এক
সম্মিলিত আওয়াজটা আসে
দক্ষিণ-পূর্বকোণ থেকে । একযোগে
কয়েকজন মেয়েলোকের বিলাপআহাজারি বাতাসে ভেসে ভেসে ক্রমেই একটা সংঘবদ্ধ শোরগোলের
সৃষ্টি করে । সাথে পুরুষমানুষদের বাওয়াইল্যা হাঁকডাক পরিবেশটা কেমন ভয়াবহ করে তুলে
।
সন্ধ্যা উতরেছে অনেক আগেই ।
নির্মল চাঁদহীন আকাশ গুটিকয় তারার আলোয়
কিছুটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে । আঁধার যেন মরা মানুষের মত হিম হয়ে আসছে ঘন হয়ে,তবে
নিজের হাতের লোম অস্পষ্ট দেখা যায় এমন । একটু আগে ঠেক থেকে ফিরলাম ।
আওয়াজ শুনে কলিমমামু
উত্তর ভিটের ঘর থেকে বের হন । মামুর হাতে তেল চকচকে লাঠি । লাঠির মাথায় বসানো তীক্ষ্ণ
লোহার ফলা । আমার হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ।
-মামু
আওয়াজ কিতানের ?
-বুজতাম
ফারতাসিনা ভাইগ্না । কাইজ্জা কুইজ্জা না কিতা ?
বিত্তান্ত জানতে আমরা
রাস্তায় উঠি । মামু শক্ত মাটিতে ফলা গেঁথে গেঁথে এগোয়
শব্দের উৎস লক্ষ্য করে আর আমি পেছনে টর্চ ধরি ।
কলিমমামুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের দিকে । অত্যন্ত সাহসি মানুষ, পোক্ত বলশালী দেহ । মেদহীন
শক্ত গড়ন ।এই ভাটিবয়সেও হাতের শিরা ফুলে ফুলে উঠছে চলার ছন্দে । একদম ছোটবেলা থেকে
দেখছি কলিমমামুকে । দাদাজানের কাছে শোনা-‘একদা এতিম কলিম উদ্দিন’ নামের এক নাবালক নাকি বুরো ধানের ক্ষেত লাগাতে এসেছিল আর
ফিরে যায়নি । রয়ে গেছে আমাদের বাড়িতে । উত্তরের
ভিটায় নিজের মত করে ঘর করে নিয়েছে । বিয়ে করে সংসার পেতেছে ।
আমাদের পরিবারে দপ্তর দুইটা ।আগেও ছিল, এখন কেবল মালিকানা বদলেছে । দাদিজান আর দাদাজান গত
হওয়ার পর দপ্তর দুইটার দায়িত্ব বর্তেছে আম্মাজান আর আব্বাজানের ঘাড়ে । হালিমা মামী যাকে কলিমমামু নিকা করে এনেছিল, তিনি সময়ের সাথে সাথেআম্মাজানের দপ্তরের
মূল চালিকা হয়ে উঠেন আর কলিমমামু আব্বাজানেরজমি জিরাতের দপ্তর সামলান। শুরু থেকে আংশিক সামলাতেন, এখন অবশ্য পুরোপুরিই তার হাতে ন্যস্ত । ফসল বুনা থেকে ঘরে তোলা, গরু
বাছুর দেখাশুনা করা থেকে বকরিদে গরুছাগল কেনা সহ সবদায়িত্বকলিমমামুর । আব্বাজান কেবল আয়েশি অর্ডার দেন ।
এদিকে আমাদের পাড়ায় উঠতি যুবকদের আর একটা গোপন দপ্তর ছিল । কলিমমামুআর হালিমা
মামীর একমাত্র মেয়ে চুমকি বুবু ছিল শুধু এ পাড়া নয় গোটা এলাকার কিশোর তরুণদেরসেইগোপন
দপ্তরের ফ্যান্টাসি । তখন আমারসে কি ডিমান্ড ছিল ? কেউ আমাকে চটাতে চাইতো
না । কারন আমার হাত দিয়েই কিনা এই দপ্তরের সকল যোগাযোগপত্রাদি যাতায়াত করতো !চুমকি
বুবুরও বিয়ে হয়েছে অনেকদিন ।
-কিতা
বেডা, কই মনয় আওয়াজডা ?
-মনয়
বাজারের পূবে । তুমি কিতাবুঝতাস ?
-অই
ঐদিগঐমনইতাসে ।
-আওগগাইবা
না কিতা ?
