গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৫

ঝর্না চট্টোপাধ্যায়



ঈর্ষা


ইদানীং  লালু স্যাকরার ভাইপো রতন আর তাঁতিপাড়ার নিমাই তাঁতির ছোট ব্যাটা শিবুর বেশ ভাবসাব। রতন মাঠের ধারে বড় রাস্তার ওপরে একটা তেলেভাজার  দোকান দিয়েছে। কিন্তু তেলেভাজা দিয়ে শুরু করলেও সেখানে ডিমভাজা, যাকে ওরা বলে মামলেট সঙ্গে পাঁউরুটি, মুড়ি-চপ, ঘুঘনি এসবও পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে লালু স্যাকরার ছো্ট মেয়ে বীণা ইশ্‌কুল থেকে ফিরবার পথে দাদার দোকানে এসে খানিক সময়  কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে। লালু স্যাকরার ছেলে নেই,  ভাইপোই ছেলের মত। বীণা এসে রতনের দোকানে পরোটা করে দিয়ে যাওয়ার ফলে ঘুঘনির সঙ্গে বিকোচ্ছেও দেদার। গ্রামের মেয়ে-ইশ্‌কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে   বীণা। দেখতে-শুনতে ভালো। পরিষ্কার চোখ-মুখ, মাজা রঙ। কথাবার্তাতেও বেশ টরটরে। বীণাকে দেখে শিবুর একটু ইয়ে হয়েছিল,গদগদ হয়ে এগিয়ে কথা বলতেও এসেছিল, পাত্তা পায়নি। উলটে বীনা কটকট করে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে শিবুকে। বন্ধুর দোকানে বসে বসে গুলতানি না করে কিছু একটা তো করলেই পারে! নিজের কিছু হয় না তাতে, অন্যেরও সময় নষ্ট।
চুপ্‌ কর...এক ধমক দেয় বোনকে রতন। বীণা তখনকার মত চুপ করলেও মেয়েটার নজর আছে সবদিকে। ক্যাশ বাক্স এমন জায়গায় রেখেছে, কোনভাবেই সেখানে হাত দেওয়া যাবে না। দোকানে লোকজন আসা-যাওয়া, খদ্দের দেখা সবদিকে নজর এই মেয়ের। এভাবে কাজ করলে রতন তো দুদিনেই কলাগাছ!  
--ইশ্‌, এমন যদি তার একজন থাকত! মাইরি, করে দেখিয়ে দিত শিবু। মনে মনে  ভাবে সে। কিন্তু ভাবা হয় না, আবার খ্যাঁক করে ওঠে বীণা---কই, বাড়ি গেলে না শিবু দা? এখানে বসে থেকে কি করবে, দেখছই তো, দাদা খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত...
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবু। একটা দোকানও যদি দিত তার বাবা।কিন্তু দোকান যে দেবে, সে রেস্ত কই? স্যাকরা আর তাঁতি কি এক!

(২)

সেদিন তখন বেলা এগারোটা। রতন ক্যাশের সামনে  বসে একজনের হাতে টাকা  গুণে দিচ্ছে, আগামীকাল দোকান বাজারের জন্য। বীণা বাড়তি ঘুঘনি-পরোটা  একটা ছোট টিফিন কৌটায় ঢেলে নিচ্ছে, বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। মায়ের জ্বর দেখে এসেছে, আজ আর বাড়ি গিয়ে রান্নার ঝামেলা করবে না সে, এই দিয়েই চালিয়ে দেবে। লালু স্যাকরা সকাল হতে না হতেই একেবারে প্রথম ট্রেনেই কলকাতা গেছে, পুরনো মনিবদের কাছে যদি কিছু কাজ পায়!  
দোকানে এখন ভিড় কম। মা লক্ষ্মীর কৃপায় বিক্রিবাটা ভালই চলছে। দাদার জন্যই বীণা অপেক্ষা করছে, কথা বলা শেষ হলেই সে বাড়ি যাবে, মা একা আছে। রতনকে সে আগেই খাইয়ে দিয়েছে, বোনের জন্য রতন আজকে বাড়ি থেকে ভাত আনতে বারণ করেছে। বেচারী ইশ্‌কুল থেকে এসে এতটা ঝক্কি-ঝামেলা পার করে আবার  বাড়িতেও মাকে নিয়ে পড়ে থাকবে, তাই রতন আজ আর ভাতের ঝামেলা করেনি। বীণা একেবারে বিকেলে চা দিয়ে যাবে। তখন সঙ্গে মুড়ি-টুড়ি কিছু খেয়ে নিলেই হবে।
হঠাৎ শিবু এসে বসল রতনের পাশে। দেখেই মুখ কালো ও রুক্ষ হয়ে উঠল বীণার। কেন যেন দাদার এই বন্ধুতাকে দুচোক্ষে দেখতে পারে না বীণা। ফাঁকিবাজ, কাজে-কর্মে মন নেই। খালি বড়বড় কথা, আর অন্যের ঘাড় ভেঙ্গে খাওয়া। দাদাকে নষ্ট করারা তালে আছে। এক নম্বরের বদমাইশ,ওর মতলব ভাল নয়। আজ ঘুচিয়ে দেবে ওর বাহাদুরি। কাছে আসুক, বলুক কিছু কথা, তারপর দেখে নেবে বীণা।
কিন্তু আজ সেসবের দিকেই গেল না শিবু। কানে কানে কি সব বলল রতনকে, তারপর দুজনেই এক ছুটে দোকানের বাইরে। রতন শুধু ইশারায় বীণাকে বলে গেল দোকানটা একটু দেখিস’...তারপর দুজনেই মিলিয়ে গেল।

(৩)
 
এখন রাত প্রায় একটা। রতন আর বাড়ি ফেরেনি। রাত নটা নাগাদ কয়েকজন মিলে  মাঠ পেরিয়ে রেললাইনের ধার থেকে দুটো দেহ ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে। রতনকে চেনা যাচ্ছিল না, সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। রতনের শুধু মৃতদেহ আনা হয়েছিল। শিবুর আঘাত খুব গুরুতর কিছু নয়, হাসপাতালে নিয়ে গেছে, মনে হয়  বাঁচানো যাবে। কি ঘটেছিল, কেন এমন হল...কেউ জানে না। হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফিরে এলেও শিবু যে বেশিদিন বাঁচবে না, বীণা বাঁচতে দেবে না, সেকথা বীণা জানে। কিন্তু তারও আগে তার জানা দরকার, কেন শিবু এ কাজ করল। কেউ দেখেনি, কিন্তু বীণা দেখেছে, দাদার হাতের মুঠোয় শিবুর ছেঁড়া জামার একটা টুকরো ধরা ছিল। শিবুকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল রতন, পারেনি। দোকানের  জন্য এত ঈর্ষা!  কি চেয়েছিল শিবু রতনের কাছ থেকে? জানতেই হবে তাকে, তার জন্য তাকে যত ঘুঘনি-পরোটা খাওয়ানো দরকার সে খাওয়াবে।

কঠিন চোখে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল বীণা, উত্তরটা খুঁজছে...।