স্বপন
হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে মুক্তাকে বাড়িটার সব থেকে উপরের ঘরটায়,চিলে কোঠায় l এই ঘরেই তাদের কত দুপুর বিকেলের
স্মৃতি l ওই তো ভাঙা আয়নাতে এখনো কাদের ছায়া l স্বপন আর মুক্তা, গালে গাল, আবীরের লালে লাল ওদের মুখ, সেদিন কি ভেবে
স্বপন ওর সিঁথি রাঙিয়ে ছিল লাল আবীরে l আর মুক্তা ...
গালে কপোলে, ভ্রু ভঙ্গে রক্তিমা ছড়িয়ে বলেছিল, যাও, বাড়ির লোকে দেখলে কি ভাববে l ভাববে তুই আমার বউ .... ছি : মুক্তার ঠোঁটে আহ্লাদ, চোখে মায়া কটাক্ষ l কক্ষনো না, তুমি একটা বাজে ! শটটা ঐখানেই ফ্রিজ হয়ে গেলে ভালো হত জীবনের মত l
কিন্তু জীবন তো আর গপ্পের বই বা চলচ্ছবি নয়, তাই সময়ের সাথে সাথে সে সোনালী বল গড়িয়ে গেল অন্য খাতে l এই সব টুক টাক ছেলেবেলার প্রেম নিয়ে বড়রা মাথা ঘামান না l তবে সত্যি সত্যি যখন দেখেন গাড়ি অন্য দিকে বাঁক নিতে চলেছে তখন
প্রাণপণে বাবা, মা, জ্যাঠা,
পিসেমশাই, মাসি, মামীরা এসে ব্রেক চেপে দেন l পড়াশোনার সময়ে
প্রেম ? এ কি অলুক্ষুনে কান্ড রে বাবা ! মেয়ে গৃহবন্দী আর ছেলে পাচার, পড়তে, বিদেশে l অত:পর মেয়েটির বিবাহ সাঙ্গ হলো ,মুক্তা নতুন বর পেয়ে প্রায় ভুলেই গেল স্বপন কে ? কি জানি, চলুন দেখাই যাক না l সেই কলেজের দেখা, সেই লুকিয়ে সিনেমা যাওয়া,
আরও আরও কত কিছুই ... চিলের ছাদে সিগারেটএ টান, একদিন অদেখায় আকুল পরান, মুঠো সুখ হাতে নীল
খাম,প্রেমের পহেলা পেহ্গাম, কবুতরা
বুক মুঠি সুখে, চবুতরা ভরা কাটাকুটি সে খেলায় নেই হার জিত
কোথায় হারালো মন মিত !
আর
আজ এত বছর পরে সেই মুক্তা ! সব শুনব, সব
সব .... আগে চল সেই চিলে কোঠায়, তোকে দু চোখ ভরে দেখি l
নিশ্বাস
বদ্ধ হয়ে আসছে,এক দৌড়ে বাড়ির পাঁচতলায়,এবারে সেই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে চিলে কোঠার সেই ঘর l বাড়িটাতে তো কতবার এসেছে মুক্তা, মাঝখানে উঠান,
চারিভিতে ঘর,স্বপনের মায়ের,বৌদির,বিধবা মেজ পিসির ডেমির ঘর,যেখান দিয়ে সর্বদাই একটা ফুল ফুল ধুপ ধুপ গন্ধ বের হত। ওদিকের দক্ষিন
পূর্ব কোণের ঘরটি ঠাকমার l পাকাচুল বুড়ি হামান দিস্তায়
দিন রাত পান ছ্যাচেন,আর গালাগাল করতেন কাজের মেয়েদের । সব
পেরিয়ে দেখে দেখতে চলেছে মুক্তা,সব ঘরগুলো খালি,বন্ধ l বুক ছাপিয়ে কেন জানি না কান্না আসছে
তার,বাঁধ ভাঙা lযেন এরাই তাঁর
চিরকেলে,তার ভারী আপনজনেরা,যেন
এই সেদিন মাধ্যমিকের ফল বেরোলো আর দুজনেই সেকেন্ড ডিভিশন, দুজনেই কান্নাকাটি, দুজনেই গালাগালির শিকার
দুই বাড়িতেই l বড়দের অভিমত, গোল্লায়
গেছে দুজনেই, ছি, প্রেম, ধুয়ে খাবি? প্রেম তোদের রাজা রানী করবে বুঝি ?