-বাইরইসি
যহন দেইক্কা আই বেফারডা ।
ছোট বেলায় কলিমমামুআমাকে
যেখানেই নিয়ে যেত, জেদ
ধরতাম ঘাড়ে চড়ার । মামুর ঘাড়ে চড়ে বাজারে গিয়েছি । বৈশাখী বান্নিতে যাচ্ছে
মামু, আমি তার ঘাড়ে বসা । মাছ ধরতে বিলে গিয়েছে, ঘাড় আঁকড়ে আমি ।আরো কত কত জায়গাতে ? আজ মামুর সেই চওড়া ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এগোই । ক্রমেই
শব্দ জোরালো থেকে জোরালো হয় আর বিচ্ছিন্নকিছু কথাবার্তা শোনা যায় লোকজনদের ।
‘ইশ, এইরম একটা কাম কেডা করলো ?
‘এইরম
তাজা একটা পোলা ?’
‘পোলাডা তো ভালই আসিল ।’
‘চাক্কু
দিয়া গাই দিসে ।’
‘নানা,
ড্যাগারদিয়া।’
‘বাঁচতো
না মনয় ।’
‘কোনআশানাই।’
আমার শরীর হিম হয়ে আসে
। হাঁটার গতি কিছুটা শ্লথ হয় । কলিম মামু বুঝে ।
-ভাইগ্না, ইগানো খাড়ও । আমি খবর লইয়া
দেহি বেফার কিতা ।
আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি পাশেই রতনের চায়ের টঙ । কেটলিতে বকবক করে পানি ফুটছে ।
দুয়েকজন পরিচিত খদ্দেরের হাতে চায়ের কাপ । তাদের কথাবার্তায় কেমন একটা ভয় মেশানো
নির্জীব নির্জীব ভাব ।
মামা ফিরে আসে একটা দুঃসংবাদ নিয়ে । সনাতন মারা গেছে । আসলে মারা যায়নি, কারা যেন মেরে ফেলে রেখেছে রাস্তার ধারে।
মানে সনাতন খুন হয়েছে ।
দুই
বেশ ক’দিন
আগের ঘটনা । সেরাতে তৃতীয় বারের মত আমাকে কেঁপে উঠতে হয়েছিল । ভররাত্তিরে জেগে আছি
নাকি ঘুমিয়ে পড়েছি কিংবা জেগে থাকলেই বা কি করছি, একদম জানবার কথা নয়বাইরের
কারো। অথচ জেনে যায় । ফোনটা আসে অপরিচিত নাম্বার থেকে ।
-কিতা
করস রে ?
লেহালেহি করতাসস
না কিতা ?
রাত তখন দ্বিপ্রহরে । ইদানিংপল্লীবিদ্যুৎএক অস্বস্তিকর উপদ্রব শুরু করেছে, এই আসে এই যায় । তবে গরম
কিছুটা কম । শীত আসছে আসছে করছে । কার্তিকের বাতাসে হালকা কুয়াশার জটলা । ভোর কিংবা সন্ধ্যায়
ফসলি মাঠের দিকে তাকালে যাকেধোঁয়ার পাঁক বলে ভ্রম হয় এ আসলে কুয়াশা । ধলপ্রহরে হীম
ধরা শীতে বেশ মোটা কাঁথাইজড়াতে হয় গতরে ।
আমার রোমের জানালা দুইটাই
খোলা । ছয় দিন গত হওয়া চাঁদের বাঁকানো পেট খানিকটা বেড়ে বেড়ে
অনেকটাই ভরাট হয়ে উঠেছিল । ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম । নতুন
কিছু লিখছিলাম না, তবে এডিট করছিলাম পুরনো একটা লেখা । কেটেছেঁটে নতুন শব্দ
যোগ-বিয়োগ
করছিলাম,
কোথাও গোটা
লাইন সংযোজন-বিয়োজন চলছিল । তার মানে কিছু না
কিছু তো নতুন হচ্ছিল বটে !তখনি কলটা আসে ।
-কেডা
?
-আমি ।
একটু থ’মেরেযাই।নাম্বারের মত গলাটাও
অপরিচিত । চিনতে চেষ্টা করি ।দ্বিতীয় প্রশ্নটাও আসে ওপাশ থেকে ।
-কিতা
করস ? লেহালেহি করসতাসস না কিতা ?
-না
। বইয়া রইসি । ঠিক চিনলাম না, কেডা ?
-আমি
সনাতন ।
-অ
। কিতা খবর রে ? অত রাইতে ?
