গদাধর
প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর পর, সেদিন রাস্তায় গদাকে দেখলাম। পরণে বোতাম ছেঁড়া নোংরা জামা, প্যান্ট ও ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চপ্পল। ঠোঁটের কষ্ দুটো সাদা, পাগলাটে দৃষ্টি। ও কিন্তু আমার দিকে তাকিয়েও চিনতে পারলো না। আমিই ডেকে ওর সাথে কথা বললাম।
“কী রে কেমন আছিস”?
“ও ছুবীর? ভাল নেই রে”।
“কেন? কী হয়েছে”?
“হাতে একটাও পয়ছা নেই। ছরীরও ভাল নয়, ছুগারে ভুগছি। তুই ভাল আছিছ”?
“হ্যাঁ ভাল”।
“ঠিক আছে, যাই কেমন”?
ও এগিয়ে গেল। ওকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ কাকে দেখলাম? এ তো সেই গদা নয়, যাকে আমি চিনতাম।
গদা আমার ছেলেবেলার স্কুল পালানো বন্ধু। আমি
যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, ও তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। যদিও দু’জনের বয়স প্রায় একই। ভাল নাম গদাধর,
বাচ্ছাদের মতো ত-ত করে কথা বলে। মোটাসোটা চেহারা,
অনেকটা নারায়ণ দেবনাথের
“হাঁদা ভোঁদা” কমিকস্ এর ভোঁদা।
শুনেছিলাম
গদা মিলিটারিতে ড্রাইভারের চাকরী পেয়েছে। ওর পক্ষে ভালই চাকরী। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, দেখেছিলাম ওর কথা বলার ভঙ্গী এক থাকলেও, চালচলনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক স্মার্টও
হয়েছে। এরও অনেক পরে, অন্যের
মুখে শুনেছিলাম গাড়ির তেল চুরি করে বিক্রী করে,
অনেক পয়সাও জমিয়েছে। রিটায়ার করেছে না চাকরী গেছে জানিনা, তবে গদাকে আর দেখি নি। যদিও আমার বাড়ি
থেকে ওর বাড়ির দুরত্ত্ব খুব বেশী নয়। ওকে নিয়ে কত স্মৃতি। ওরা বোধহয় তিন ভাই ছিল। ও
আর ওর পরের ভাই, একই
শ্রেণীতে পড়তো। ওর পরের ভাই খুব ভাল ফুটবল খেলতো। সেও আমাদের স্কুল পালানো দলের সদস্য
ছিল। একবার, তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র, স্কুলে না গিয়ে গদা ও আরও কয়েকজনের সাথে
স্কুলের কাছাকাছি একটা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে,
একটা তাঁবুর ভিতর বসে আছি। রেল লাইন মেরামতের কাজ হচ্ছে।
পাশাপাশি চার-পাঁচটা
তাঁবু, কুলিরা
তাতে থাকে। তারই একটায় বসে আমরা গুলতানি করছি। দু’জন লেবার ক্লাশের লোক তাঁবুর ভিতর রান্না করছে। বাকীরা শাবল, বেলচা,
হাতুড়ি ইত্যাদি নিয়ে রেল লাইনের পাথর সরাচ্ছে, লাইন মেরামত করছে। তাঁবুর লোকদু’টো চা করে আমাদের খাওয়ালো। গদা পুলকিত
হয়ে বেশ কয়েকটা সিগারেট কিনে এনে, নিজেও নিল, আমাদেরও সকলকে দিল। আমরা মনের সুখে সিগারেট টেনে, আড্ডা মেরে,
বিকেল বেলা যে যার বাড়ি ভাল ছেলের মতো ফিরে এলাম।
পরদিন
স্কুলে আমার ক্লাশরুমে বসে আছি। দ্বিতীয় পীরিয়ড্ শুরু হয়েছে। এমন সময় স্কুলের পিওন, গোপালদা ক্লাশে ঢুকে মধুবাবুকে আস্তে
আস্তে কী বললো। তারপর মধুবাবুর নির্দেশে গোপালদা বাইরে গিয়ে গদাকে নিয়ে ক্লাশরুমে ফিরে
এল। গদাকে দেখে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। গদার মাথায় খবরের কাগজের তৈরী একটা এক হাত
