ঝরা পাতার ধ্বনি
আজ ইংরেজী নববর্ষ
, ২০৪০ সাল । সুশীল সমাজ আয়োজিত ‘শান্তির বার্তা ‘ পদক বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে
। প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত আছেন নারী সংগঠনের সম্মানিত চেয়ারম্যান বেগম মিলি
সুলতানা । পুরষ্কার ঘোষিত হলো , এবারের শান্তির বার্তা পদক লাভ করেছেন, জনাব আরিফ
সাহেবের পথশিশুদের নিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠান
‘ঝরা পাতার
ধ্বনি’ । আরিফ সাহেব মঞ্চে গেলেন , নির্বোধের মত ভ্যাবাচেকা হাসি হেসে দাড়ালেন
বেগম মিলি সুলতানার সামনে । পুরষ্কার নেয়ার পর দর্শকদের উদ্দেশ্যে তাকে কিছু বলার
জন্য অনুরোধ করা হল । তার বক্তব্য শুরুর আগে তার সমন্ধে দু চারটি কথা জেনে নেওয়া
যাক । বয়স ৪৫, বিয়ে করেননি । তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিই এখন তার পরিবার । এই
প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হল , পথশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা ।
তিনি বক্ত্বৃতা
শুরু করলেন , এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পিছনের গল্প বললেন :
আরিফ সাহেবের তখন
পচিঁশ বছর বয়স । পার্কে মিলি ও আরিফ গল্প করছে ।
মিলি : এবারের
নববর্ষ টা কেমন করে উদযাপন করি বলতো ।
আরিফ : রিকসা করে
সারা ঢাকা শহর ঘুরবো ।
মিলি : তোমাকে
আমি নববর্ষে কি উপহার দেবো বুঝতে পারছি না ।
আরিফ : বুঝতে
পারার দরকার কি, উপহার কি মানুষ বলে কয়ে দেয় নাকি , যখন দেয় তখন যা দেয় তাই উপহার
হয়ে দাড়ায় ।
মিলি : তুমি
আমাকে কি দেবে ?
আরিফ : বলবো কেনো
, ঐ গানটি শোননি, তবে থাক,তোলা থাক না বলা
কথা ।
মিলি : হাসতে
হাসতে, তোমার দুষ্টুমিই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ উপহার ।
আগামীকাল নববর্ষ
। আরিফ পড়ন্ত বিকালে ফুটপাত ধরে হাটছে আর চিন্তা করছে , মিলির জন্য কি কেনা যায় ।
একটা ৭-৮ বছরের ছেলে একটি রজনীগন্ধার স্টিক হাতে ধরে বলল, স্যার একটা ফুল নেবেন,
কাল নববর্ষ । আরিফ না সূচক মাথা নাড়ল । ছেলেটি বিনীত ভাবে আবার বলল, নেন না স্যার
একটা ফুল ।
আরিফ ছেলেটার দিকে
তাকাল , মায়াবী চেহারার ছেলেটা, চোখে মুখে কষ্টের ছাপ । আরিফ একটা ফুল নিয়ে সযত্নে
ছেলেটির হাত ধরে প্রশ্ন করল, খোকা তোমার নাম কি ?
ছেলেটি বলল :
রন্জু
আরিফ : ও আচ্ছা ।
তোমার পরিবারে কে কে আছেন ?
ছেলেটি : আমি আর
আমার মা , বাবা মারা গেছেন ।
আরিফ : ফুল বিক্রির
টাকায় তোমার সংসার চলে ?
