সমর্পণ
এক্ষণে
ঈশ্বর ব্যতীত জ্ঞানেশ্বরের আর কিছুই রহিল না। সংসারের মায়া ত্যাগ করিয়াছেন বহুদিন।
তাহার অর্থ এই নয় যে তিনি সংসার হইতে পৃথক হইয়া ছিলেন,
সংসারে থাকিয়াও নিজ কর্তব্যকর্মটুকু করিয়া বাকী সময় ঈশ্বর
চিন্তাতেই অতিবাহিত করিতে ছিলেন। সংসারের সেই সূত্রটুকুও এক্ষণে শেষ হইয়াছে।
কিছুকাল
হইতেই নানাস্থান
ভ্রমণ করিতেছিলেন। ভ্রমণ
করিতে করিতে এই স্থানটি মনোমত হওয়ায় বিঘা কতক জমি ক্রয় করিয়া দেবতার মন্দির নির্মাণ করিলেন। মন্দিরের
একপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্রকায় বসতবাটী নির্মাণ করিলেন নিজ ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে ফল,
ফুল ও অন্যান্য ঔষধি বৃক্ষ, লতাগুল্ম
লাগাইলেন। একটি নিম্ন সম্প্রদায়ের কিশোর আসিয়া বাগান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম
করিয়া দেয়। কামারপাড়া
হইতে একটি বিধবা রমণী দুইবেলা আসিয়া তাহার প্রয়োজনমত আহারের ব্যবস্থা করিয়া দেন। রমণীটির
দুইটি বালক পুত্রের বিদ্যালয়ের পাঠাদির যাবতীয় খরচ জ্ঞানেশ্বর বহন করেন,
রমণীটিকেও রন্ধনাদির পরিবর্তে মাসিক কিছু অর্থ সাহায্য করিয়া
থাকেন। কয়েক
বৎসর এইভাবেই চলিয়া আসিতেছে।
প্রত্যুষে
বাগান হইতে পুষ্প ইত্যাদি চয়ন করিয়া একটি কাংস্যপাত্রে তাহা রাখিয়া কিশোরটি
নিজকর্মে নিযুক্ত হয়। কিন্তু মন্দিরে জ্ঞানেশ্বর যখন ধ্যানে বসিয়া থাকেন,
কিশোরটি তাহা নিমগ্নচিত্তে দেখিতে থাকে। জ্ঞানেশ্বরের ধ্যান
সমাপ্ত হইলে পুষ্প সকল একটি বেদীতে অর্পণ করেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে অন্য
কোন দেবতার বিগ্রহ নাই। পুষ্প ব্যতীত আর পূজার অন্য কোন উপকরণও নাই। পুষ্পাঞ্জলির
মাধ্যমে তাঁহার অন্তরের আকুলতা দেবতার নিকটে তিনি পৌঁছাইয়া দেন।
জ্ঞানেশ্বর
মন্দিরের সোপান হইতে নামিয়া
দেখিলেন কিশোরটি প্রাঙ্গন পরিষ্কার করিতেছে। জ্ঞানেশ্বর নিচে অবতরণ করিলে কিশোরটি
তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিল, তিনি তাহাকে
চক্ষের ইশারায় মন্দিরের প্রতি ইঙ্গিত করিলেন, কিশোরটি
নীরবে মস্তক নাড়িল। জ্ঞানেশ্বর গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। কিশোরটি প্রাঙ্গন
মার্জনা করিয়া মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করিল। সমস্ত মন্দির মার্জনা করিয়া, ধুইয়া, মুছিয়া মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া চাবি
একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখিয়া দিল। গৃহের অভ্যন্তর হইতে জ্ঞানেশ্বর দুই গেলাস
দুগ্ধ আনিয়া একটি গেলাস
কিশোরের দিকে বাড়াইলেন, কিশোর তাহা গ্রহণ
করিয়া মন্দির সোপানের শেষ ধাপটিতে
বসিয়া দুগ্ধ পান করিতে লাগিল। জ্ঞানেশ্বর অল্পক্ষণ কিশোরের পানে
চাহিয়া নিজ গেলাসটি হাতে করিয়া গৃহের সম্মুখে বারান্দায় একটি বেতের চেয়ারে বসিয়া
ধীরে ধীরে পান করিতে লাগিলেন। জ্ঞানেশ্বরের প্রাতঃকালীন কর্ম সম্পূর্ণ হইল। এইবার তিনি পাঠে মনোনিবেশ করিবেন।
(২)
জ্ঞানদারঞ্জন
ভট্টাচার্য্যের দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেরা কৃতী, বিবাহিত। মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই স্ত্রী মারা গেলেন। খুব যে একটা বয়স হয়েছিল,
তা বলা যাবে না। একেবারে আকস্মিক মৃত্যু বলা যায়। সংসারে
জ্ঞানদারঞ্জনের আর মন ছিল না। মেয়ের বিয়ের পর থেকেই সংসার থেকে মন উঠিয়ে নিয়েছিলেন। যেটুকু নাহলে