লম্বা টুপি, হাতে
একটা সাদা কাগজ। গদা ক্লাশে ঢুকে হাতের কাগজটা পড়তে শুরু করলো। “আমি গদাধর চৌধুরী, অষ্তম ছ্রেণীতে পড়ি, গতকাল ইছকুল্ পালিয়ে স্তেছনের পাছে,
তাঁবুতে বছে ছিগারেট
খেয়েছি। আমি এই কাজ ভবিছ্যতে আর কোনদিন করবো
না। এরপর যদি কোনদিন এই কাজ করি………”।
আমার
কানে তখন আর গদার কথাগুলো প্রবেশ করছে না। এখন এটা পরিস্কার, আমাদের স্কুল পালানোর কোন সাক্ষী রয়ে
গেছে। তার মানে সে আমাকেও দেখেছে। সে নিজে বা স্বয়ং গদা যদি আমার নাম হেডমাষ্টারমশাইকে
বলে দেয়, তাহলে
তো সাড়ে সর্বনাশ, আমারও
তো একই দশা হবে। নাঃ, আর
ভাবতে পারছি না।
গদার
পাঠ শেষ হলে, সে
গোপালদার সাথে পাশের ক্লাশে চলে গেল, খবরের কাগজের লম্বা টুপি পরে,
হাতের কাগজ পাঠ করতে। গোটা ক্লাশে হৈচৈ শুরু হ’ল। মধুবাবু ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করালেন।
না, আমার নাম না সেই অদৃশ্য সাক্ষী, না গদা,
কেউই প্রকাশ করে নি। যদিও গদা কারো নাম বলে দেবে, এটা ভাবাই যায় না। কারণ গতকালই তো আমরা
প্রথম স্কুল পালিয়েছি, তা
নয়। মাঝে মাঝেই আমরা স্কুল পালিয়ে কখনও ব্যান্ডেল,
কখনও কোলাঘাট,
আবার কখনও বা ভিক্টোরিয়া,
বোটানিকাল গার্ডেন বা জাদুঘর ঘুরে বেড়াতাম, রঙ্গিন মাছ কিনতে যেতাম।
একবার
একটা খুব বড় ঝিলের ধারে, আমরা স্কুল পালিয়ে গিয়ে হাজির হলাম। বিরাট অঞ্চল জুড়ে মাটি কেটে, ঐ বিশাল ঝিলের মতো পুকুর তৈরী হয়েছিল।
শুনতাম, ওখানে
গভর্নমেন্টের কী একটা প্রজেক্ট্ তৈরীর কাজ হচ্ছে। কাটা মাটি সেখান থেকে ট্রাকে করে
অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এই মাটি নিয়ে যাওয়া একটা ফাঁকা ট্রাকে করে, সারা শরীরে ধুলো মেখে, পুকুর পাড়ে এসে বই খাতা রেখে বসে আছি।
একটু পরে দু’টো
বাচ্ছা ছেলে দু’টো
মোষের পিঠে চেপে, অনেকগুলো
মোষ নিয়ে পুকুরের কাছে এল। বাচ্ছাদু’টো মোষের পিঠে চেপেই সোজা পুকুরে নেমে গেল। পিছন পিছন আর সব মোষও পুকুরে
নামলো। বাচ্ছাদু’টোকে
অনেক বুঝিয়ে, আমরাও
এক একজন এক একটা মোষের পিঠে চেপে বসলাম। বই,
খাতা, চটি, পুকুর
পাড়ে পড়ে রইলো। মোষগুলো হেঁটে না সাঁতার কেটে,
এতদিন পরে আর মনে করতে পারছি না, পুকুরের একদিক থেকে অপরদিকে, পাড়ের কিছুটা দুর দিয়ে যেতে শুরু করলো।
আমাদের প্যান্ট পুরো জলের তলায়। মোষগুলো তাদের শরীরটাকে মাঝে মাঝে বসে পড়ার মতো করায়, জামাও ভিজে যাচ্ছে। বেশ চলছিল, হঠাৎ গদার মোষটা কী রকম ভাবে কাত হয়ে, গদাকে পিঠ থেকে জলে ফেলে দিল। বোধহয় গদার
ঐ বিশাল দেহ, মোষটার
পছন্দ হয় নি। গদা জলে ভিজে, কাদা মেখে, পাড়ে উঠে এল। আমরাও পাড়ে উঠে এসে,
গাছের আড়ালে বার্থ ড্রেসে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, জামা প্যান্ট শুকিয়ে বিকালে বাড়ি ফিরে
এলাম।
আর
একদিন স্কুল পালিয়ে ভরদুপুরে একটা জায়গায় গেছি। তখন এখনকার মতো খোলা মাঠের অভাব ছিল
না। দুপুরের রোদে সমস্ত বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। একটা জায়গায় কয়েকটা মুরগী চড়ে বেড়াচ্ছে।
