গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মার্চ, ২০১৫

কৃষ্ণা দাস


মায়ের দয়া

 বসন্ত এসে গেছে । সবার আগে জানায় কোকিলরা ।আচ্ছা ওরা যে সারাদিন এত কু কু করে ওদের গলা ব্যাথা করেনা? বেড়ার বাবলা গাছে কি সুন্দর লাল টকটকে ফুল ধরেছে ।

    আজকাল ভুন্ডুল বড় একটা বাইরে বের হয়না । ওর প্রিয় বাঘাকে কখনো চান করাচ্ছে কখনো বল ছুড়ে ট্রেনিং দিচ্ছে তো কখনো মাউথ অরগ্যান বাজাচ্ছে ।মাও খুশি ও আর আদারে বাদারে ঘোরেনা বলে । বুম্বা সানু বিল্টু পটলারা ডাকতে আসে খেলার জন্য কিন্তু ও যাচ্ছি তোরা যাকরে আর যাওয়া হয়না । ওরা রাগ করে বলে আসতে হবেনা যা ,বাঘাকে নিয়ে থাক
  আজ তিন দিন হল মার অসুখ, পক্স হয়েছে । পাঁচিপিসি বলে মায়ের দয়া হয়েচে”, শুনে ভুন্ডুল বলেছিল তোমাদের মা দয়া করলে যদি এমন হয় তবে আমাদের দয়া চাইনা

   শুনে পাঁচিপিসি মাগো ক্ষেমা দে,ছেলেমানুষ কি বলতে কি বলেচে,দোষ নিসনে মাবলে বার বার কানে কপালে হাত ঠেকাতে থাকে । ভুন্ডুলের দেখে হাসি পায় কিন্তু হাসেনা, সে পাঁচিপিসিকে ভালোবাসে, দুখঃ দিতে চায়না ।

   পাঁচিপিসি একা হাতে মাকে সেবা করে, রান্না করে, বাড়ির অন্যকাজ, ভুন্ডুল দাদুকে খেতে দেওয়া সব করে । সব শেষে নিজে ভাত নিয়ে বসে সঙ্গে চার পাঁচটা বড় বড় কাঁচা লঙ্কা, কি করে খায় এত ঝাল কে জানে ।

 দাদুর কাছে শুনেছে পাঁচিপিসির খুব ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল । তার বরকে নাকি সাপে কাটে । বর মরে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকে তাকে তাড়িয়ে দেয় । তখন পাঁচিপিসি মাত্র এগারো বছর বয়েস । বাপের বাড়ি যতদিন মা বাপ ছিলো ভাত কাপড়ের অভাব হয়নি, মা-বাপ মরতেই ভাইরা সব আলাদা হল, কেউ আর পাঁচিপিসিকে ভাত কাপড় দিতনা । তখন ঠাম্মা তাকে ডেকে ডেকে পিঁড়ে পেতে ভাত বেড়ে দিত, দোল দুর্গোৎসবে নতুন কাপড় দিত । সেই থেকে এবাড়িতে তার ভাত কাপড় বাঁধা । মা শুধু কিছুটাকা তার হাতে গুঁজে দেয় ,একটা মানুষের খাওয়া পরা ছাড়াও যে অনেক কিছু লাগে । পাঁচিপিসি নিজের মনে করে সব কাজ করে ,তবুও আজকাল খালি বলে টাকা বাড়াও বাপু, নইলে অন্যবাড়ি ধরবো
মা হাসে, বলে যাওনা তোমায় কি বেঁধে রেখেছি” ?
অমনি জোঁকের মুখে নুন পড়ে, মুখে আর কথাটি সরেনা ।

