গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫

দেবাশিস কোনার

আমার বেলা যে যায়

    আমি এখন হাওয়ায় উড়ছি । উঠতি বয়েস । মা-বাবার কথা শুনছি না । এদিক সেদিক করে একটা দুচাকা মটোর সাইকেল কিনে টো টো করে ঘুরছি দিন রাত । সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত । কারোর আমার দিকে নজর দেবার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই । সুতরাং আমি বিন্দাস আছি । কেবল মা মাঝে মাঝে আমাকে বিরক্ত করে । আসলে মায়ের চোখে ধুলো দেওয়াটা অত সহজ না । মায়ের বকবকানি শুনতে শুনতে আমার মাথা গরম হয়ে যায় । প্রচণ্ড রাগ হয় । উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপতে থাকে । তবু মা তো ! আমি কিছু করতে পারি না । রাগে , দুঃখে ও হতাশায় দুয়েকটা জিনিসপত্র ভাঙি।
    
আমি পলাশ দাশ । বাড়ি বিরহপুর । জাতিতে মুচি । তিনটে পাশ করে আমদের জাতের মান রক্ষা করেছি । আর আমাকে পায় কে ? আমার গাড়িটা ফিফথ হ্যান্ড । বুঝলেন না তো ? বুঝবেন না ! আচ্ছা সেকেন্ড হ্যান্ড বোঝেন ? হ্যাঁ , জানি বুঝবেন ! তাহলে থার্ড , ফোরথ এবং তারপর ফিফথ । বুঝে গেছেন , তাই না ? জানেন আমি বোঝাতে খুব ভাল পারি ।আমি যে পাড়ার ছেলেদের পড়াতাম । আমার ছাত্ররা সকলেই মাধ্যমিক পাশ । শিক্ষক হিসাবে আমার খুব সুনাম আছে ।এই গাড়িটা আসলে ওই পড়ানোর টাকা থেকেই কেনা । মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কেনা ।

    আমি এমন ছিলাম না । আমার চোখে স্বপ্ন ছিল । আমি ভেবেছিলাম একদিন আমি লেখাপড়া শিখে বড় কোনও চাকরি করব । বাবা মায়ের কষ্ট ঘোচাব । কিন্তু স্বপ্ন গুলো আর পূর্ণ হল না । আমি নিজে কখন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেলাম । আমাকে আগে গাঁয়ের মানুষ কত ভালবাসত । সম্মান দিত । আমি কি না সেই মর্যাদা নিজের দোষে হারিয়ে ফেললাম ? আমি জানি এখন আমার বয়স বাড়ছে । আমাকে আবার যদি সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে হয় , তাহলে কঠিন লড়াই করতে হবে । আমি কি আদৌ ভাল হতে পারব ?
    আগেই বলেছি আমি তিনটে পাশ করেছি । মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক । আমি দ্বিতীয়টা অবধি ঠিক ছিলাম । আমরা গরীব মানুষ , তায় আবার মুচি-মেথর সম্প্রদায়ের । বাবুরা আমাদের কি চোখে যে দ্যাখে তা তো হাড়ে হাড়ে জানি । কিন্তু তবুও আমি ফাঁদে পা দিলাম । উজ্জ্বল রায়ের ছেলে বসন্ত আমার থেকে দুই ক্লাশ উঁচুতে পড়ত । ফেল টেল করে সে ব্যাটা আমার সঙ্গ নিল । প্রচুর টাকা – পয়সার মালিক ওর বাবা । দু হাতে পয়সা ওরায় । আমাকে কেন জানি ওর ভীষণ পচ্ছন্দ হয়ে গেল । কলেজে শত শত বন্ধু , অথচ বসন্ত আমাকে বেশি গুরুত্ব দিত । ওর সাথে মেলা মেশা করতে দেখে একদিন বাবা আমাকে বলেছিল , ‘ পলাশ , উজ্জ্বলবাবু কিন্তু মোটেই সুবিধের লোক নয় । ওর ছেলে কি আর ভাল হতে পারে ? রক্তের দোষ যাবে কোথায় ?’