আমরা কিছু বোঝার আগেই, গদা
একটা মুরগী ধরে ফেললো, আর
সঙ্গে সঙ্গে চোর-চোর, ধর-ধর বলে চিৎকার শুরু হয়ে গেল। কোথাও কোন লোকজন না দেখে গদা মনের আনন্দে
মুরগীটা ধরেছে, কিন্তু
এখন দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে বেশী অধিবাসী এই অঞ্চলে বসবাস করে। পাঁচ-সাতজন যুবক চোর-চোর বলে চিৎকার করতে করতে, গদাকে তাড়া করলো। গদাও মুরগী বগলদাবা
করে, রেডি-স্টেডি-গো শোনার অপেক্ষা না করে, ছুটতে শুরু করলো। ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হওয়ার সময় যেমন জলযানে সাঁতারুর
পাশে পাশে, একটু
দুরত্ব বজায় রেখে কিছু লোক যায়, আমরাও তেমনি গদার পাশে পাশে,
একটু দুরত্ব বজায় রেখে ছুটছি। সামনে একটা মাঠ। চওড়া খুব
একটা বেশী না হলেও, যথেষ্ট
লম্বা। গদা মাঠের ওপর দিয়ে ছুটে মুরগী নিয়ে বেশ যাচ্ছিল,
হঠাৎ দেখলাম সে হুড়মুড় করে এক কোমর জলে নেমে পড়লো। ওর দোষ
নেই, আসলে মাঠের শেষ প্রান্তটা
ছিল একটা ডোবা মতো। ছোট্টছোট্ট একরকম পানায় ঢাকা। সবুজ মাঠ আর সবুজ পুকুর একসাথে পাশাপাশি
থাকায়, ওটার
অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় নি। ডোবাটাতে জলের থেকে পাঁকই বেশী। গদা এক কোমর পাঁকে নেমে
গিয়ে আটকা পড়লো। ঐ অবস্থাতেও সে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল,
কিন্তু ডোবার চারপাশে মুরগী রক্ষকরা ঘিরে ফেলায়, গদার আর পালানো হ’ল না। এতক্ষণে সে তার হাত থেকে মুরগীটা
ছেড়ে দিল। মুরগীটা মুক্ত হয়ে মনের আনন্দে খানিক উড়ে,
পুকুরের পানা ঢাকা জলে পড়ে গেল। বোধহয় সেও গদার মতোই এটাকে
মাঠ ভেবেছিল। শেষে গদার চেষ্টাতেই মুরগী রক্ষা পেল। দস্যু রত্নাকর যেমন বাল্মীকি মুনিতে
পরিণত হয়েছিলেন, গদাও
সেরকম ভক্ষক থেকে রক্ষকে পরিণত হওয়ায়, এবং আমরা অনেক বুঝিয়ে, গদার হয়ে ক্ষমাটমা চাওয়ায়,
মারমুখী ছেলেদের হাত থেকে রক্ষা পেলাম। পরে গদাকে জিজ্ঞাসা
করলাম, “মুরগীটা
আগেই ছেড়ে দিলি না কেন”?
গোটা দেহে পাঁক মাখা গদার চটজলদি উত্তর— “মুরগী ছাড়লেও মার খেতাম, না ছাড়লেও মার খেতাম। তার থেকে মুরগী
নিয়ে পালাতে পারলে, রাতে
কী রকম ফিস্ত্ হ’ত
বলতো”?
এ হেন গদাকে নিয়ে আমাদের কম বিপদে পড়তে হয়
নি। প্রতিবার-ই
অবশ্য বিপদ কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। তবে গদাকে নিয়ে সেবার আমায় যে বিপদে পড়তে হয়েছিল, সে ঘটনাটা না বললে গদাকে চেনা যাবে না।
তখন আমি একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল শেষ হলে, প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে, জলখাবার খেয়ে, কিছুক্ষণ পরেই আবার স্কুলের কাছাকাছি
প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যাব। রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই আমাদের বাড়ি। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে
গদার সাথে দেখা।
“কী রে, ইছকুল থেকে ফিরছিছ”?
