গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়



অমল বাবু

অফিসে অমল বাবু নামে নতুন এক অফিসার জয়েন করলেন। ইনি অতি কৃপণ, তবে চেহারা ও ব্যবহার একবারেই শিশুসুলভ। তিনি স্থানীয় এলাকার দীর্ঘদিনের বাসা ছেড়ে অচেনা অজানা কোন্নগরে একটা বাড়ি কিনে বসলেন। অতদুরে হঠাৎ এক অচেনা জায়গায় চলে যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি শুধু বললেন, “আপনার কোন ধারণা নেই, জায়গাটা খুব ভালো ও সস্তা। আমার বাড়ির কাছেই একটা দোকান আছে, রুটি কিনলে তরকারী ফ্রী”। শুধু বিনা পয়সার তরকারীর লোভে যে কেউ বাড়ি কেনার জায়গা পছন্দ করে, জানা ছিল না।

এই অমল বাবু কথায় কথায় বাজি ধরে বসতেন। তবে খাওয়া ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তাঁকে বাজি ধরতে কখনও দেখি নি। একদিন হঠাৎ কে কত তাড়াতাড়ি রাজভোগ খেতে পারে তাই নিয়ে গুলতানির মাঝে ঢুকে পড়ে অমল বাবু ঝাঁ করে বাজি ধরে বসলেন যে, তিনি ত্রিশটা রাজভোগ রস না চিপে, পনের মিনিটে খেয়ে নেবেন। সকলেই একটা করে ঘটনার কথা বলতে শুরু করায়, ত্রিশটা রাজভোগ খাওয়ার ঘটনা যে পৃথিবীতে আগে অনেক ঘটেছে, এবং অনেক কম সময়ে খেয়ে সেইসব ব্যক্তিরা যে আজও অমর হয়ে আছেন— এটা তাঁর কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। ফলে বাধ্য হয়ে সময়টা সাত মিনিটে নামিয়ে আনতেই হল। শেষে দুই পক্ষের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি (MOU) হ’ল, যে তিনি সাত মিনিটে ত্রিশটি রাজভোগ রস না চিপে খেয়ে নিতে পারলে তাঁকে আর একদিন পেট ভরে মাংস ভাত খাওয়ানো হবে। না পারলে তিনি রাজভোগের দাম ফেরৎ দিতে বাধ্য থাকবেন। মিষ্টির হাঁড়িতে পড়ে থাকা অবশিষ্ট রসটাও খেয়ে নেবার ও সময়ের মধ্যে খেতে না পারলে মিষ্টির দাম ফেরৎ ছাড়াও সবাইকে মাংস ভাত খাওয়ানোর প্রস্তাব পেশ হলেও, শেষে সেই প্রস্তাব বাতিল করা হয়।

পরের দিন অফিস ছুটির পরে বড় হাঁড়ি করে ত্রিশটা রাজভোগ নিয়ে আসা হল। বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় ত্রিশটা রাজভোগ খেতে হবে জেনেও তিনি দুপুরে অন্যান্য দিনের মতোই টিফিন করেছিলেন। তবে খাওয়া শুরু করার আগে তিনি পেশাদার খেলোয়ারের মতো রাজভোগের সংখ্যা একবার গুণে দেখে নিলেন।
খাওয়া শুরু হল। অতি দ্রুত গতিতে এক একবারে দু-তিনটে করে রাজভোগ তুলে মুখে পুরে তিনি খেতে, থুরি প্রায়  গিলতে শুরু করলেন। এরমধ্যেও অপর পক্ষ আপত্তি জানালো — হাঁড়ি থেকে  রাজভোগ তোলার সময় তিনি এত জোরে ধরছেন, যে অনেক রস হাঁড়িতে পড়ে যাচ্ছে। কাজেই অত জোরে মিষ্টি ধরে তোলা চলবে না। 

