আমার বেলা যে যায়
আমি এখন হাওয়ায় উড়ছি । উঠতি বয়েস । মা-বাবার
কথা শুনছি না । এদিক সেদিক করে একটা দুচাকা মটোর সাইকেল কিনে টো টো করে ঘুরছি দিন
রাত । সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত । কারোর আমার দিকে নজর দেবার সময় বা ইচ্ছা
কোনটাই নেই । সুতরাং আমি বিন্দাস আছি । কেবল মা মাঝে মাঝে আমাকে বিরক্ত করে । আসলে
মায়ের চোখে ধুলো দেওয়াটা অত সহজ না । মায়ের বকবকানি শুনতে শুনতে আমার মাথা গরম হয়ে
যায় । প্রচণ্ড রাগ হয় । উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপতে থাকে । তবু মা তো ! আমি কিছু
করতে পারি না । রাগে , দুঃখে ও হতাশায় দুয়েকটা জিনিসপত্র ভাঙি।
আমি পলাশ দাশ । বাড়ি বিরহপুর । জাতিতে মুচি ।
তিনটে পাশ করে আমদের জাতের মান রক্ষা করেছি । আর আমাকে পায় কে ? আমার গাড়িটা ফিফথ
হ্যান্ড । বুঝলেন না তো ? বুঝবেন না ! আচ্ছা সেকেন্ড হ্যান্ড বোঝেন ? হ্যাঁ , জানি
বুঝবেন ! তাহলে থার্ড , ফোরথ এবং তারপর ফিফথ । বুঝে গেছেন , তাই না ? জানেন আমি
বোঝাতে খুব ভাল পারি ।আমি যে পাড়ার ছেলেদের পড়াতাম । আমার ছাত্ররা সকলেই মাধ্যমিক
পাশ । শিক্ষক হিসাবে আমার খুব সুনাম আছে ।এই গাড়িটা আসলে ওই পড়ানোর টাকা থেকেই
কেনা । মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কেনা ।
আমি এমন ছিলাম না । আমার চোখে স্বপ্ন ছিল ।
আমি ভেবেছিলাম একদিন আমি লেখাপড়া শিখে বড় কোনও চাকরি করব । বাবা মায়ের কষ্ট ঘোচাব
। কিন্তু স্বপ্ন গুলো আর পূর্ণ হল না । আমি নিজে কখন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেলাম ।
আমাকে আগে গাঁয়ের মানুষ কত ভালবাসত । সম্মান দিত । আমি কি না সেই মর্যাদা নিজের
দোষে হারিয়ে ফেললাম ? আমি
জানি এখন আমার বয়স বাড়ছে । আমাকে আবার যদি সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে হয় , তাহলে কঠিন
লড়াই করতে হবে । আমি কি আদৌ ভাল হতে পারব ?
আগেই বলেছি আমি তিনটে পাশ করেছি । মাধ্যমিক ,
উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক । আমি দ্বিতীয়টা অবধি ঠিক ছিলাম । আমরা গরীব মানুষ , তায়
আবার মুচি-মেথর সম্প্রদায়ের । বাবুরা আমাদের কি চোখে যে দ্যাখে তা তো হাড়ে হাড়ে
জানি । কিন্তু তবুও আমি ফাঁদে পা দিলাম । উজ্জ্বল রায়ের ছেলে বসন্ত আমার থেকে দুই
ক্লাশ উঁচুতে পড়ত । ফেল টেল করে সে ব্যাটা আমার সঙ্গ নিল । প্রচুর টাকা – পয়সার
মালিক ওর বাবা । দু হাতে পয়সা ওরায় । আমাকে কেন জানি ওর ভীষণ পচ্ছন্দ হয়ে গেল ।
কলেজে শত শত বন্ধু , অথচ বসন্ত আমাকে বেশি গুরুত্ব দিত । ওর সাথে মেলা মেশা করতে
দেখে একদিন বাবা আমাকে বলেছিল , ‘ পলাশ , উজ্জ্বলবাবু কিন্তু মোটেই সুবিধের লোক নয়
। ওর ছেলে কি আর ভাল হতে পারে ? রক্তের দোষ যাবে কোথায় ?’