“হ্যাঁ রে। একটু পরেই আবার ওখানেই পড়তে যেতে হবে”।
“কোথায়”?
“হীরেণ স্যারের বাড়ি”।
“তাহলে তো ভালই হ’ল। এক কাজ কর না, বাড়ি যেতে হবে না। এক্ষুণি আপে গাড়ি আছবে, চল্ নলপুর পর্যন্ত যাই। ওখান থেকে ডাউনে ফেরার গাড়ি পেয়ে যাবি”।
“না রে, দেরি হয়ে যাবে”।
“কিছু হবে না। চল্ চল্ অনেকদিন তো কোথাও যাওয়া হয় নি”।
তখনও ই.এম.ইউ. ভালভাবে চালু হয় নি। বেশকিছু পাদানি যুক্ত আগের কাঠের গাড়িও যাতায়াত করতো। দেখতে দেখতে গদার কথা মতো গাড়ি এসে গেল। নিজের ইচ্ছা না থাকলেও, গদার ইচ্ছা মতো গাড়িতে চড়লাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনের সুখে গল্প করতে করতে নলপুর এসে, প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিক দিয়ে নেমে, পাশের ডাউন প্ল্যাটফর্মে উঠে, একটা বেঞ্চে পাশপাশি বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরার ট্রেন আসার কথা। দু’জনে মনের সুখে গল্পে মশগুল। হঠাৎ একটা লোক এসে সামনে দাঁড়ালো।
“টিকিট”?
“আমরা তো ত্রেনে করে আছি নি”— গদা উত্তর দিল।
“সে তো দেখতেই পেলাম। কথা না বাড়িয়ে টিকিট দেখান”।
“তিকিত কোথায় পাব? ত্রেনে করে আছলে তো তিকিত কাতবো”।
আমি ওর পায়ে একটা চাপ দিয়ে, খুব আস্তে বললাম — “গদা, কেটে পড়”।
আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে, সে পুনরায় বললো — ”আমরা গাড়িতে আছিনি, আপনি ভুল করছেন”।
ভদ্রলোক যে দিক থেকে এসেছিলেন, অর্থাৎ স্টেশন ঘরের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তাহলে এখানে বসে আছেন কেন”?
গদা আজ সাহসীকতায় “পরমবীর চক্র” না নিয়ে ছাড়বেনা দেখছি। ও ভদ্রলোকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে চললো ভদ্রলোককে বোঝাতে, যে আমরা ট্রেনে করে আসিনি, এমনি বসে আছি। একটু পরেই চলে যাব।
“কী রে, ইছকুল থেকে ফিরছিছ”?
“হ্যাঁ রে। একটু পরেই আবার ওখানেই পড়তে যেতে হবে”।
“কোথায়”?
“হীরেণ স্যারের বাড়ি”।
“তাহলে তো ভালই হ’ল। এক কাজ কর না, বাড়ি যেতে হবে না। এক্ষুণি আপে গাড়ি আছবে, চল্ নলপুর পর্যন্ত যাই। ওখান থেকে ডাউনে ফেরার গাড়ি পেয়ে যাবি”।
“না রে, দেরি হয়ে যাবে”।
“কিছু হবে না। চল্ চল্ অনেকদিন তো কোথাও যাওয়া হয় নি”।
তখনও ই.এম.ইউ. ভালভাবে চালু হয় নি। বেশকিছু পাদানি যুক্ত আগের কাঠের গাড়িও যাতায়াত করতো। দেখতে দেখতে গদার কথা মতো গাড়ি এসে গেল। নিজের ইচ্ছা না থাকলেও, গদার ইচ্ছা মতো গাড়িতে চড়লাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনের সুখে গল্প করতে করতে নলপুর এসে, প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিক দিয়ে নেমে, পাশের ডাউন প্ল্যাটফর্মে উঠে, একটা বেঞ্চে পাশপাশি বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরার ট্রেন আসার কথা। দু’জনে মনের সুখে গল্পে মশগুল। হঠাৎ একটা লোক এসে সামনে দাঁড়ালো।
“টিকিট”?