ছেলেটির চোখ দুটি
ছল ছল করে উঠল । চোখের পানি সামলে সে বলল, স্যার আমার মায়ের অসুখ । ডাক্তার বলছে
অপারেশন করাতে হবে, পচিঁশ হাজার টাকা লাগবে । দেরী হলে মায়ের বাঁচার সম্ভাবনা কম ।
আমি স্যার অনেক কষ্টে বাইশ হাজার টাকা যোগাড় করেছি । এদিকে মার অবস্থা আরো খারাপ
হয়েছে । বাকী তিন হাজার টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাড় করতে হবে । নইলে স্যার ,
আমার মা বাচঁবে না ।
আরিফের মনটা
ব্যাথায় ভরে উঠল । একটা আট বছরের ছেলে অসুস্থ মাকে বাচাঁনোর জন্য রাতদিন পরিশ্রম
করছে । কখনো আধপেটা খেয়ে , কখনো শুধু পানি খেয়েই পেট ভরাচ্ছে । নিজেকে আরিফের খুব
ছোট মনে হল এই ছেলেটার কাছে । সে মিলির উপহার কিনতে যে চার হাজার টাকা পকেটে
রেখেছিলো তার পুরোটাই ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, তোমার মা অবশ্যই সুস্থ হয়ে
উঠবেন । আমি আগামী কাল সকালে এখানে আসব । তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে ।
দুজনে মিলে তোমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো , কেমন ! ছেলেটি কিছুই বলতে পারলো না ,
শুধু ফুঁফিয়ে কাদতে লাগল ।
আজ নববর্ষ । আরিফ
সকালে বের হলো । রন্জুর মাকে হাসপাতালে পৌছে দিয়ে মিলির সংগে দেখা করতে হবে । নির্দিষ্ট
যায়গায় পৌছে দেখে, ছেলেটি আগেই দাড়িয়ে আছে । দুজনে রন্জুর বাড়ি তথা রাস্তার পাশের
খুপরি ঘরে গেল । আরিফ যতটা আন্দাজ করেছিলো, রন্জুর মায়ের অবস্থা তার চেয়েও বেশী
খারাপ । তাড়াতাড়ি একটা অটো রিকসা করে দুজনে মিলে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ।
ডাক্তার বললেন, রাতে অপারেশন হবে । রন্জুকে নিয়ে আরিফ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো ।
রন্জুকে বলল, তুমি মায়ের পাশে থাকো , আমি সন্ধায় আবার আসব ।
রন্জুকে বিদায়
দিয়ে আরিফ দৌড়ে একটি চলন্ত বাসে উঠতে গেল কিন্তু পারল না । মাথায় প্রচন্ড আঘাত
পেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ল । রন্জু হাসপাতাল অভিমুখে যাচ্ছিল, চিৎকার চেঁচামেচি শুনে
পিছন ফিরে দেখল আরিফ রাস্তায় পড়ে আছে । সে দৌড়ে গিয়ে আরিফকে টেনে তুলল । তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা
কেন্দ্রে নেয়া হল । ভীড়ের মধ্যে মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় পরিবারের সংগে যোগাযোগ করা
সম্ভব হলোনা ।
পরদিন সন্ধ্যায়
আরিফের জ্ঞান ফিরল । ধীরে ধীরে সে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করল । তার রন্জুর কথা
মনে পড়ল । সে ডাক্তারকে রন্জুর মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করল । ডাক্তার জানালেন , সে
অ্যাকসিডেন্ট করার পর রন্জু তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে । মাথায় প্রচন্ড আঘাতের ফলে
জরুরী অপারশনের প্রয়োজন পড়ে । রন্জু মায়ের চিকিৎসার জন্য গচ্ছিত সকল টাকাই আরিফের অপারেশনের জন্য তুলে
দেয় । আজ সকালে রন্জুর মা মারা গেছে , সে মাকে কবর দিতে গেছে
। কবর দেয়া শেষে সে এখানে আসবে ।
আরিফ পাথরের মত
বেডের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে । তার পৃথিবী যেন চতুর্দিকে ঘুরতে আরম্ভ করেছে ।
এ ঋণ সে কিভাবে শোধ করবে । টাকার ঋণ শোধ হয়, রক্ত দিয়ে রক্তের ঋণ শোধরানো যায়
কিন্তু যে ছেলে মৃতপ্রায় মায়ের চিকিৎসার পুরো টাকা অপরিচিত কারো চিকিৎসার জন্য
তুলে দেয় , তার ঋণ , সেই মাতৃস্নেহের ঋণ কি দিয়ে শোধ করবে সে ।
ইতোমধ্যে রন্জু
ফিরে এসেছে । আরিফকে ঔষুধ খাইয়ে দিল ।
আরিফের মনে হল , পথচারী এই শিশুর সাথে তার গাঁটছাড়া বাঁধা হয়ে গেছে চিরকালের জন্য ।
সেই থেকেই ‘
ঝরাপাতার ধ্বনি ’ র কার্যক্রম শুরু ।
বক্ত্বৃতা শেষ হলো
। দর্শকদের প্রায় সকলের চোখে পানি । বেগম মিলি সুলতানার চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে , এ
অশ্রু যেন আজকের নয় । এ যেন বিশ বছর আগের সেই মিলির চোখের অশ্রু ।