গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মার্চ, ২০১৫

দেবাশিস কোণার /দুটি অনুগল্প


ভেঁপু

বিশ্বাস করুন এই ভেঁপু কোনও আম আঁটির বাঁশি নয় । অনেক অনেক দিন আগের কথা । আজকের মত তখন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অফিসগুলোর অবস্থা এমন মলিন ছিল না । সবে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে অপু । সালটা ১৯৮৩ -র সেপ্টেম্বর মা স ।অপুর পুরো  নাম অপূর্ব সাঁতরা । প্রধানমন্ত্রী দেশে ব্যান্ড অন রিক্রুটমেন্ট চালু করে দিয়েছেন । নেহাত সে সোনার চাঁদ ছিল বলে কোনক্রমে চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল ।তো যাইহোক সরকারি চাকরি বলে কথা ।হাতে যেন চাঁদ পেল অপু ।এবার আসা যাক সোনার চাঁদের কথায় ।সে সময় বাজারে এস-সি এবং এস- টি যতারা তাদের সোনার চাঁদ এবং সোনার টুকরো বলে সম্বোধন করা হত।অপু যে হেতু শিডিউল কাস্ট তাই সে সোনার টুকরো ছেলে।

বেশ কিছুদিন ট্রেনিং ইত্যাদির পর তাদের পাকাপাকি চাকরি হয়ে গেল । ডাক বিভাগের একটি অংশ আর এম এস সেখানে দিনরাত কাজ হয় ।তাদের  ডিউটিরর ও কোনও ঠিকঠিকানা নেই । জস্মিন দেশে জদাচার । অপু ভীষণ ঘুমকাতুরে । কিন্তু এখানে তো কিছু করার নেই । পেটের দায়। চাকরিটা তো আর ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না ? রাতের চাকরি । প্রথম রাতটা কিভাবে যে হই হই করে কেটে গেল তা বুঝতেই পারল না অপু । অফিস ভর্তি লোকজন ।দফায় দফায় চা। ক্যান্টিনে অল্প পয়সায় পেট ভরে আহার । অফিসের সামনে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ ।গাছে গাছে পাখির কলকাকলি । আগের অফিসে খুব সুন্দর একটা পরিবেশ ছিল । অপু জয়েন করেছিল কলকাতা এয়ার পোর্ট সটিং এ।

যে অপু আগে রাত জাগতে ভয় পেত ,সেই এখন রাতের চাকরি ছাড়া অন্য ডিউটি করতে চায় না। দিনের বেলা প্রচুর সময় পাওয়া যায় । একরাত চাকরি করলে পরের দিন এবং রাতে ছুটি থাকে। অপুর সে সময় মনে হত এমন চাকরি কোথাও খুজে পাবে না কো তুমি । সে এই চাকরিটা খুব উপভোগ করতো ।

এই অফিসেই কাজ করতেন ভুপেনদা । অপু বেশ কয়েক রাত কাজ করবার পর ভুপেন দা কাজে যোগ দিল। কয়েকদিন তিনি ছুটি নিয়েছিলেন।তার নাকি পারিবারিক কিছু সমস্যা হয়েছিল ।এই ভুপেন দা আদতে ছিলেন ডাক বিভাগের কুলি । ওদের সে সময় বলা হত পোর্টার বা মেইল ম্যান । ক্লাশ এইট পাশ । বিভাগীয় পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে পোর্টার থেকে সর্টার হয়েছেন । এ পদ্ধতি ডাক বিভাগে এখনও চালু আছে। তবে এখন আর এইট পাশে চলবে না।  তো আর এম এসের কাজ ,তার ওপর রাতের চাকরি । ভুপেন দা ছিলেন খুব সরল সাদাসিধে । আবার অল্প কথাতেই রেগে যেতেন । কোন এক দুর্বল মুহূর্তে ভুপেন দা তার সংসারের অশান্তির কথা কোনও একজনকে বলে ফেলে ছিলেন। কথাটা আর কিছুই নয় - ভুপেনদার বউ ছেলের গৃহ শিক্ষকের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন । আর আর এম এস হল এমন এক জায়গা যেখানে তিলকে তাল করা হয় । কাজ করতে করতেই ভুপেন দাকে তার এক বন্ধু গিয়ে বলল ,এই ভুপেন ,বল কবে তোর বাড়ি যাব । তুই নাকি বৌদিকে খুশি করতে পারছিস না । আমি সব ঠিক করে দেবো ।'ইঙ্গিতটা স্পষ্ট । নিজের স্ত্রী সম্পর্কে এই সব কথা শুনলে কার না মাথা গরম হয়  ? শুধু তো একজন ই না , অফিসের ছোট বড় সকলেই ভুপেন দার কাছে গিয়ে তার স্ত্রী সম্পর্কে আজে বাজে কথা বলা শুরু করল । আর সহ্য করতে পারল না সে । প্রবল চিৎকার আর গালাগালি শুরু করে দিল সে । অফিসের বড়বাবু দৌরে এলেন,‘কি ব্যাপার ভুপেন,কি হয়েছে ?'ভুপেন দা তখন বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল ঢালছেন । আর চারিদিকে ভীষণ চিৎকার । ভুপু-- ভুপু--ভুপু ---ভুপু । যেন মধ্যরাতে শিয়াল ডাক ।