আমি বাবার কথায় সেদিন গুরুত্ব দিই নি ।
ভেবেছিলাম অশিক্ষিত লোক । বিদ্যা বুদ্ধি কিছুই ঘটে নেই । আগেকার দিনে কবে কে কি
করেছে ? এখন আর কেউই জাত পাত মানে না । তাছাড়া বসন্ত ভাল ছেলে । ও কি আর ওর বাবার
মত হবে ? আমার তখন বাবার কথা মনে ধরে নি । কিন্তু শুধু বাবাই তো একা নয় , আমাকে
বসন্তর সাথে মিশতে বারণ করেছিল সুশীল দাদু । সুশিল দাদু মস্ত গুনি লোক । বহু লড়াই
আন্দোলনের সাক্ষী তিনি । গরিব মানুষ , বিশেষ করে মুচি , বাগদি , ডোম , মেটে
ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষজন তার কথা শুনে চলে । সেই দাদু তাকে খুব ভালবাসে ।
যতবার সে পাশ করেছে দাদু তাকে সাবাস জানিয়ে গেছে । সেই দাদু তাকে একদিন একান্তে
ডেকে বলেছিল , ‘ দাদুরে , তোকে ঘিরে আমাদের যে অনেক স্বপ্ন , সেটা ভেঙ্গে দিস না !
‘ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম । ভাবলাম এরা সব কুয়োর ব্যাঙ । তিনটে পাশ করলেই যদি এস
সি দের চাকরি হত , তাহলে আর কথা ছিল না ! এরা তো গাঁয়ের মানুষ ! বাইরে যায় নি ।
সেখানে যে লক্ষ লক্ষ মুচি –বাগদি-ধোপা –নাপিত লেখাপড়া শিখে বসে আছে , তা কি এরা
জানে ? হু , যতসব ! তবুও আমি দাদুকে সম্মান জানিয়ে বললাম , ‘ তোমাদের আশা এবং
ভালবাসা পেয়েই তো আমি এতদূর এসেছি । চেষ্টা করছি ।‘
দাদু
কিন্তু গেড়ে বসলেন । বললেন, ‘ তোকে একটা কথা জানাই , মানে কথাটা খুব গোপনীয় ।‘
আমি নড়েচড়ে বসলাম ।কিন্তু সেদিন দাদু আমাকে কথাটা বলতে পারে নি । হটাত ই সদাই খুড়ো
সুশিল দাদুকে ডেকে নিয়ে যায় , তার বিশেষ কাজে । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি । আমি এখন আর
আগের মত সন্দেহবাতিক নই । গরিব মানুষ কেন যে বাবুদের সন্দেহের চোখে দ্যাখে তা আমি
জানি না । ছোটলোক ভদ্রলোক - এই বিভাজন এখন
আর নেই । আগে ছিল । আমি নিজেই তো ভুক্তভোগী । আমি যখন লেখাপড়া করতাম , তখন কত বাবু
এসে বাবাকে বলেছে , ‘ শম্ভু , ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে কি করবি , সেই তো ক্ষেত
খামারেই কাজ করতে হবে ? দু কলম শিখে তখন আর মাঠে যেতে চাইবে না । তার চেয়ে বরং এখন
থেকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দে ! কিছুদিন বাগালি করুক । তারপর না হয় আমিই নগদা রেখে দেব
।‘ আমার বাবার নাম শম্ভু । বাবা রাজি হয় নি । আমি কি ? সেই বাবাকেই অশিক্ষিত বলে
এখন অবজ্ঞা করছি ?