   এই ক দিন ভুন্ডুল দাদুর কাছে শোয় ।মার রোগটা ছোঁয়াচে বলে মার ঘরে ঢুকতে দেয়না ।দাদু অনেক রাত অবধি খক খক করে কাশে ,ভুন্ডুলের ঘুম আসেনা । সে অনেক রাতে দাদু ঘুমালে চুপি চুপি মাকে দেখতে আসে রোজ । ভেজানো দরজা আস্তে আস্তে খুলে ঘরে ঢোকে ।মেঝেয় পাঁচিপিসি মাদুর পেতে শোয় ।মা মশারির ভেতরে ,অন্ধকারে ভালো দেখা যায়না,সে মাকে না ছুঁয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
আজ আর পারলনা।মা কে কতদিন ভালো করে দেখেনি ,কত দিন জড়িয়ে ধরেনি ।মনটা সায় দিচ্ছেনা, সে মশারি তুলে মার কপালে হাত ঠেকাল  মার কপালে হাত ঠেকিয়ে চমকে উঠলো, গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ।সারা মুখে ছোট ছোট জল ভরা ফুসকুড়ি হয়েছে । দাদু কবিরাজী অশুধ এনেছে, তা কি কোন কাজ দিচ্ছেনা ?

সে পাঁচিপিসিকে আস্তে আস্তে ডাকল, “ও পিসি, পিসি ও পিসি”?
পাঁচিপিসি ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল কি লা? ডাকিস কেনে” ? তার পরই ভুন্ডুলকে এ ঘরে বুঝে চিৎকার করে উঠল হায় হায় তুই হেথায় কেন লা ? এত্ত করে নিষেধ করা আসিসনিকো হেথায়, তা সেই শুনলেনা গা”?
পিসি দেখনা মার গায়ে জ্বর
তা মায়ের দয়া হলে হবে অমন একটু, তুই বাইরে যা বাবা, গায়ে হাত দিসনি তো”?
তুমিও তো রয়েছ, তোমায় বুঝি মা দয়া করবেনা”?
দেখো ছেলের কতা, এ রোগ একবার হলে আর কি তেমন কব্জা করতে পারে? আমার তো হয়েচে ছোটবেলা, তোর যে হয়নি বাপ
হলে হোক আমি যাবনা । জীবনে একবারই তো হবে
ওকি কতা বাপ ? অমন বলতে আচে”?
চিৎকার চেঁচামেচিতে মা জেগে গেছে, জড়ানো গলায় বলে ভুন্ডুল বাইরে যা, আমি দু দিনেই ভালো হয়ে যাব, তখন আসিস
ভুন্ডুল কাঁদতে কাঁদতে বলল না আমি যাবনা, তোমার কাছে থাকব
বোকা ছেলে, কাঁদছিস কেন? আয় আমার কাছে, মশারি তুলিসনা ভুন্ডুল মশারির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ।
মা বলে কাল আমাকে একটা পিয়ারা এনে দিস তো ,মুখে স্বাদ নেই, কিছু খেতে ইচ্ছা করছেনা, শুধু পিয়ারা খেতে ইচ্ছা করছে
আচ্ছা আনবো
এখন যা আমার ঘুম পাচ্ছে
ভুন্ডুল বাধ্য ছেলের মত আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল ।
পাঁচিপিসি গালে হাত ঠেকিয়ে বললে ধন্যি তোমার টেনিনবউদি । এত্ত করে বোজালেম বুজলে না গা, আর তুমি বাপু কি একটু বললে অমনি ঘাড় হেঁট করে চলে গেল গা”!
  