অমল বাবু যখন খাওয়া শেষ করলেন, তখনও সাত মিনিট সময় অতিক্রান্ত হয় নি। কনুই পর্যন্ত হাত, জামার বুকের কাছটা, এমন কী প্যান্টেরও কোথাও কোথাও মিষ্টির রস মেখে তিনি বাজিমাৎ করার ঘোষণা শুনবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অপরদিকে এপক্ষের দু-একজন ঘড়ির দিকে ও মাঝেমাঝে মিষ্টির হাঁড়ির দিক লক্ষ্য রেখে অপেক্ষা করে অবশেষে ঘোষণা করলো— “সময় শেষ। অমল বাবু নির্দিষ্ট সময়ে বাজিমাৎ করতে পারেন নি, কারণ মিষ্টির হাঁড়িতে এখনও মিষ্টি পড়ে আছে”। দেখা গেল তাড়াহুড়ো করে এক একবারে দু-তিনটে করে রাজভোগ তুলে মুখে পুরতে গিয়ে, অণু পরিমান একটা টুকরো হাঁড়িতে পড়ে আছে। অমল বাবু এটা দেখতে পান নি, তা নাহলে তাঁর হাতে সেটা খেয়ে নেবার মতো অনেক সময় ছিল। এই নিয়ে তুমুল অশান্তি শুরু হলে, অমল বাবুর প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ম্যানেজার অমল বাবুর পক্ষে রায় দিয়ে তাঁকে জয়ী ঘোষণা করলেন। ততক্ষণে তাঁর জামা প্যান্টের রস শুকিয়ে চিনি হয়ে গেছে। পরে একদিন অবশ্য তাঁকে কথামতো মাংস ভাতও খাওয়ানো হয়।

পরবর্তীকালে অফিসের অন্য এক শাখায় শুনেছিলাম যে, অমল বাবু অফিসের আর সকলের সঙ্গে একজনের বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার আগে ঐ শাখার এক চতুর্থ শ্রেণী কর্মীর পরামর্শে খিদে বাড়াবার জন্য জামা প্যান্ট খুলে আন্ডারওয়ার পরে দীর্ঘক্ষণ অফিসের ভিতর পায়চারি করেছিলেন। অমল বাবু তখন ঐ শাখার ম্যানেজার ছিলেন। 

এই অমল বাবু একদিন অফিস থেকে বেশ দুরে এক বড় বাজার এলাকায় গেলেন একটা বালতি কিনতে। বালতি কেটে তিনি একটি তোলা উনন তৈরী করবেন। অফিসের নীচেই বেশ কিছু দোকান থাকা সত্ত্বেও অত দুরে যাওয়ার কারণ হিসাবে জানা গেল, ওখানে অনেক দোকান থাকায় পছন্দমতো মজবুত বালতি অনেক সস্তায় পাওয়া যাবে। যাহোক্, তিনি অনেক দোকান ঘুরে, অনেক দরদাম করে “লক্ষ্মী” মার্কা এক বালতি কিনে, কোথা থেকে একবারে উননের উপযোগী বালতির নীচের দিকে বেশ খানিকটা কেটে ও ফুটো করে করে প্রয়োজনীয় শিক লাগিয়ে অফিসে ফিরলেন। বাড়ি ফিরে শুধু মাটি লাগাতে হবে।
দিন দু’-এক পরে কী কারণে ঐ এলাকায় গিয়ে তিনি হঠাৎ এক দোকানের সন্ধান পেয়ে, মনোকষ্টে একবারে ভেঙ্গে পড়লেন। কারণ ঐ দোকানে “লক্ষ্মী” মার্কা বালতি দু’টাকা কম দামে বিক্রী হচ্ছে। এই ক্ষতি ও অসততা মেনে নিতে না পেরে, তিনি তৎক্ষণাত পূর্বের দোকানে গিয়ে ক্ষোভ ও অভিযোগ জানিয়ে টাকা ফেরৎ চাইলেন। দোকানদার জানালেন “কোন দোকান কী দামে বিক্রী করছে জানি না, তবে আমার দোকানে বালতি এই দামেই বিক্রী হয়”। এই নিয়ে বিস্তর কথা কাটাকাটির পর, দোকানদার বিরক্ত হয়ে, বালতি ফেরৎ দিয়ে টাকা ফেরৎ নিয়ে যেতে বললেন। বালতি ফেরৎ দেবার কোন সুযোগ না থাকায়, আর কেউ হলে হয়তো হৃদরোগে আক্রান্ত হতেন, কিন্ত অমল বাবু ভেঙ্গে পড়ার লোক নন। ঠান্ডা মাথায় অনেক চিন্তা করে, শেষে অপর দোকান থেকে দু’টাকা কম দামে লক্ষ্মী মার্কা আর একটা বালতি কিনে, এই দোকানে এসে বালতি ফেরৎ দিয়ে লোকসানের হাত থেকে বাঁচলেন।