    আমি বাবার কথায় সেদিন গুরুত্ব দিই নি । ভেবেছিলাম অশিক্ষিত লোক । বিদ্যা বুদ্ধি কিছুই ঘটে নেই । আগেকার দিনে কবে কে কি করেছে ? এখন আর কেউই জাত পাত মানে না । তাছাড়া বসন্ত ভাল ছেলে । ও কি আর ওর বাবার মত হবে ? আমার তখন বাবার কথা মনে ধরে নি । কিন্তু শুধু বাবাই তো একা নয় , আমাকে বসন্তর সাথে মিশতে বারণ করেছিল সুশীল দাদু । সুশিল দাদু মস্ত গুনি লোক । বহু লড়াই আন্দোলনের সাক্ষী তিনি । গরিব মানুষ , বিশেষ করে মুচি , বাগদি , ডোম , মেটে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষজন তার কথা শুনে চলে । সেই দাদু তাকে খুব ভালবাসে । যতবার সে পাশ করেছে দাদু তাকে সাবাস জানিয়ে গেছে । সেই দাদু তাকে একদিন একান্তে ডেকে বলেছিল , ‘ দাদুরে , তোকে ঘিরে আমাদের যে অনেক স্বপ্ন , সেটা ভেঙ্গে দিস না ! ‘ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম । ভাবলাম এরা সব কুয়োর ব্যাঙ । তিনটে পাশ করলেই যদি এস সি দের চাকরি হত , তাহলে আর কথা ছিল না ! এরা তো গাঁয়ের মানুষ ! বাইরে যায় নি । সেখানে যে লক্ষ লক্ষ মুচি –বাগদি-ধোপা –নাপিত লেখাপড়া শিখে বসে আছে , তা কি এরা জানে ? হু , যতসব ! তবুও আমি দাদুকে সম্মান জানিয়ে বললাম , ‘ তোমাদের আশা এবং ভালবাসা পেয়েই তো আমি এতদূর এসেছি । চেষ্টা করছি ।‘

       দাদু কিন্তু গেড়ে বসলেন । বললেন, ‘ তোকে একটা কথা জানাই , মানে কথাটা খুব গোপনীয় ।‘ আমি নড়েচড়ে বসলাম ।কিন্তু সেদিন দাদু আমাকে কথাটা বলতে পারে নি । হটাত ই সদাই খুড়ো সুশিল দাদুকে ডেকে নিয়ে যায় , তার বিশেষ কাজে । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি । আমি এখন আর আগের মত সন্দেহবাতিক নই । গরিব মানুষ কেন যে বাবুদের সন্দেহের চোখে দ্যাখে তা আমি জানি না । ছোটলোক  ভদ্রলোক - এই বিভাজন এখন আর নেই । আগে ছিল । আমি নিজেই তো ভুক্তভোগী । আমি যখন লেখাপড়া করতাম , তখন কত বাবু এসে বাবাকে বলেছে , ‘ শম্ভু , ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে কি করবি , সেই তো ক্ষেত খামারেই কাজ করতে হবে ? দু কলম শিখে তখন আর মাঠে যেতে চাইবে না । তার চেয়ে বরং এখন থেকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দে ! কিছুদিন বাগালি করুক । তারপর না হয় আমিই নগদা রেখে দেব ।‘ আমার বাবার নাম শম্ভু । বাবা রাজি হয় নি । আমি কি ? সেই বাবাকেই অশিক্ষিত বলে এখন অবজ্ঞা করছি ?