নয়, সেটুকুই বজায় ছিল। ছেলেরা বয়সে বড়, তাদের বিয়ে তাঁরা
স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই পছন্দ করে, নাম-গোত্র, সংষ্কার মিলিয়েই দিয়েছেন। গোল বাধল মেয়ের বিয়ের সময়। সবকিছু যেন
অন্যরকম হল। মেয়ে বিয়ে করতে চাইল নিজের পছন্দমতো। পাত্র অপছন্দ হলেও হয়ত জ্ঞানদারঞ্জন তা মেনে নিতেন, কিন্তু
মেয়ে বিয়ে করতে চাইল অব্রাহ্মণ এক পাত্রকে। জ্ঞানদারঞ্জনের পক্ষে এই অসবর্ণ বিয়ে মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হল
না। উচ্চ পন্ডিত বংশের সন্তান বলে তাঁর অহঙ্কার এবং সংষ্কার দুই ছিল। কিছুতেই মানবেন না,
জেদ ধরে বসে রইলেন। স্ত্রীর আকুতি-মিনতিতে, ছেলেদের অনুরোধে এবং তত্ত্বাবধানে বিয়ে হল। জ্ঞানদারঞ্জন এই বিয়েতে কোন ভূমিকাতেই রইলেন না। বর এল,
খাওয়া-দাওয়া হল, কিন্তু সবই কেমন যেন
মিয়োন সুরে। বিয়ের সময় তাঁকে কাছাকাছি কোথাও দেখা গেল না। কন্যা-সম্প্রদানের সময়
জ্ঞানদারঞ্জনকে গৃহদেবতার মন্দিরে খুঁজে পাওয়া গেলে অনেক অনুরোধ, উপরোধ করা হল।
তিনি এককথায় বিরক্তি ও অসম্মতি
প্রকাশ করলেন। স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিতকে ডেকে কন্যা সম্প্রদান করা হল। বর ও কনের
সঙ্গেও তাঁর কোনরকম বাক্যবিনিময় হল না। মেয়ে চোখের জলে বাপের বাড়ি ছাড়ল,
পাত্রটির সঙ্গেও তাঁর কোন রকম বাক্যালাপ তো দুরের কথা, সামনেও এলেন না। একরকমের অপমানিত হয়েই ছেলেটি নতুন বিবাহিতা স্ত্রীকে
নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেল। মেয়ের এই পরিণামে স্ত্রী আঘাত পেলেও স্বামীর
বিরুদ্ধাচারণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, স্ত্রীর সে
সাহসও ছিল না। ছেলেরা যার যার কাজের জায়গায় ফিরে গেল। তারা মায়ের দুঃখে সমব্যথী
হলেও দূর থেকে সে সমবেদনা মনে প্রলেপ দিতে পারল না। বছর খানেকের মধ্যেই হার্টফেল
করে স্ত্রীর মৃত্যু হল।
মায়ের
মৃত্যুতে ভায়েরা বাবা জ্ঞানদারঞ্জনকে একরকম না জানিয়েই বোন-ভগ্নিপতিকে আমন্ত্রণ
জানাল। দুজনে এসে নীরবে সমস্ত
কাজ সমাধা করল। মেয়ে একটিবারের জন্য
মুখে কোন রা কাড়েনি। কিন্তু তাঁর স্বামীটিকে দেখে জ্ঞানদারঞ্জন অবাক হয়ে গেলেন।
প্রথমে আপত্তি, পরে কোনমতে বিয়ে হলেও পুরোহিতের দ্বারা কন্যা
সম্প্রদানের ফলে ছেলেটিকে যে যথেষ্ট অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছিল,
একথা তো অজানা নয়। বাবা হিসেবে তিনি মেয়ে-জামাইয়ের কোনদিন খবর
পর্য্যন্ত নেবার দরকার মনে করেননি। তারপরেও যে কোন মানুষ এভাবে শ্বশুরবাড়িতে
অবহেলা সয়ে
সকলের সামনে এসে হাসিমুখে দাঁড়াতে পারে, জ্ঞানদারঞ্জনের
ধারনা ছিল না। কি হাসিখুশি অমায়িক ব্যবহার ছেলেটির! কোথাও কোন অংশে মলিনতার ছাপ মাত্র নেই। জ্ঞানদারঞ্জন মনে মনে
সংকুচিত বোধ করছিলেন, কিন্তু নিজের মত থেকেও
সরে আসতে পারছিলেন না। অহংকার এবং সংষ্কার তাঁকে বেঁধে রেখেছে, তাঁর নিজের সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। তবুও মনে মনে জ্ঞানদারঞ্জন সংকুচিত হয়ে রইলেন। যাবার দিন
মেয়ে যে কোথায় রইল, তিনি তাকে দেখতে পেলেন
না। ছেলেটিই এগিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করতে গেল। সংকোচে, অস্বস্তিতে
সে প্রনাম তিনি নিতে পারলেন না। জামাই হেসে বললে---বাবা কি আমার অপরাধ এখনো ক্ষমা
করতে পারেন নি? আমাদের দুজনের হয়েই আমি ক্ষমা
চেয়ে নিছি। ছেলেমেয়েদের দোষ মা-বাবাই তো ক্ষমা করেন!’