“আমরা তো ত্রেনে করে আছি নি”— গদা উত্তর দিল।
“সে তো দেখতেই পেলাম। কথা না বাড়িয়ে টিকিট দেখান”।
“তিকিত কোথায় পাব? ত্রেনে করে আছলে তো তিকিত কাতবো”।
আমি ওর পায়ে একটা চাপ দিয়ে, খুব আস্তে বললাম — “গদা, কেটে পড়”।
আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে, সে পুনরায় বললো — ”আমরা গাড়িতে আছিনি, আপনি ভুল করছেন”।
ভদ্রলোক যে দিক থেকে এসেছিলেন, অর্থাৎ স্টেশন ঘরের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তাহলে এখানে বসে আছেন কেন”?
গদা আজ সাহসীকতায় “পরমবীর চক্র” না নিয়ে ছাড়বেনা দেখছি। ও ভদ্রলোকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে চললো ভদ্রলোককে বোঝাতে, যে আমরা ট্রেনে করে আসিনি, এমনি বসে আছি। একটু পরেই চলে যাব।
আমি চোখের সামনে আসন্ন বিপদ দেখতে পেয়ে, গদাকে সাবধান করে দিয়ে বললাম— “গদা পালা”। আমি নিশ্চিত, আমাদের সাথে ছুটে ভদ্রলোক কিছুতেই পেরে উঠবেন না।
গদা আমার কথায় কর্ণপাত না করে, হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোকের সাথে স্টেশন ঘরে ঢুকলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু পরে স্টেশনের জানলা দিয়ে দেখি, দু’তিনজন গদাকে খুব ধমকাচ্ছে। গদার আর সেই বিক্রম নেই।
বুঝলাম, যাহোক একটা কিছু ব্যবস্থা এখনই করতে হবে। ফাইন দিতে হলেও তো বাড়ি ফিরে টাকা জোগাড় করতে হবে। দলের অন্য ছেলেদের খবর দিতে হবে। প্ল্যাটফর্মে থাকা আর নিরাপদ নয় বুঝে, স্টেশনের পাশে ওয়েটিং রুমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়লাম। রাস্তাটা একটু ঘুরে আবার স্টেশনের অন্য পাশে, একটু এগিয়ে মিশেছে। রাস্তা ঘুরে পুনরায় স্টেশনে ফিরে এসে যাকেই আমার দিকে আসতে দেখছি, তাকেই মনে হচ্ছে রেলের কর্মচারী, বোধহয় আমাকে ধরবার জন্যই আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
গদা আমার কথায় কর্ণপাত না করে, হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোকের সাথে স্টেশন ঘরে ঢুকলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু পরে স্টেশনের জানলা দিয়ে দেখি, দু’তিনজন গদাকে খুব ধমকাচ্ছে। গদার আর সেই বিক্রম নেই।
বুঝলাম, যাহোক একটা কিছু ব্যবস্থা এখনই করতে হবে। ফাইন দিতে হলেও তো বাড়ি ফিরে টাকা জোগাড় করতে হবে। দলের অন্য ছেলেদের খবর দিতে হবে। প্ল্যাটফর্মে থাকা আর নিরাপদ নয় বুঝে, স্টেশনের পাশে ওয়েটিং রুমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়লাম। রাস্তাটা একটু ঘুরে আবার স্টেশনের অন্য পাশে, একটু এগিয়ে মিশেছে। রাস্তা ঘুরে পুনরায় স্টেশনে ফিরে এসে যাকেই আমার দিকে আসতে দেখছি, তাকেই মনে হচ্ছে রেলের কর্মচারী, বোধহয় আমাকে ধরবার জন্যই আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
শেষে প্ল্যাটফর্ম টপকে আপ প্ল্যাটফর্মের দিকে বাজারের মধ্যে
গিয়ে হাজির হলাম। তখন মোবাইল ফোন বা টেলিফোন বুথের চল্ হয় নি। তাছাড়া আমাদের কারো বাড়িতেই
টেলিফোন নেই। কাজেই অন্যান্য ছেলেদের খবর দিতে হলে,
