গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫

পলাশ কুমার পাল

প্রতিবিম্বন

                                                                                             

   বৃষ্টি ভেজা মেঘাচ্ছন্ন রাত। ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটার ঘর ছুঁতে চায়। হাতে স্টিয়ারিং, ক্লান্ত চোখ সারিবদ্ধ ল্যামপোস্টের আলোয় পথ বের করে যায়। মৃণ্ময় যেন আজ বেশী বিধ্বস্ত।  'দিন শরীরটাও ভালো নেই। তবু অফিসের কাজের চাপ। রাত পর্যন্ত কাজ। প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি, করার কিছু নেই- জোঁকের মতো রক্ত চুষে খায়।

     এইসব সাত-পাঁচ ভাবনা মাথায়। হঠাত্মৃণ্ময়ের চোখ জেগে উঠল- রাস্তার উপর একটি মেয়ে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিস্নাত চুলগুলি কপালে এলোমেলো, পরনের কামিজ কোথাও কোথাও ছেঁড়া। তবু যেভাবে হোক সেই ছিন্ন বস্ত্রে। সবকিছু হারাবার ছাপ চোখে মুখে, আর সাহায্যের জন্য আকুল রোদন বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায়

  কয়েক বছর আগের এক রাত আজ আবারও মৃণ্ময়ের সামনে। তখন মৃণ্ময় কলেজ পাশ করে সবে বেরিয়েছে। চাকরির জন্য হন্নে হয়ে ঘুরছিল। এমনই একদিন শহর থেকে ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরতে রাত হয় গিয়েছিল। স্টেশন থেকে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিল। শীতকালে গ্রামের দিকে রাত দশটা মানে অনেক রাত- রাস্তা প্রায় নিস্তব্ধ। কেবল সাইকেলের শব্দ, আর শেয়ালের ডাক ছাড়া সব নিশ্চুপ। হঠাৎ একটি ক্ষিণ আর্তনাদ কানে এলো। প্রথমে আন্দাজ করতে পারেনি। আরও কিছুটা যাওয়ার পর দেখল কয়েক জন যুবক, যার মধ্যে সেই অঞ্চলের ব্লক সভাপতির ছেলে অভিলাষও ছিল। মৃণ্ময়কে দেখে তারা দৌড়ে পালাল। মৃণ্ময় এদের সবাইকেই চেনে- সেই অঞ্চলে নানা কুকর্মে যুক্ত তারা। তবে তাকে দেখে ছেলেগুলির এইভাবে দৌড়ে পালানো দেখে মৃণ্ময়ের খটকা লাগল। তখন সেই আর্তনাদ আরও তীব্রভাবে কানে এলো। চারপাশে তাকাল- কিছুই তো দেখা যায় না পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘর ছাড়া, যেটি আগের শাসকদলের কার্যালয় ছিল। সময়ের খেয়ালে আজ এটি ব্রাত্য। মৃণ্ময় সেইদিকে গেল। যা দেখল তাতে কিছুক্ষণ সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদেরই গ্রামের মেয়ে এষার দেহ সুতোবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। আর শরীরের নানা স্থানে পাশবিকতার চিহ্ন। বুঝতে বাকি রইল না ছেলেগুলোর পালানোর কারণ। এষা সেদিন টিউশন পরে বাড়ি ফিরছিল। আগের ট্রেনে এসেছে সে। আর তখনই তাকে রাস্তায় একা মানুষ রূপী পশুগুলোর এই হেন আচরণ।

মৃণ্ময় গ্রামের কয়েক জনকে ডেকে আনে এবং এষাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। থানাতেও যায় মৃণ্ময়। কিছুদিন পর হঠাত্ই মৃণ্ময়ের বাড়িতে পুলিশ আসে। মৃণ্ময়কে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারে এষার সঙ্গে অভিলাষের বিবাহ। ভোটের সময় জনরোষ এবং গদি হারাবার ভয়ে ঝুঁকি নেয়নি। এম.এল.. প্রতাপ দত্ত ব্লক সভাপতিকে চাপ দিয়ে অভিলাষের সঙ্গে এষার বিবাহ দেন। টাকা ও যশের লোভে এষার পিতা রাজী হয়ে যায় এই বিবাহে। এষাও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সম্মত হয়। ফলস্বরূপ মৃণ্ময়কে অভিযুক্ত সাজায়। মৃণ্ময়ের খ্যাঁচকা লাগে- এবার কিন্তু মৃণ্ময়ের শিরদাঁড়ায়। পুলিশ জিপে ওঠার সময় খ্যাঁচকাটা লাগে। কিছুদিন পর মৃণ্ময় ছাড়া পায়। এষা আত্মহত্যা করার পর এষার পিতাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কেসটা তুলে নেয়। যে বাঘ কোনো মানুষের একবার রক্ত চোষে, তাকে যতই পোষ মানিয়ে সার্কাস করা হোক সে যে কোনো মূহূর্তে আক্রমণ হানতেই পারে।

   জেল থেকে বেড়বার সময়ও শিরদাঁড়ার ব্যাথাটা তখনও ভালো হয়নি। বরং জেলের বাইরের পরিবেশটা আরও যেন অচেনা মৃণ্ময়ের চোখে। মানুষগুলিকে দেখে ভ্যাল ভ্যাল করে- নিজেকে দেখে তারপর। রক্ত তো দু'জনেরই লাল। তবু বাকি মানুষগুলির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। তাই গ্রাম ছেড়ে সে শহরে চল আসে। শহরে তো সে অচেনা। চেনা মানুষের থেকে এই অচেনা মানুষের খনিকের  চেনা অনেকটা ভালো। প্রাইভেট কোম্পানীতে সামান্য বেতনে কাজ করে। তবে কর্মব্যস্ত জীবনে খ্যাঁচকাটা ভালো হয়ে যায় বোধ হয়।

   স্টিয়ারিং হাতে থাকলেও কর্মব্যস্ত জীবনে সে কিছুটা কুঁজো। তাই গাড়িটা থামাভে কিনা ভাবছে। গাড়ির গতির সাথে সাথে অচেনা মেয়েটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সময় যেন চক্র- আবারও ঘুরে আসে তাই। মেয়েটি হাত তোলে। কম্পমান হাতে ব্যাকুলতা কাঁপে। পেছনে কিছু ছেলে অট্যহাস্য করে- রাক্ষসকূল যেন অমৃত দেবতাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সময়ের নানা প্রবাহে আজও জীবাণু রয়ে গেছে সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাসে।

     মৃণ্ময়ের রক্তের গতি বেড়ে যায়। গাড়ির দাবায় নিজেরই অজান্তে। ছেলেগুলি আবারও পালায়। মৃণ্ময় গাড়ির গেট খুলে রাস্তায় পা দিতেই আবার সেই খ্যাঁচকা- মেরুদণ্ডে খট্করে আওয়াজ হয়।