জ্ঞানদারঞ্জন
কোন উত্তর দিতে পারলেন না। গাড়িতে ওঠার আগে তাঁর হাত ধরে ছেলেটি আবার
বলল---বাবা-মায়ের শেষ সময়ে সেবা করা ছেলেমেয়ের কর্তব্য। অসুস্থ বোধ করলে আমাদের সে
সুযোগ দেবেন, নইলে আসবেন আমাদের কাছে। ভাল
থাকবেন...। ‘
একে
একে সকলে ফিরে গেল। ছেলেমেয়েরা সব চলে
গেলে জ্ঞানদারঞ্জন বেরিয়ে পড়লেন। তিন বছর ধরে নানা জায়গা ঘুরে
একটি জায়গা তাঁর পছন্দ হল, সেখানেই স্থিতু হলেন। সকল
বন্ধন, সংষ্কার ছিন্ন করে গৃহী জ্ঞানদারঞ্জন প্রায়
সন্ন্যাসীর জীবন কাটাবেন স্থির করলেন।
(৩)
অদ্য
প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গের পর হইতেই কি এক অজ্ঞাত কারণে জ্ঞানেশ্বরের মন কিঞ্চিৎ
চঞ্চল হইতেছিল। জীবনের
প্রতি আশঙ্কা তাঁহার নাই। ঈশ্বরের চরণে তিনি নিজেকে সমর্পণ করিয়াছেন। সুতরাং,
তাহার ভাল মন্দের দায়ও তিনি ঈশ্বরেরই বলিয়া মনে করেন। তিনি
রাখিলে তাহা থাকিবে, নহিলে নয়। তাহার জন্য কোন ব্যাকুলতাও তাঁহার নাই। কিন্তু কাহাকেও যেন কিছু বলা হইল না,
কাহারও প্রতি যেন কোন কর্তব্য করা হইল না—এইরূপ মনে হইতেছিল। এই মনোভাবের জন্য জ্ঞানেশ্বরের যে নিত্যকর্মের
প্রতি কিছু ব্যাঘাত ঘটিল তাহা নহে,
শুধু কিশোরটিকে গৃহদেবতার মন্দির মার্জনা করিবার জন্য ইশারা
করিতে ভুলিয়া গেলেন। কিশোরটি বিস্মিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল---জ্যঠামশাই, আজ মন্দির পরিষ্কার করব না?’ বিস্মিত নয়নে
কিশোরের প্রতি চাহিয়া রহিলেন জ্ঞানেশ্বর। কোন কথাই মনে করিতে পারিতেছেন না। কি কথা
বলিবার ছিল? কিশোর আসিয়া তাঁহার সম্মুখে
দাঁড়াইল---জ্যাঠামশাই, শরীর কি খারাপ লাগছে?’
জ্ঞানেশ্বর
কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। সোপান হইতে অবতরণের চেষ্টা করিলে পর নিজেকে সামলাইতে
পারিলেন না, পড়িয়া গেলেন। কিশোরটি তৎক্ষণাৎ
তাঁহাকে ধরিয়া সেইখানেই শুয়াইয়া দিল।
ইহার
পর বেলা দ্বিপ্রহরে একবার মাত্র জ্ঞানেশরের জ্ঞান ফিরিল। কাহাকেও যেন
খুঁজিতেছিলেন। দেখিতে পাইলেন না। শুধু ক্ষীণ স্বরে বলিলেন---ছোটু,
মা...’। জ্ঞানেশ্বরের আর কোন কথা কেহ
শুনে নাই।
তিন
দিন পর এক যুবতী আসিয়া মন্দির প্রাঙ্গনে দাঁড়াইল। একেবারে যোগিনী মুর্তি,
যেন নিজেকে উৎসর্গ করিতে আসিয়াছে। ধীর পায়ে মন্দিরের সোপান
বাহিয়া গর্ভগৃহে প্রবেশ করিল। কোন দেবতার মূর্তি সেখানে নাই। শুধু একটি বেদীর উপরে
কিছু শুকনো বাসী ফুল ছিল। যুবতী সেই দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া মন্দিরের বেদীতে মাথা
রাখিল।
যুবতীটি
জ্ঞানেশ্বরের কন্যা।