 সকাল হতেই ভুন্ডুল ছুটেছে পেয়ারার সন্ধানে । এখন পেয়ারার সময় নয় ও জানে । ওদের বাড়ির পেছনের গাছে সবে ফুলের কুঁডি ধরেছে ।তবে  পেসাদের জমির মাঠে একটা গাছ আছে বারো মাস ফল ধরে, কিন্তু বড্ড জংগল আর বিছুটির ঝোপ বলে ওদিকে বড় একটা কেউ যায়না ।তার ওপর ওখানে বড়বড় গোঁয়ারগেল আছে । ভুন্ডুল একবার একটা দেখেছিল, চার হাত লম্বা একটা গিরগিটির মত । খালি চেরা জিভ লকলক করে বার করে আর ঢোকায় ।দেখে খুব ভয় লেগেছিল । আজ তবু গেল পেয়ারা পাড়তে । পায়ে বিছুটি যাতে না লাগে তাই ফুল প্যান্ট  পরে এসেছে । জঙ্গলে নির্বিঘ্নে ঢুকে পেয়ারা গাছে চড়ল । দেখে-দেখে ভালো ভালো দেখে দুটো ডাসা পেয়ারা পকেটে ঢুকিয়ে নিচে  নামতে যাবে দেখে দুটো বিশাল যমদূত পেয়ারা তলায় ঘুরছে । কি ভয় লাগছে, কেউ কোথাও নেই । ভুন্ডুল দম বন্ধ করে গাছে বসে থাকল যেন ওরা টের না পায় ভুন্ডুল গাছে । যদিও ও জানে ওরা গাছে উঠতে পারেনা ,তবুও ।
কতক্ষণ এভাবে চুপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বসেছিল জানেনা, হটাৎ দেখে বাঘা বন বাদাড় টপকে ভৌ ভৌ করতে করতে ছুটে আসছে । মুহুর্তে যমদুটো কোথায় ভ্যানিস হয়ে গেল ।বাঘাকে দেখে খুব খুশি হয়ে ভুন্ডুল তর তর করে গাছ থেকে নেমে এল ।দৌড়ে তারা জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে উঠে এল মাঠে । মাঠে এসে দেখে বুম্বা, ভুলো, সানু, বিল্টু, পটলারা ব্যাটবল খেলছে ।মনটা আজ খুব ভালো, ও বলল আমি খেলবো
   পটলা খেলা না থামিয়ে বলে এখন হবেনা, খেললে শুরুতে আসতে হবে
সানু বলল নিয়ে নে না, কি হয়েছে” ?
পটলা বিল্টু একসাথে বলল কেন বাঘাকে নিয়ে খেলা ফুরিয়ে গেল”?
ভুন্ডুল দেখল বাঘাশব্দটা শুনে বাঘা খুব খুশি হয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়ছে । বেচারা বুঝতেই পারলনা ওরা ওকে পছন্দ করেনা ।
ভুন্ডুল বলল তোদের নিতে হবেনা যা,আমার বলটা দিয়ে দে
হটাৎ সবাই মুখ চাওয়া-চায়ি করল । আসলে বলটা ভুন্ডুলেরই । ওটা যখন যার কাছে থাকে সে মাঠে আনে ।
পটলা হটাৎ বলল তোর বল প্রমাণ কি ? ওতে কি তোর নাম লেখা আছে”?
শানু ফ্যালফ্যাল করে পটলার মুখে তাকিয়ে থাকে জলজ্যান্ত মিথ্যে শুনে ।
বুম্বা বিল্টু ভুলো পটলাকে সমর্থন করে মাথা ঝাঁকায় ।
ভুন্ডুল চুপচাপ একটা উইকেট তুলে নিয়ে ছুড়ে মারল পাশের পুকুরের জলে । সবাই হাঁই হাঁই করে উঠল ।
পটলা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল তুই উইকেট জলে ফেললি কেন”?
ভুন্ডুল নির্বিকার ভাবে বলল প্রমাণ কর আমি ফেলেছি
সবাই চুপ হয়ে গেল ।
 আমার সাথে পাঙ্গা নিতে আসিসনা, বুঝলি ? ফল ভালো হবে না”,ভুন্ডুল ওদের মুখ দেখে হেসে ফেলে বলল ।
এখন কি হবে?” সানু বলল ।
খেলা হবে না, ভুন্ডুল হাসল ।
এবার সবাই পটলাকে চেপে ধরেছে ,“তোর জন্য হল
পটলা এবার গর্জণ করে উঠল আমার জন্য ?আমার জন্য ? সানু ছাড়া তোরা আমায় সাপোটকরিসনি ?
ভুন্ডুল বাঘাকে গলা চুলকে বলল ক্ষমা চা উইকেট পেয়ে যাবি
পটলা কাঁদো কাঁদো মুখে বলল উইকেটটা আমার ছোটদার, হারালে আমার ভুত ছাড়িয়ে দেবে
ভুন্ডুল নির্বিকার মুখে বাঘার গলা চুলকে চলেছে ।বলল ক্ষমা চা
সবাই এক সাথে বলল ক্ষমা চা না, কি হয়েছে ?
পটলা বলল নে চাইলাম
ওভাবে নয়”, ভুন্ডুল কপট গম্ভীর হয়ে বলল ।
কি ভাবে”?পটলা বোকা বোকা ভাবে জিগ্যেস করল ।
মাটিতে উপুর হয়ে শুয়ে হাত জোড় করে বল আমায় ক্ষমা কর
সবাই অধির হয়ে দেখছে ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় ।
পটলা বন্ধুদের দিকে তাকাল, তারা নির্বিকার, কাকে যে সমর্থন করছে বোঝা যাচ্ছে না ।পটলা ঢিপ করে মাঠে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে বলল ক্ষমা করে দেবলেই তড়াক করে লাফিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল । ব্যাপারটা শুরু থেকে শেষ হতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগল ।
ভুন্ডুল ওর কান্ড দেখে হেসে ফেলল । পিঠ থেকে শুকনো ঘাস ঝেড়ে দিয়ে বলল
সবাই মিলে পুকুর পাড়ে এল । উইকেটটা ভেসে আছে প্রায় মাঝ পুকুরে । এই পুকুরে কেউ নামেনা । জলটা কেমন কালো কালো । গুচ্ছের পানা আর ঝাঁঝি ভরা চার পাশ । কেবল মাঝখানটা পরিষ্কার ।
একটা ঢিল তুলে ছুড়ে মারতেই উইকেটেটা খট করে শব্দ করে নড়ে উঠল ।বাঘা গো ,ক্যাচ” ,বলতেই বাঘা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল । মাত্র দু মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই বাঘা উইকেট মুখে করে ফিরে এল । পাড়ে মুখ থেকে উইকেট ফেলে গা ঝাড়া দিয়ে সবাইকে ভিজিয়ে দিল । ভুন্ডুল গলা চুলকে বলল সাবাশ বাঘা

