অ ভাব
রাঁধতে গিয়ে রুমকি দেখে নুন বাড়ন্ত। যাচ্চলে,খুন্তি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকে কিচেনে। একটি হলুদ বাটি সিঙ্ক থেকে ডেকে উঠে পুরানো সুরে, রুমকি রুমকি এই রুমকি! এটা ডাক্তার সাহেবের মেয়ে না ? রিলিফ ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে সাদা পাঞ্জাবীর রাজনৈতিক নেতা জিগ্যেস করে চামচাকে । রুমকি তখন রিলিফের লাইনে। নুন নিতে এসেছে। সামনে পেছনে ওদের শহরের ভাল ভাল ধনি পরিবারের ছেলেরা। রুমকি ভাবে সে তো বাপি মায়ের ছেলেই । আর ছেলে হোক বা মেয়ে নুন তো সবাই খায় । সবারই দরকার। তাই আকরাম, রেন্টু, জসিম, সুবল, কার্তিকের সাথে বীর বিক্রমে লাইনে দাঁড়িয়েছে। ওর হাত,পা, মুখ ছেলেদের মতই চালু। কেউ কিছু বললেই টকাস মেরে দেবো শালাদের। নাক ফাটিয়ে দেবো। শালা শুয়োরের বাচ্চা নুন কি তোর বাপের ল্যাঞ্জা ? হলুদ বাটিটা মাথায় পরে হা হা করছে আর দেখছে লাইন কতটা এগুলো।
এমন
সময় চামচা ডেকে নিলো। সাদা পাঞ্জাবী হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে কঠিন গলায় জানতে
চায় ,কে পাঠিয়েছে ? কুচ
পরোয়া করি না ভাব দেখিয়ে মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রিলিফ ঘরে নুন ভর্তি বস্তা।
হলুদ বাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বড় এক ব্যাগে নুন ভরে সাদা পাঞ্জাবী রুমকিকে নিয়ে
রিকশায় উঠে । তার ফর্সা চিকন মুখে দাউ দাউ করছে অপমান। লাইন থেকে বন্ধুরা আওয়াজ
ছোঁড়ে। ওরাও জানে আর রুমকিও বুঝতে পা্রে আজ আর রক্ষা নেই। দ্বৈত ধোলাই খেতেই হবে।
প্রথমে মা পরে বাপি।
এই
শহরের ওরা প্রাচীন পরিবার। ওদের বাড়ির সংস্কৃতি অন্য দশটা বাড়ির চে আলাদা। ভারত
বর্ষের মানচিত্রে দক্ষিন পুর্ব বাংলার এক নীচু জংলা ভুমির পরিবারে কি করে যেন
কলকাতার আধুনিক সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। পোশাক আসাক কথা বলায় মা বাপি ফেলে আসা
কলকাতার প্রভাব সযত্নে ধরে রেখেছে। শক্ত মলাটের ভেতর রেখে মানুষ করার আপ্রাণ
চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েদের। পারছে না শুধু রুমকির সাথে। এই সব মলাট ভেঙ্গে চুরে
রুমকি বার বার বেরিয়ে যায়। রিলিফের অনেক কিছু নিয়ে ওদের বাসায় লোক এসেছিল। মা বাপি
ফিরিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের জন্য নাকি এইটুকু আত্মত্যাগ মানতেই হয়। যুদ্ধ সম্পদ ধ্বংস
করেছে । কোন জীবন তো কেড়ে নেয়নি। যত্তসব ফালতু গান্ধীগিরি।
ও
দেখেছে যাদের কিছুই নষ্ট হয়নি তারাও রিলিফ নিচ্ছে ! ফিরিয়ে দেওয়া রিলিফ থেকে তাই
কিছু না কিছু নিয়েই ছাড়ে । ওইসব স্টিক ধোলাই টোলাই গায়েও লাগে না । কেয়ারও করে না।
মা বাপি কি করে বুঝবে সবাই যখন লাইনে দাঁড়িয়ে নুন নিচ্ছে তখন ওদের নিলে কোন ক্ষতি
নেই! বাপির বন্ধুরা তো বহুত ধনী। তাদের ছেলেরাও লাইনে দাঁড়িয়ে কত কিছু নিয়ে
নিচ্ছে। বিকেল হলেই কাজিদের পোড়ো বাড়ির আড্ডায় পকেট থেকে নানা রকম বিদেশী খাবার
বের করে ওরা । রুমকির পকেটে থাকে সেদ্ধ মিষ্টি আলু, সেমাইয়ের জর্দা নইলে গুড়ের নাড়ুতক্তি। হাসাহাসি করে বন্ধুরা। বাড়ির
সন্মানে কি নুন আসে? চিনি, চাল,
বিদেশী পনির, চকলেট, বিস্কিট? এই জন্যে বাপিকে ও অনেকের মত দুচোখে
দেখতে পারে না।
এক
কেজি নুন সত্তর টাকা ! চার দিকে অভাব। যুদ্ধ মানুষকে গরীব করে দিয়ে গেছে। গরিব
মানুষ এসে শহর ভরে গেছে । তারা কচু ঘেচুর সাথে গম দিয়ে ভাত বানিয়ে খায় । ঠুটি খায়।
হেমদির কাছ থেকে চেয়ে খেয়েছে রুমকি। একেবারে খারাপ লাগে না। কিন্তু মা কিছুতেই
পাতলা রুটি ছাড়া ওগুলো বানাবে না। বুঝতেই চায়না রুমকিরা এখন গরিব প্রায়। সংসারে
কেবল কাট্ ছাট্। খরচ কমাও, খরচ কমাও।
আজকাল
খাওয়ার টেবিলে মাত্র দুটো তরকারি হয়। ঢাকায় পড়ে দিদিরা। তাদের টাকা পাঠাতে হয় বলে
সস্তা খদ্দরের পাঞ্জাবী পাজামা পরছে রুমকির বাপি। তার উপর কিছু মানুষ তো আছেই যারা
জানে এই বাসায় গেলে কিছু না কিছু খেতে পাবেই । রুমকির মা করুণ ভাবে বাপিকে বলে
পারছি না গো! এত বাড়তি মানুষ ! বাপি গভীর চোখে মাকে বলে,
দিও কিঞ্চিৎ ,না করো বঞ্চিত। আমাকে না
হয়
একবেলাই
খেতে দিও তুমি । তড়িৎ অভিমানে রুমকির মা ছিটকে উঠে ইঁদারায় বালতি ফেলে ঝনঝন শব্দে।
রুমকির বাপি বাদামী দুপুরের দিকে তাকিয়ে ভাবে যুদ্ধ তার ক্ষত রেখে যায় কি প্রগাঢ়
প্রকট বিশ্রি রূপে।
সন্ধ্যার
মুখে সোনার মা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে জড়সরো দাঁড়ায়। যুদ্ধের সময় শরনার্থী শিবিরে
স্বামি মারা গেছে ডায়রিয়া হয়ে। একটুকরো জমিতে গোলপাতার ছাউনিতে দুই মেয়ে নিয়ে
থাকে। সাহায্য করার মত কেউ নেই। হিন্দুর বিধবা গোপনে রুমকিদের বাসার কাজ করে
গোপনেই চলে যায়। মোতির মা খুব কড়া করে মেপে চাল, ডাল,আলু তেল দেয়। এই দিয়ে কি ভরে তিনজনের পেট ?
মোতির মা ফিস্ফিস্ করে সোনার মার মুখে পাউডার আর চোখে কাজল
দেখেছে সে। মার হাত থেকে পার্লস বাকের বইটা পড়ে যায়। তুলে নিয়ে কঠিন গলায় জানায়
এটা নিয়ে আর কোন কথা হবে না। ও যেমন কাজ করছে তেমন কাজ করে যাবে।
মোতির
মার মেয়ে কাজ করে ফুড অফিসারের বাসায়। ভাল খেতে পায়, নিয়েও আসে বাসায়। গোলাম উকিলের বাগানে ঘর তুলে থাকে ওরা অনেকের সাথে।
একদিন মার পা জড়িয়ে ধরে মোতির মা। দুপুরে খাওয়া শেষে মা বাপিকে বলে, পাপ পুণ্য বুঝিনা। মেয়েটাকে বাঁচাও গো । পান সিগারেটের দোকানি জব্বারের
বউ চলে গেছে ভাতের জন্য ঝগড়া করে। হঠাত হঠাত উধাও হয়ে যাচ্ছে হিন্দু মুসলিম
নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েরা। বাচ্চু কাকাদের দুই তলার জানালা দিয়ে শহরের ধনী বাড়ির
রান্না ঘর দেখা যায়। অভাব সেখানেও ঢুকে পড়েছে। জোয়ান ছেলেরা আড্ডা মেরে এসে আগের
মত খেতে পায় না বলে চেঁচামেচি করে রান্নাঘর গরম করে ফেলে। মায়েদের মহিলা সমিতিতেও
কেবল অভাবের গল্প। আগের মত ঘিয়ে ভাজা আড্ডা একদম জমে না।
কিন্তু
শহরের কেউ কেউ হঠাত খুব ধনী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি কিনে এই ধনীরা
বসত শুরু করেছে। রাতারাতি হিন্দু পাড়াগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেকেই গোপনে এসে মাকে
জড়িয়ে ধরে কাঁদে, জন্মের মত চলে যাচ্ছি
গো সই। কত আর এভাবে থাকা যায়। ওপারেও অভাব এপারেও তাই। অর্ধেক আত্মীয় এই দেশে তো
বাকী অর্ধেক অই পারে। রুমকির বন্ধুর সংখ্যা কমে যায়। সুবল, শেখর, উর্মি, চন্দনাদের
বাসায় গিয়ে মুখ কালো করে ফিরে আসে। নব্য ধনীরা ফুলেবাগান কেটে তকতকে উঠোন করেছে।
সন্ধ্যা হলে এখন আর কেউ প্রদীপ জ্বালে না । আজানের সাথে মন্দিরার যুগলবন্দী বাজে
না বাতাসে। মার খাওয়ার ভয়ে ওরা ছুটতে ছুটতে ঘরে ফেরে না আজান আর সন্ধ্যা পূজার
আগে। মন খারাপ করে দাদুর বাগানে একা একাই ঘুরে বেড়ায় রুমকি ।
ঠাকুরদাদু
এখনো থেকে গেছে বংশের পুরানো মন্দির আঁকড়ে ধরে। ভাঙ্গাঘাটে হাত ডুবিয়ে যতবার জল
তোলে ততবারই ব্যাংগাচিগুলো উঠে আসে পিলপিল করে। এরকম এক ধাঁ ধাঁ দুপুরে রুমকি
বাপিকে দেখে ঠাকুর দাদুর সাথে কথা বলতে। পাতলা খদ্দরের চাদরে জড়ানো দাদুর দেহটা
শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। খড়ম পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দাদুর যেন খুব কষ্ট হচ্ছে।
রুমকির বাপি একটি জাম গাছে হেলান দিয়ে মুখ নীচু করে আছে। দাদুকে প্রণাম সেরে চলে
আসতে আসতে চোখ মুছছে বাপি । রুমকি বুঝতে পারে দাদুও হয়ত দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে
ওপারে।
রাতে
পড়তে বসে শুনতে পায় কারা যেন হুমকি দিচ্ছে ঠাকুর দাদুকে । যথেষ্ট মূল্য দিয়েই তারা
কিনে নেবে বিশাল ঠাকুর বাড়ি। কিন্তু জীবন থাকতে দাদু ইন্ডিয়া যাবে না জেনে
নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছে। ফুঁসে ওঠে রুমকির মা । উপায়হীন ফোঁস । জানে দাদু না যেতে
চাইলেও যেতে উনাকে হবেই। তবু রুমকির বাপি কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিবাদ করে। মন্দিরটি
বহু প্রাচীন। প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন হিসেবে থাকলে তো কোন ক্ষতি নেই। জেলা
প্রশাসকের কাছে আর্জি যায় মুষ্টিমেয় লোকের স্বাক্ষরে। কেউ কেউ বাপিকে খুব টিজ করে
হিন্দু ঘেঁষা বলে। আড়ালে বলে হিন্দু চাটা। রক্তে আছে যে। রুমকি জানতে চায়,
আমরা নাকি হিন্দু ছিলাম? বিকেল কাঁপিয়ে
হাসে বাপি। গল্পটি শোন মেয়ে । ইতিহাসের সোজা গল্প। রুমকির কানে বাজে
ব্রাম্মণ্যবাদের উন্নাসিকতা, জাতপাতের বৈষম্য ছবি আর
বখতিয়ারের ঘোড়ার খুরের শব্দ । বাপির চোখে চোখ রেখে
রুমকি বোঝে জামা কাপড়ের মত ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, শক্তির
দাপটে, বেঁচে থাকার ন্যুন আশায় বদলে যায় ধর্ম সংস্কৃতি ।
অভাবের
মোকাবেলা করতে করতে রুমকিদের বিশাল সুন্দর বাড়িটা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে ।
ফলবাগানসহ পতিত জমি, ঘন সবুজ বাঁশবন এরপর
একদিন ফুলের বাগান, দোলনা ঝুলন ফাঁকা জায়গা সব অন্যদের
হয়ে গেল। রুমকি বাঁশ কঞ্চির বেড়া ছুঁয়ে স্থল পদ্মের ডাল ধরে লুটিয়ে পড়ে। বাপি বাপি
ওরা আমাদের বাগানটা নিয়ে নিয়েছে, আমার দোলনা, টমির ঘর! তীব্র দুঃখে ছুটে যায় ঠাকুর দাদুর কাছে। ভাঙ্গাঘাটে পড়ে আছে
দাদু। যগ ডুমুরের নীচ দিয়ে দ্রুত উধাও হয়ে গেল দুটো লোক। ভয়ে চেঁচিয়ে মানুষ জড়ো
করে রুমকি । অনেক মানুষের ভিড়ে রুমকি চিনে ফেলে সেই দুজনকে।
জেলা
প্রসাশক বাপিকে চায়ের আমন্ত্রন জানায়। নিজ হাতে চা বানিয়ে তিনি জানান সময় বড় খারাপ
কবি। মেয়েকে তো বাঁচাতে হবে। নৈনিতল থেকে ঠাকুরদাদুর ছেলে দেবুকাকু আসে । বাপিকে
প্রণাম করে বলে যায়, আসি বড়দা। সব সূতো
ছিঁড়ে গেল। ধর্ম আমি মানিনা। তবে নিয়তি মানি। মানুষ খুব উন্মাদপ্রিয়। নাম পাল্টে
রুমকিকে সরিয়ে দাও। হাইলি প্রটেক্টেট এন্ড আনএভিয়েবল কোন হস্টলে। সেই থেকে ভাসছে
রুমকি। স্বদেশে এলেই স্মৃতিগুলো বেশি ডাকে। আজ যেমন ডেকে বসল আসল নামে, রুমকি রুমকি এই রুমকি!