গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০১৫

শৌনক দত্ত

আবার এলে যদি প্রাণে

ফেইসবুকে দেবানী নামে একজনের একটি ম্যাসেজ। 'বন্ধুত্ব করতে চাই।যদি অনুমতি থাকে রিকোয়েস্ট পাঠাবো।' ম্যাসেজটি পড়েই ছিলো।মাস চারেক পর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে রাতুলের মনে পড়লো।খুব খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিগুলো দেখলো। রাতুল এই সময়ের একজন লেখক পরিচিতি তার খুব একটা মন্দ নয়।প্রায় প্রতিমাসেই তার লেখা আসে দু চারটে কোন না কোন পত্রিকায়।একটা ছবিতে এসে রাতুলের চোখ আটকে যায়।এ ছবি বড় চেনা লাগে তার অথচ বাকী ছবিগুলোয় দেবানী নামের ভদ্রমহিলা বেশ স্বাস্থবতী এই একটি ছবিতেই তিনি ছিপছিপে।বোঝা যায় ছবিটা বেশ অনেক বছর আগের।অনেকবার কতটা সময় তা জানেনা রাতুল।তবে কি যেন খুঁজে বেড়ায় তার চোখ ছবিটাতে। রাতুল ঘোর কাটিয়ে মেসেজ করে'আপনি কে আমার বন্ধুত্ব চাইছেন কেন জানতে পারি কি?' সময় অনুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধূলো ওড়ে না।পলকেই উত্তর আসে'কেমন আছো তুষ্য?এখন তো তোমার অনেক নামডাক।'রাতুলের বিস্ময় বাড়ে তার এই ডাকনাম দেবানী নামের অপরিচিত কি করে জানে?পরিচিত কেউ তো মনে হচ্ছে না ছবি দেখে কেবল ঐ একটি ছবি পরিচিত পরিচিত লাগছিলো তাকে মনে করতে চেষ্টা করে ছবিটা চোখের সামনে রেখে। 'আপনি ঠিক কে বলুন তো?' 'তোমার মা,বাবা ভাল আছেন তো?দিদিভাইয়ের ছেলেমেয়ে কিছু হলো?' বিস্ময়ের বুদবুদ বুকের ভেতর আরো বাড়ে।রাতুল দেবানী সব ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।স্বামী,কন্যা সহ ছবিতেই ভরা। 'ছবি দেখছো নিশ্চয় আর ভাবছো এড করবে কিনা কি তাই না?' মেসেজ পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো রাতুল।কলিংবেল বেজে উঠলো।

ময়ূখ রাতুলের ছোট্টবেলার বন্ধু যাকে সোজাকথায় বলা যায় হাফ প্যান্টের বন্ধু।ময়ূখকে কথাটা বলবে কিনা ভাবতে ভাবতে রাতুল কথাটা বলেই ফেললো ময়ূখকে।কফি বানাতে বানাতে কথাগুলো বলছিলো রাতুল।ততক্ষনে ময়ূখ মেসেজ আর প্রোফাইল দেখে বললো শালা আমার ধারনা দেবানী মেয়েটা কংকনা!কফি মগ টেবিলে রাখতে রাখতে রাতুল বিস্ময় কন্ঠে বললো কংকনা!কি বলিস।কিভাবে বুঝলি?তাছাড়া কংকনার সাথে যোগাযোগ নেই প্রায় ষোল বছর। পুরনো ছবিটা দেখ।কংকনার আদলে মুখটা। কি যে বলিস।এতেই তুই নিশ্চিত। বাজি রাখ এটা কংকনা। ষোল বছর পর কংকনা রিকোয়েস্ট পাঠাবে কেন?তাছাড়া.. আরো বেশ কথা বার্তার পর ময়ূখ ফিরে গেলো ক্লিনিকে।

কংকনা।নামটা শোনার পর থেকেই বুকের ভেতর এক বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে রাতুলের বুকের কাঁচ।পুরানো ডাইরী তছনছ করে কোথাও কিছুই মিললো না।চিঠির ড্রয়ারে চিঠি পেলো কিছু তা পড়তে পড়তে মনে পড়লো কংকনার একটা ছবি তার কাছে ছিলো।