নিজের পাড়ায় ফিরে আসতেই হবে। অনেকক্ষণ সময়ের ব্যাপার, গদাকে একা ফেলে কোথাও যেতেও সাহস হচ্ছে
না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের পাড়ায় ফিরে আসাই মনস্থ করলাম। সময় কাটাতে, এটা ওটার দর করছি আর ফেরার ডাউন ট্রেনের
অপেক্ষা করছি। কিন্তু ফেরার ট্রেনের দেখা নেই। শেষে আবার স্টেশনে ফিরে এসে অফিস ঘরের
জানালা দিয়ে দেখি, আমাদের
গদাচন্দ্র কান ধরে, মন্ত্রপাঠের
মতো সুর করে, অ্যাঅ্যাঅ্যাক-দুউউউই,
তিইইইন-চাআআআর, বলে গুনে গুনে ওঠবোস করছেন।
বিপদের গভীরতা বুঝে আবার বাজারে ফিরে গেলাম।
বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ দেখি ফেরার গাড়ি প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। ছুটে গিয়ে উল্টো দিক
থেকে চলতি গাড়ির পাদানিতে লাফিয়ে উঠে, দরজার কাছে এসে গদাকে শেষ বারের মতো দেখবার চেষ্টা করলাম। কিছুই দেখতে
পেলাম না। তবে ট্রেনের সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম,
তাতে অবাক ও আনন্দিত,
দু’টোই হলাম। এই ট্রেনটায় শেষের আগের বগিটাষ,
গার্ডের কামরা,
আর সেই ভি.আই.পি. কামরার দরজায়, শ্রীমান গদা স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে হাওয়া
খাচ্ছে। বাড়ি ফিরছে, না
জেল খাটতে যাচ্ছে, বুঝলাম
না। হাতের ইশারা করলাম, সেও করলো। হাত নাড়ার কায়দা দেখে তো মনে হ’ল, সে
এভারেষ্ট জয় করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাড়ি ফিরছে। গলায় ফুলের মালা নেই এই যা।
শেষে নির্দিষ্ট স্টেশনে এসে সব শুনে, আমার তো চক্ষু চড়ক গাছে ওঠার উপক্রম।
“কী হ’ল রে? কী ভাবে ছাড়া পেলি”?
এর পরের ঘটনা শ্রীমান গদাধরের মুখেই শোনা।
“আর বলিছ না। অনবরত তেলিফোন তুলে লোকতা বলছে, পুলিছকে ফোন করবো? কোথা থেকে এছেছো? ফাইনের তাকা বার করো”।
“ছ্যার, আমি বীরভূমের একতা গ্রামে থাকি। এখানে এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এছে, ঐ ছেলেতার ছাথে পরিচয় হয়েছে। ও আমাকে বললো ত্রেনে করে বেড়াতে যাবি? আমি বললাম, তিকিত কাতবি না? যদি চেকার ধরে? ও বললো কিছু হবে না। ছাদা, খাঁকি, আর কালো কোত পরা লোক দেখলেই, গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়বি”।
লোকতা ছুনে বললো, “কী ছাংঘাতিক ছেলে। এই ছেলে তোমার বন্ধু? এইছব ছেলের ছাথে মেছো? গাড়িতে চেকার উঠলে কী হ’ত বলতো”?
“ছ্যার, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি হেঁতে বাড়ি চলে যাব। আর কোনদিন ওর ছাথে কথা বলবো না”।
“আগে ফাইন দেবার ব্যবস্থা করো, তারপরে ছাড়ার কথা ভাবা যাবে”।
“আমার কাছে একতাও পয়ছা নেই ছ্যার, ফাইন কোথা থেকে দেব”?
“তাহলে কান ধরে একছো বার উঠবোছ কর”।
“তাই করলাম। না করে তো উপায় ছিল না”।
“তুমি একটা কাজ করতে পারবে? ছোতবেলা আমার এক বন্ধু বিপদের ছময় আমায় ফেলে পালিয়েছিল। তুমি তোমার ঐ বন্ধুকে ধরিয়ে দিতে পারবে? এই নাও দছ তাকা, ধরিয়ে দিলেই পাবে”।
“আমি ছ্যার ওকে কোথায় খুঁজবো? আমি কী ছ্যার এই জায়গা চিনি”?