বাঘা আরো জোরে ল্যাজ নাড়িয়ে ভৌ ভৌ করে করে উঠল ।
বাঘার ট্রেনিং নিয়ে আর কারো কোন সন্দেহ থাকলনা । সবাই খুব বিস্ময় ও প্রশংসার চোখে ট্রেনার ও ট্রেনিকে দেখতে থাকল ।
ঠিক তখনই পাঁচিপিসি চিৎকার করে উঠল ওই দেকো, ওই পানা পুকুর পাড়ে কি হচ্চেটা কি ভাইপো ? দাঁড়াও তোমার মায়েরে গিয়া সুধাই
এই যে যাই পিসি, মাকে বলনাবলেই দে ছুট বাড়ির দিকে ।পিছনে পড়ে থাকল ব্যাট বল আর বন্ধুরা ।
বাড়ি এসে পকেট থেকে পেয়ারা দুটো বার করে বলল পিসি এ দুটো ছোট ছোট করে কেটে মাকে দাও তো
পাঁচিপিসি হাত পেতে নিয়েই চিৎকার জুড়ল অই দেকো ,পইপই করে বললাম ঘরে ঢুকিসনিকো, ঘরে ঢুকিসনিকো, কানে নিলে না গা, দেখো দেকি সেই ধররেই ছাড়লে গা । এ ছেলেরে নিয়ে কি করি”?
ভুন্ডুল বলল কই কি ধরিয়েছি”?
আর কি ধরাবে বাপ ? এই তো গলায় কানে থুতনিতে সব দেকা দিইচে ।  আমার কপাল !   সবে তাকে নিম হলুদ দেব ভাবচি, তার মধ্যে আবার এনার
ভুন্ডুল জিগ্যেস করল কি মায়ের দয়া”?
পাঁচিপিসি বলল তা আর বলচি কি”?
মায়ের দয়া, মায়ের দয়া,কি মজা! এত দিনে তোমাদের মা আমায় দয়া করল,              

আমি এবার আমার মায়ের কাছে চললাম ।বলেই ভুন্ডুল লাফাতে লাফাতে মার বিছানার দিকে ছুটে গেল । পাঁচিপিসি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে সে দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ।