড় সাহেবের ক্লার্ক
জিজ্ঞাসা করেছিলেন , ' নতুন নিযুক্ত ডি আর
এম দের নামগুলো জানেন ?' এদের মধ্যে অজয়ের ভাগনাও ছিল ।
অজয় ভেবেছিল নাম জানতে চাইছে যখন , তখন নিশ্চয়ই ভাল কিছু
হবে । তাই সে তড়িঘড়ি নামগুলি জানিয়ে দিল । আর বিকালেই ফ্যাক্স মারফত নির্দেশ এল ওই
সাতজন নতুন কুলিকে বসিয়ে দিতে হবে ।
বিজন নিরুপায় । সে সত্যিই খেলার পুতুল ।
ওপর থেকে যেমন নাচাবে সে তেমন নাচবে ।কিন্তু এত লোকের কাজ কি ভাবে হবে ?
কে করবে কাজগুলো ? পুরাতন জনা নয়েক ডি
আর এম নাকি সব কাজ তুলে দেবে । আসলে ওদেরও দোষ দেওয়া যায় না । ওরা এক একজন দীর্ঘ
ত্রিশ বছর অবধি পোর্টারের কাজ করছে । কেউ ওদের কথা ভাবেনি । ওরা স্থায়ী কর্মীর
মর্যাদা পায় নি । ওরা ইন্সিকিওরিটি ফিল করতেই পারে । তাই ওরা গিয়ে বড় সাহেবকে
বলেছেন , ' স্যার সব কাজ আমরাই করে দেব , কোনও আলাদা ডি আর এম লাগবে না ।'
পাগল ছাড়া এ কথা কেউ বলে ?
না , ন'জনের
কাজ দু'জনে করতে পারে ? ওরা করছে
।নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করে ওদের লাভ কিছু হবে না । তবু ওরা করছে । ওরা
যে খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে ।বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে । কে ওদের বোঝাবে । বিজন
যেন ওদের পরম শত্রু । এ খেলা চলছে নিরন্তর ।