“জানিছ ছুবীর, লোকতা খুব চালাক। তাকাতা নিলেই বুঝতে পারতো, আমি ছব মিথ্যে কথা বলছি, আমি আছলে এখানকারই ছেলে”।
“ছ্যার, আমাকে ছেড়ে দিন ছ্যার। আমি লাইন ধরে হেঁতে বাড়ি চলে যাব”।
“দুর, এখান থেকে তোমার বাড়ি কত দুর জানো? দাঁড়াও দেখছি কী করা যায়”।
“তারপরে ত্রেন এলে গার্ডকে ছব্ কথা বলে, আমায় গার্ডের কামরায় তুলে দিল”।
“তুই যে সব কথা বলেছিস, তারপরে যদি আমাকে ধরতে পারতো, তাহলে তোর আমার দু’জনের কপালেই দুঃখ ছিল। আমার তো ফাঁসির হুকুম হ’ত”।
“আরে আমায় ছালা চেনে না। ও আমার কী ক্ষতি করবে রে”?
চেকারটা ওর ক্ষতি করতে না পারলেও, আমার যথেষ্ট ক্ষতি করে ছাড়লো। হীরেণ স্যরের কাছে পড়তে যেতে না পারায়, বাড়িতে অযথা বকুনি খেতে হ’ল।
“কী হ’ল রে? কী ভাবে ছাড়া পেলি”?
এর পরের ঘটনা শ্রীমান গদাধরের মুখেই শোনা।
“আর বলিছ না। অনবরত তেলিফোন তুলে লোকতা বলছে, পুলিছকে ফোন করবো? কোথা থেকে এছেছো? ফাইনের তাকা বার করো”।
“ছ্যার, আমি বীরভূমের একতা গ্রামে থাকি। এখানে এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এছে, ঐ ছেলেতার ছাথে পরিচয় হয়েছে। ও আমাকে বললো ত্রেনে করে বেড়াতে যাবি? আমি বললাম, তিকিত কাতবি না? যদি চেকার ধরে? ও বললো কিছু হবে না। ছাদা, খাঁকি, আর কালো কোত পরা লোক দেখলেই, গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়বি”।
লোকতা ছুনে বললো, “কী ছাংঘাতিক ছেলে। এই ছেলে তোমার বন্ধু? এইছব ছেলের ছাথে মেছো? গাড়িতে চেকার উঠলে কী হ’ত বলতো”?
“ছ্যার, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি হেঁতে বাড়ি চলে যাব। আর কোনদিন ওর ছাথে কথা বলবো না”।
“আগে ফাইন দেবার ব্যবস্থা করো, তারপরে ছাড়ার কথা ভাবা যাবে”।
“আমার কাছে একতাও পয়ছা নেই ছ্যার, ফাইন কোথা থেকে দেব”?
“তাহলে কান ধরে একছো বার উঠবোছ কর”।
“তাই করলাম। না করে তো উপায় ছিল না”।
“তুমি একটা কাজ করতে পারবে? ছোতবেলা আমার এক বন্ধু বিপদের ছময় আমায় ফেলে পালিয়েছিল। তুমি তোমার ঐ বন্ধুকে ধরিয়ে দিতে পারবে? এই নাও দছ তাকা, ধরিয়ে দিলেই পাবে”।
“আমি ছ্যার ওকে কোথায় খুঁজবো? আমি কী ছ্যার এই জায়গা চিনি”?
“জানিছ ছুবীর, লোকতা খুব চালাক। তাকাতা নিলেই বুঝতে পারতো, আমি ছব মিথ্যে কথা বলছি, আমি আছলে এখানকারই ছেলে”।
“ছ্যার, আমাকে ছেড়ে দিন ছ্যার। আমি লাইন ধরে হেঁতে বাড়ি চলে যাব”।
“দুর, এখান থেকে তোমার বাড়ি কত দুর জানো? দাঁড়াও দেখছি কী করা যায়”।
“তারপরে ত্রেন এলে গার্ডকে ছব্ কথা বলে, আমায় গার্ডের কামরায় তুলে দিল”।
“তুই যে সব কথা বলেছিস, তারপরে যদি আমাকে ধরতে পারতো, তাহলে তোর আমার দু’জনের কপালেই দুঃখ ছিল। আমার তো ফাঁসির হুকুম হ’ত”।
“আরে আমায় ছালা চেনে না। ও আমার কী ক্ষতি করবে রে”?
চেকারটা ওর ক্ষতি করতে না পারলেও, আমার যথেষ্ট ক্ষতি করে ছাড়লো। হীরেণ স্যরের কাছে পড়তে যেতে না পারায়, বাড়িতে অযথা বকুনি খেতে হ’ল।