গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫

সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী

আরাত্রিক

মেয়েটা ইস্কুলের ইউনিফরম পরে এসেছিল। সাদা সার্ট, নীল স্কার্ট। বুক পকেটে ইশকুলের ব্যাজ পরিপাটি সেলাইকরা ।

পরিস্কার ঝকঝকে মুখ । চুলগুলো ঘাড় অবধি বব করা । উল্টে আঁচড়ে নীল ফিতে দিয়ে হেয়ার ব্যান্ডের মত করে আটকানো ।
গোলগাল মাখনের পুঁটলির মত ছোট্ট একটা মেয়ে ।
অবাক হয়ে ভাবলাম, সংগে বড়রা কেউ নেই ক্যানো ?
চেনা পরিবারের বাচ্চা নয় । পাড়ার বাচ্চারা ছোট থেকে বড় হবার পথে বাবা মায়ের হাত ধরে কখনো না কখন ও আসেই চেম্বারে । সবারই কম বেশি মুখ চিনি । কিন্তু একে তো চিনি না !
যথাসম্ভব ভাবলেশহীন মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিছু বলবে ?"
মাথাটা একটু নীচু করে বলল,"কষ্ট হচ্ছে খুব । বাইরে আপনার নাম লেখা বোর্ড দেখে বাস থেকে নেমে পড়েছি । "

কৌতুহল চেপে রেখে বল্লাম, "কষ্ট হচ্ছে, বাড়িতে কাউকে বলনি ?"
"না না বাড়িতে তো বলতে পারব না--"
এক ঝটকায় মুখখানা তুলতেই দেখলাম চোখ ভর্তি জল ।বড় কষ্ট হল । বুঝলাম একে পাখির বাচ্চার মত আলতো হাতে হ্যান্ডল করতে হবে ।
বললাম, "বেশ তো,আমাকেই বল। "

মনের ভিতরটা খারাপ হয়ে গেলো । আহারে । নির্ঘাত প্রেগন্যান্ট ।
কিন্ত না । সমস্যার বিস্তারিত বর্ননা শুনে বুঝলাম ঠিক ভাবিনি । এ কিশোরী কন্যা শারীরিক ভাবে কুমারীই আছে আইনতঃ । কিন্ত তার কচি মনের সরল কৌমার্য ঢিল ছুঁড়ে ভেংগে দেওয়া আয়নার মত কুচি কুচি টুকরো হয়ে গেছে । সেই কষ্ট, কৌমার্য হানির থেকেও বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে এই এগারো ক্লাসের ছাত্রী, ভালো মেয়েকে ।

কো এডুকেশন স্কুল । ছোট বেলা থেকে ছেলেদের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশে বড় হয়ে উঠেছে তানিয়া। অনাবিল শৈশব গড়িয়ে গেছে কৈশোরের নির্মল সৌন্দর্যে ।
সপ্তাহ খানেক আগে,দু বছরের  বড় এক সিনিয়র বন্ধুর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত পেয়েছে মেয়েটা । যন্ত্রণায় নীল হয়ে রয়েছে মন।আর না-ছোঁওয়া ফুলের পাপড়ির মত শরীরে রক্তাক্ত ক্ষত কুঁকড়ে দিচ্ছে দিশেহারা ছোট মানুষটাকে ।

আচমকা রূঢ় স্পর্শে ত্বক ফেটে গিয়ে রস গড়াচ্ছে বুকে । শরীরের নরম স্পর্শকাতর অংশে এই অদ্ভুত ক্ষতে হতভম্ব হয়ে আছে মেয়েটা ।
আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে জানলাম, এ বন্ধুটি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজেপড়া শুরু করেছে । তানিয়া ওদের বাড়িতে গেছিল, ছেলেটার জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার স্টাডি মেটেরিয়ালগুলো নিয়ে  আসবে বলে । বন্ধুই ডেকেছিল ।

তানিয়া খাতাবই নিতে গিয়ে দেখে সে দিন ওদের বাড়িতে আর কেউ নেই । আর তারপর..... ।
ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী তানিয়া । নাচ গান আবৃত্তি তে উজ্জ্বল তানিয়া । ইশকুলের, পরিবারের গর্ব তানিয়া, নীলচে ফ্যাকাসে মুখে আমার সামনে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকে ।
নতুন আলাপ হওয়া বয়সে বড় এই বন্ধুর তথাকথিত 'ভালবাসার অদ্ভুত প্রকাশে তানিয়ার নোংরা লাগছে নিজেকে । বুকের কচি নরম ত্বকে দাঁতের দাগ থেকে ইনফেকশন হয়ে গেছে । রস গড়াচ্ছে । পাছে জামায় দাগ দেখে মা কিছু জিগেস করেন, তাই জামার মধ্যে তুলো দিয়ে রেখেছিল । চানের সময় তুলো সরাতে গিয়ে চামড়া উঠে গিয়ে রক্ত পড়েছে ।
ঝরঝর করে জল পড়ে চোখ দিয়ে ।

"এত জ্বালা করছে, মনে হচ্ছে জ্বলন্ত মোমবাতির ছ্যাঁকা লাগছে গায়ে সব সময় ।
কি কষ্ট হল মেয়েটার জন্যে ।
ওষুধ লিখে দিলাম । তারপর একটু চিন্তা করে স্যাম্পল ওষুধ দিয়েও দিলাম । বাড়িতে কি বলে ওষুধপত্র কেনার পয়সা যোগাড় করবে মেয়েটা ? 
দুদিকের ঘায়ে ড্রেসিং করে দিতে, জামা পড়ে আরামের নিশ্বাস ফেলল ছোট্ট মানুষ । আর খুব দুঃখিত গলায় বলল,"অ্যাত খারাপ লাগছে আজ স্কুলে না গিয়ে । আমি কোন দিন ক্লাস বাংক করিনি জানেন। "
বললাম, "তানিয়া, তোমার কিন্ত মরাল ডিউটি ঘটনাটা বড়দের জানানো । এই ছেলেটির শাস্তি পাওয়াই উচিত তো, নাকি ?"

ত্রস্ত হরিণীর মত চমকে ওঠে চোখের দৃষ্টি।
"ভয় পেও না । কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে ফিজিক্যাল ইনভলভমেন্ট এ এগোনো টা ক্রাইম বলবে কি না ?"
রাগে লাল হয় ফর্সা মুখখানা ।
"হ্যাঁ, ভীষনই অফেন্সিভ অসভ্যতা । ডেফিনিটলি!"
নিশ্চিত হলাম, কন্যে ইনোসেন্ট । স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েনি ।
"তবে বড়দের জানাও । তোমার তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই ।"
মুখখানা নিচু করে বসে রইল মেয়েটা । যখন মুখ তুলল, সে আর কিশোরী নেই । সে এক গভীর দৃষ্টির নারী ।

"ম্যাম,আই কান্ট কন্ডেম হিম পাবলিকলি । আই নো হি হেটস মি । না হলে আমাকে এত খানি হার্ট করতে পারতো না । বাট আই লাভ হিম । আ লট। "
কথার মাঝখানেই বাধা দিই শংকিত হয়ে ।
"কিন্ত তানিয়া,এই ছেলেটি ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদে ফেলতে পারে তোমায় ! "
ম্লান হয়ে এল গলাটা ।

"আপনি আমায় খুব খারাপ ভাবছেন, না ?
আমি বাড়িতে বললে, ও খারাপ ছেলে বলে ব্র্যান্ডেড হয়ে যাবে---
আই কান্ট ডু দ্যাট ।"
"তানিয়া এর সঙ্গে বন্ধুত্ব----"
পিঠ সোজা করে বসল মেয়ে ।
"না না,আমি আর কখনও কন্টাক্ট করব না । হি উইল নেভার রেস্পেক্ট মাই ফিলিংস। হি বিহেইভড লাইক আ বেগার, আ থিফ । সো মিন...."
জল নামল চোখ ছাপিয়ে ।
" অ্যান্ড আমি এত বোকা,আই ওয়ান্টেড টু সেভ এভরি মলিকিউল আই হ্যাভ ফর হিম ওনলি।
আমি কি খুব খারাপ হয়ে গেছি ?"
অনেক আদর প্রেসক্রিপশনের মধ্যে ভরে দিয়ে বললাম, "না তানিয়া । তুমি খুব ভাল মেয়ে । খালি আর একটু সাবধান হয়ে চল ।"

রুমালে চোখ মুছতে মুছতে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো কন্যা । ফিজ নিতে পারলাম না ।
সেই না -দেখা সর্বস্বহারা ডন জুয়ানের সম্বন্ধে করুনা হল ।
হতভাগ্য !