    সেদিনটার কথা আমি কখনও ভুলব না । কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি । দুপুর বেলা । রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে । বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলাম । মাঠে কোন ফসল নেই । গাঁয়ের লোকজন গরু,ছাগ্‌ ভেড়া, মোষ ইত্যাদি যার যেমন আছে ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় জিরচ্ছে । পলাশ হন হন করে হাঁটছে । এলোকেশী এ সময় কোথায় ছিল কে জানে ? ছুটে এসে আমার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল । একসময় মেয়েটি আমার ছাত্রী ছিল । এই ক’দিনেই বেশ দেখতে হয়েছে । ওর দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না । হাঁপাতে হাঁপাতে বলল , ‘ পলাশ দাদা তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে ?’ মুচির ঘরে এমন সুন্দর রুপের ডালি ! ওর কথা কি না শুনে পারা যায় ? দু দণ্ড দাঁড়িয়ে পরলাম । এলোকেশী আমার কাছে যখন পড়ত , তখন থেকেই ওর প্রতি আমার একটা মোহ ছিল । ওর চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন এক মায়া । আমি ওর বুদ্ধির জন্যও ওকে বেশ পচ্ছন্দ করতাম । যা পড়াতাম চট করে ধরে নিত । আমি চেয়েছিলাম ও অনেকদূর অবধি পড়ুক । কিন্তু ওর বাবা অকালে মারা গেল । এলোকেশীর সৌভাগ্য যে মাধ্যমিকটা পাশ করেছিল । এখন গরু ছাগল পালন করে সংসার চালায় ।ওর একটা ভাই আছে । আমি বললাম , ‘ কি উপকার করতে হবে বলা হোক !’ আগে তুই তোকারি করতাম । এখন কেন যেন মনে হল , ও অনেক বড় হয়ে গেছে । এলোকেশী বলল , ‘ আমার ভাইকে পড়াবে ? আমার তো হল না । ভাইটার যদি হয়’ । আমি রাজি হলাম , বললাম , ‘ যাব একদিন বাড়িতে ।‘

    ওদের বাড়ি আর আমার যাওয়া হয় নি । তার পরিবর্তে আমাকে থানায় যেতে হয়েছিল । বসন্ত বরাবর বাইক চড়ে কলেজ যায় । সেদিনও গিয়েছিল । আমি বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই ওরা তিনজন ঝাঁপিয়ে পরেছিল এলোকেশীর ওপর । কিন্তু পারে নি । দাঁত – নখ আর সাহসের কাছে হার মেনেছে জানোয়ারগুলো । বসন্তের সঙ্গে ছিল ভদ্রলোক সমাজের আরও দু জন যুবক । মেয়ে দেখলেই যাদের লালসায় লালা ঝরে । তবুও আমি আমাদের গাঁয়ের গরীব মানুষগুলোর কাছে বেইমান প্রতিপন্ন হলাম । কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি । এমন কি এলোকেশী আমার কোনও দোষ নেই বলবার পরেও ওরা আমাকে ক্ষমা করেনি । বলুন , এত ঘৃণা কি সহ্য করা যায় ? আমিও সহ্য করতে পারি নি । আমি বদলে গেলাম । আমার সমস্ত স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল ।

    খবরটা শুনেই আমি ছুটে গিয়েছিলাম পঞ্চায়েত দপ্তরে । সেখানে এলোকেশী মাথা হেঁট করে বসে ছিল । তার ঠোঁটে রক্ত । হাতে মুখে নখের আচরের দাগ । আমি সেখানে পৌঁছানোর আগেই একদল লোক ধেয়ে এল আমার দিকে । কেউ বলল , ‘ ঘর শত্রু বিভীষণ !’ কেউ বলল , ‘দালাল !’ আবার কেউ বলল , ‘শয়তান একটা !’ আমি দূর থেকে এলোকেশীর দিকে তাকালাম । দেখলাম সে মুখে ঘৃণার চিহ্ন পর্যন্ত নেই । ওই টুকুই শান্তনা আমার । আমি ফিরে এলাম বাড়ি । দেখলাম বাড়িতে মা – বাবাও আমার প্রতি রুষ্ট ।