সেদিনটার কথা আমি কখনও ভুলব না । কলেজ থেকে
বাড়ি ফিরছি । দুপুর বেলা । রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে । বাস থেকে
নেমে হাঁটা দিলাম । মাঠে কোন ফসল নেই । গাঁয়ের লোকজন গরু,ছাগ্ ভেড়া, মোষ ইত্যাদি
যার যেমন আছে ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় জিরচ্ছে । পলাশ হন হন করে হাঁটছে । এলোকেশী এ
সময় কোথায় ছিল কে জানে ? ছুটে এসে আমার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল । একসময় মেয়েটি আমার
ছাত্রী ছিল । এই ক’দিনেই বেশ দেখতে হয়েছে । ওর দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না ।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল , ‘ পলাশ দাদা তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে ?’ মুচির ঘরে
এমন সুন্দর রুপের ডালি ! ওর কথা কি না শুনে পারা যায় ? দু দণ্ড দাঁড়িয়ে পরলাম । এলোকেশী
আমার কাছে যখন পড়ত , তখন থেকেই ওর প্রতি আমার একটা মোহ ছিল । ওর চোখের দৃষ্টিতে
কেমন যেন এক মায়া । আমি ওর বুদ্ধির জন্যও ওকে বেশ পচ্ছন্দ করতাম । যা পড়াতাম চট
করে ধরে নিত । আমি চেয়েছিলাম ও অনেকদূর অবধি পড়ুক । কিন্তু ওর বাবা অকালে মারা গেল
। এলোকেশীর সৌভাগ্য যে মাধ্যমিকটা পাশ করেছিল । এখন গরু ছাগল পালন করে সংসার চালায়
।ওর একটা ভাই আছে । আমি বললাম , ‘ কি উপকার করতে হবে বলা হোক !’ আগে তুই তোকারি
করতাম । এখন কেন যেন মনে হল , ও অনেক বড় হয়ে গেছে । এলোকেশী বলল , ‘ আমার ভাইকে
পড়াবে ? আমার তো হল না । ভাইটার যদি হয়’ । আমি রাজি হলাম , বললাম , ‘ যাব একদিন
বাড়িতে ।‘
ওদের বাড়ি আর আমার যাওয়া হয় নি । তার পরিবর্তে
আমাকে থানায় যেতে হয়েছিল । বসন্ত বরাবর বাইক চড়ে কলেজ যায় । সেদিনও গিয়েছিল । আমি
বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরই ওরা তিনজন ঝাঁপিয়ে পরেছিল এলোকেশীর ওপর । কিন্তু পারে নি
। দাঁত – নখ আর সাহসের কাছে হার মেনেছে জানোয়ারগুলো । বসন্তের সঙ্গে ছিল ভদ্রলোক
সমাজের আরও দু জন যুবক । মেয়ে দেখলেই যাদের লালসায় লালা ঝরে । তবুও আমি আমাদের
গাঁয়ের গরীব মানুষগুলোর কাছে বেইমান প্রতিপন্ন হলাম । কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি
। এমন কি এলোকেশী আমার কোনও দোষ নেই বলবার পরেও ওরা আমাকে ক্ষমা করেনি । বলুন , এত
ঘৃণা কি সহ্য করা যায় ? আমিও সহ্য করতে পারি নি । আমি বদলে গেলাম । আমার সমস্ত
স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল ।
খবরটা শুনেই আমি ছুটে গিয়েছিলাম পঞ্চায়েত
দপ্তরে । সেখানে এলোকেশী মাথা হেঁট করে বসে ছিল । তার ঠোঁটে রক্ত । হাতে মুখে নখের
আচরের দাগ । আমি সেখানে পৌঁছানোর আগেই একদল লোক ধেয়ে এল আমার দিকে । কেউ বলল , ‘
ঘর শত্রু বিভীষণ !’ কেউ বলল , ‘দালাল !’ আবার কেউ বলল , ‘শয়তান একটা !’ আমি দূর
থেকে এলোকেশীর দিকে তাকালাম । দেখলাম সে মুখে ঘৃণার চিহ্ন পর্যন্ত নেই । ওই টুকুই
শান্তনা আমার । আমি ফিরে এলাম বাড়ি । দেখলাম বাড়িতে মা – বাবাও আমার প্রতি রুষ্ট ।