তা হোক তবুও পরদিনই দুই জনেই নদীর ধরে ঘুরতে গেছে, নৌকো বেয়েছে, রাত করে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে
মার খেয়েছে মুক্তা lকারণ স্বপন তাকে ধরে দিয়েছে একটা
কাঠবেড়ালির ছানা lছল ছল টানা দুটো চোখ মেলে, ওর আশ্চর্য্য সুন্দর হাসি খেলিয়ে বলেছে, নে,
তোকে দিলাম, আমাদের বাচ্চা,‘মানুষ’কর,নাম দে,আদর l তা সে কাঠবেড়াল নিয়ে কত যে গঞ্জনা সয়েছে
মুখপুড়ি মুক্তা সে রাতে,তা আর কহতব্য নয় lশেষ কালে বাবামশাই এসে বললেন, থাকুক না বৌমা,এমন আর কি,একটা কাঠবেড়াল বই তো নয়,একটা কাঠের খাঁচা বানিয়ে দিলেই হবে lদাদু !
বলে জড়িয়ে ধরে মুক্তা,তার একমাত্র বন্ধু,সঙ্গী বুড়ো মানুষটিকে l আর সোজা গিয়ে শুয়ে পরে
দাদু ঠাকমার মাঝে,পালঙ্কে lঠাকমা
গায়ে হাত বুলিয়ে দেন,মুক্তা শুনতে পায়,মা প্রায় সিংহীর মত গজরাচ্ছে বাবার কাছে,এবার
সেকেন্ড হয়েছে পরের বার ফেল করবে নির্ঘাত, যদি ওই
বাউন্ডুলে ছেলে পিছু না ছাড়ে ,দেখে নিও,আমি সম্যক দেখতে পাচ্ছি বাবা নিশ্চয়ই বই থেকে মুখ তুলে,চশমার আড়ালে মাকে দেখে নিয়ে আবার বইতে মুখ লুকিয়েছেন l
আদর
! আদর করে গালে হাত বুলুচ্ছে স্বপন,মুক্ত,
তুই আগের থেকেও ভালো দেখতে হয়েছিস রে,কেমন
আলো আলো,ভালো .... খুব যত্নে আছিস জানি lভালই হয়েছে, আমি কি আর তোকে এতটা ভালো রাখতে
পারতাম রে .... একটানা বলে চলে স্বপন l মুক্তার চোখে জল
আসে lভালো ? সত্যি সে ভালো আছে
তো ? তবু মুখ ফুটে সে কথা বলে না স্বপন কে,জানে স্বপন ব্যথা পাবে l ভালো আছে স্বপন,বিয়ে থা হয়েছে বলল, অনেকদিন l এখানে বড় বাড়ি, গাড়ি, তবু এই পুরনো বাড়িটা তাকে নাকি টানে l আসে
মাঝে মাঝেই l আজ মুক্তার সাথে দেখা হবার পরে যেমন এলো ...
অনেক কথা হলো ছাদে বসে, তারা ভরা ফাল্গুনী আকাশের নিচে
দুই মানুষ,বহু বছর বাদে lমুক্তার
মনে হলো,যেন এক অন্য জন্মে তাদের দেখা হয়েছে আবার lভালবাসি তোকে মুক্তা …..
একটা সময় কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে নেড়া ছাদটার ধারে lসরে আয়,শিউরে উঠে বলে,স্বপন l ভালো থাক তুই,কি ভেবে মুক্তার উষ্ণ ঠোঁটে একটি সস্নেহ চুম্বন এঁকে দেয় সেই এক মাথা
চুল, স্বপন কাজল মাখা চোখের মানুষটি lসেই কাছে আসায় এক গভীর মমত্ব,স্নেহ,প্রেম,জন্মান্তর খেলা করে যায় যেন lআর মুক্তার মনে হয় এই সে পরম ক্ষণ lএই শট টি
ফ্রিজ করাই থাকনা জন্মের মত !
স্বপনের
আলিঙ্গন শিথীল হতেই ........ একটি সাদা বকের মত উড়ে চলে যায় মুক্তা l
ওই আকাশে হারিয়ে যায় l কেউ তার হদিস পায়
না আর l নাহ মৃতদেহ রাস্তায় পাওয়া যায় নি কারও l মুক্তা হারিয়ে গেছে, তারা হয়ে গেছে, কেউ তার খোঁজ করেনি,কেউ না l কেউ ছিল না তার .... স্বপন খুঁজে বেরিয়েছে তাকে পাগলের মত সব জায়গায়,
খোঁজ পায়নি l তবু আজও মাঝে মাঝে কিসের
টানে যেন এই বাড়িতে চিলের ছাদে এসে বসে থাকে স্বপন l আর
তখনি টুপ করে এক বিন্দু অশ্রু ঝরে পড়ে ওর মুখে, হাতে ... মুক্তা
কাঁদে ! স্বপন জানে না কবে এই প্রতীক্ষার শেষ হবে l