 
সারা ঘর তছনছ করে পুরনো মানিব্যাগে মিললো কংকনার একটা ছবি।আনমনেই হেসে উঠলো রাতুল দেবানী কংকনা ই ময়ূখ ঠিকই বলেছে। পূর্নিমার জোছনা ছাপিয়ে একরাশ স্মৃতি এসে ভরে তুললো লেখক রাতুলের ঘরে,বুকে। কংকনা ছিলো রাতুলের পিসতাতো বোনের বান্ধবী।সেটা আটানব্বইয়ের মাঝামাঝি।একই ট্রেনে ফিরছিলো রাতুল আর কংকনা মধুর বাড়ীতে ঘুরতে যাচ্ছে।পাশাপাশি সিট পড়েছিলো ওদের।রাতুল আনমনেই হেসে ওঠে।রাতুলের সিট ছিলো জানালার পাশে আর কংকনার সাইডে।যে কোন যানে জানালা রাতুলের বড্ড প্রিয়।কানে হেডফোনগুঁজে চোখের সামনে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বই।কংকনা কখন থেকে যে জানালায় বসবে বলে ডেকে যাচ্ছিলো রাতুল খেয়াল করেনি।যখন খেয়াল হলো তখন তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়া মধুদের বাড়ীতে ঘুরতে গিয়েও চলেছিলো।কংকনার ধারনা ছিলো তাকে ফলো করতে করতে রাতুল মধুদের বাড়ী চলে এসেছিলো।ঝগড়ার ফাঁকে গরম চা ঢেলে দিয়েছিলো কংকনা তারপরদিন গরম চায়ের জন্য নাকি অন্যকোন কারণে জ্বর এসেছিলো জানা যায়নি তবে রাতুলের সেই রাত থেকেই খুব জ্বর এসেছিলো।কংকনা কেন যে পরেরদিন পাগলের মত সাদা সালোয়ারে ছুটে এসেছিলো তা কেউ জানেনা ওরা।রাতুল ল্যাপিতে দেবানী দেখে আর মানিব্যাগে কংকনাকে।রাত বেড়ে যায় রাতুলের মনে হয় কিছু প্রেম পাহাড়ের মত ডিঙ্গানো যায় না।কিছু দাগ ইরেজারেও মুছে না। কনফার্মে ক্লিক করতে গিয়েও রাতুল থেমে গেলো।ভোরের আলো তখন ফুটছে একটু একটু। রাতুল মেসেজ বক্সে লিখলছে মুছছে।কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা সে ষোলবছর পর প্রিয় মুখ প্রথম প্রেম ফিরেছে। কনফার্ম থেকে সরিয়ে মেসেজে লিখতে থাকে তার এক প্রিয় কবির কবিতার পংক্তিগুলো ......


বৈদেহী বিচিত্র আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়
প্রচারিল আচম্বিতে অধরার অহেতু আকূতি :
অস্তগামী সবিতার মেঘমুক্ত মাঙ্গলিক দ্যুতি
অনিত্যের দায়ভাগ রেখে গেল রজনীগন্ধায়।।

ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্তলোহিত,
তরুণতরুণীশূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ,নিশাক্রান্ত বিষন্ন বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত ।।

নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত,
রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা ;
আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিনাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ।।

সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকন্ঠ বিতর্ক, বিচার,
প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে  পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর :
জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর ;
তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার ।।

যারা ছিল একদিন ; কথা দিয়ে, লে গেছে যারা ;
যাদের আগমবার্তা মিছে বলে বুঝেছি নিশ্চয় ;
স্বয়ম্ভূ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ।।

ফুটিবে গীতায় মোর দুঃস্থ হাসি, সুখের ক্রন্দন,
দৈনিক দীনতা-দুষ্ট বাঁচিবার উল্লাস কেবল,
নিমেষের আত্মবোধ, নিমেষের অধৈর্য অবল,
অখণ্ড নির্বাণ-ভরা রমণীর তড়িৎ চুম্বন ।।

মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে,
স্থান পাবে, হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার :
বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার ;

আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে ।।