কাজ টাজ সব মাথায় উঠে গেল । ভুপেন দা একটু শান্ত হওয়ার পর বড়বাবুকে বলল ,' আপনি একটা বিহিত করুন !'বড় বাবু বললেন ,'তুমি একটা লিখে দাও , তারপর আমি দেখছি ।' ভুপেন দা যা লিখেছিল হুবাহু সেটাই এখানে তুলে দিয়ে গল্প শেষ হবে । সে লিখেছিল ,'টু দি এইচ এস এ (বড় বাবু,ক্যাল এ পি সর্টিং ডিভিশন,ক্যাল-৫২ রেস্পেকটেড স্যার, উইথ ডিউ রেস্পেকট , আই বেগ টু স্টেট দ্যাট এভরি বডি ওয়াজ টকিং আবাউট মাই অয়াইভস ফাকিং প্লিজ টেকিং নেসেসারি আকশন । নিচে তার সই ।
               
নেশা


           কার যে কখন কি ভাবে নেশা করতে ইচ্ছা হয় , তা অনল জানে না। ছোটবেলা থেকেই সে দেখে এসেছে যে তাদের বাড়িতে কেউ কখনও কোনও নেশা করে না। বলা সামান্য ভুল হল ।বাবা ,মাঝে মধ্যে সিগারেট খান তবে তা কখনই প্রকাশ্যে নয় । অনলের দাদা অভয় । সে ও বোধহয় স্মকিং করে ।তবে তারও বুকের পাটা ততটা চওড়া নয় ,যে বাড়িতে বসে সিগারেট খাবে ? বাবা চাকরি করে । দাদাও চাকরি পেয়েছে । শুধু অনল এমন হতভাগ্য যে এই বাড়িতে থেকেও কোন চাকরি এখনও জোটাতে পারল না। জানেন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় তার ।  আজ অনল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে । ও বাবার সামনে বসে গাঁজা সেবন করেছে । জানালার কাঁচ ভেঙ্গেছে । ওকে সুস্থ করবার বহু চেষ্টাই করেছে বাড়ির লোকজন । কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেছে ।গত একটা বছর ধরে টানাপড়েন চলেছে  তাকে কেন্দ্র করে । কি না করেছে সে । সকাল থেকে রাত অবধি নেশা করে বাড়ি ফিরেছে সে। মা দেখেও না দেখার ভান করেছে । বাবা তার কথা শুনে এড়িয়ে গেছেন । অবশেষে সে যখন সব সীমা অতিক্রম করে গেছে তখন বাধ্য হয়ে ওরা তাকে এনে ভর্তি করেছে এখানে ।

       অনলের জীবনে যদিও পাওয়ার পরিমাণটা বেশি তবে না পাওয়ার ঝুড়িটা ও কম নয় । বাড়ির ছোট ছেলে সে। বেকারত্বের জ্বালা । প্রেমের আঘাত এবং অবজ্ঞা সে সহ্য করতে পারে নি । আজ সে মাদকাশক্ত ।