সংক্ষিপ্ত অজরুরি কথা
শেষ হয় । দস্তুরমত চিন্তায়পড়ে যাই। শালা জানলো কিভাবে আমি এখন লেখালেকি নিয়েই
ব্যস্ত?
মাঝে মাঝে বেহুদা চিন্তারাজোরালোভাবে ভর করে মনে । এই
যে“কিভাবেজানলো”-এইকথাটা তখন কেবল মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল । মন থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছি । কিন্তু পারছিলামনা।তাছাড়া যে কয়টা ঘটনা
নিকট অতীতে ঘটলোবলে শুনানো হয়েছিল আমাদের, তাতে খানিকটা চিন্তিত
হতেই হল ।
প্রথম ঘটনা এরওমাস
দেড়েক আগে । দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরেছি । সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত আড্ডা খানায় যাতায়াত । অনেকের
মুখেই শুনেছি, সনাতন নাকি বেলাইনে ঢুকে গেছে । বাংলা মদের আছর পড়েছে সাংঘাতিকভাবে । বাড়ি থেকে একরকম তাড়িয়ে দিয়েছে ।আসলেই কি লাইনচ্যুতি ঘটেছে সনাতনের ? ওরসাথে
কথা বললেকিন্তু একদম বিশ্বাস হয় না । তবে বাংলা মদের গন্ধটা ঠাহর করা যায় প্রায়ই । এখন সারাদিন টইটই ঘুরে বেড়ায় আরসন্ধ্যা হতেই আড্ডা খানায় হাজির হয় । কেউ বেফাঁস কথা বলে না খুব একটা ওর সামনে, ডরায়। তাছাড়া কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়ঠিক আছে? সনাতন
একপাশে বসে পাইলট সিগারেট টানে নিবিড় মনে । মাঝে মাঝে গোল্ডলিফ
কিংবা বেনসন ।
সনাতন আমাদের ছোটবেলার
বন্ধু । রাজনীতি করে । ‘করে’ বললে ভুল হবেরাজনীতি এখন তার ধূসর অতীত
। সময়েখুব একটা সুবিধা করতে পারেনি । আমরা যখন পড়াশুনা আর ক্যারিয়ার গড়া নিয়েতুমুল
ব্যস্ত,
সনাতন তখন ইউনিয়নপথ
কাঁপায় মিছিলে । হেঁয়ালি করে অনেকে বলে, সনাতন নাকিমেঠোপথ কাঁপানো সৈনিক । এইটুকুই যা । থানা কিংবা জেলা পর্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি । তার
আগেই ঝরে গেছে । সনাতনের কথায়, ওকে উপরে উঠতে দেয়া হয়নি । কে বা কারা নাকি ইচ্ছে
করেচেপে ধরেছে । অন্যথায় অনেক উপরে পৌঁছে যেত । অথচ আমরা দিব্যচক্ষে দেখেছি, সে নিজেই একসময় থেমে গেছে ।তাছাড়া
৪৫ কেজি ওজন আর পাক্কা ৫ ফিটের দেহটা নিয়ে এর উপরে যাওয়া যায় না । এই মাপেরখুব কম
লোককেইআমরা উপরে যেতে দেখেছি । অথচ কথার প্যাঁচে এখনো সনাতন রাজা । একদিন সুযোগ
তার আসবে,
তখন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না-এমন বিশ্বাস গলায় ঝড়ে তার এই কঙ্কাল
সময়েও । এই যেওর যাপিত সময়টা-সনাতনের বেলায় একেই কঙ্কালসময় বলতে
হচ্ছে এবং এর মারাত্মক কিছু সিমটমও আছে ।
সেই সনাতন একসময়
পরিবারে বোঝা হয়ে উঠলে, ছিটকে
পড়ে দূরে । দলীয় মানুষদের মাঝে বিরক্তির কারণ হয় । রাজনৈতিক সহযোদ্ধা-সহবোদ্ধাদের কাছে নিছক আজাইরা
লোক হিসাবে অবমূল্যায়ন কুঁড়ায় । অথচ বন্ধুদের কাছে এখনও ভিড়তে পারে অবলীলায় । একটা
সিগারেট কিংবা এক কাপ চা না চাইতেই পেয়ে যায় । আর চাইলে তো আরো অনেক কিছু !
এক সন্ধ্যায় আকাশটা
কালো করে মেঘ জমে । বন্য মহিষের রঙে উত্তর-পশ্চিম কোণেদেখা যায় গাড় আন্ধারের পোঁচ। পাল্টে যাওয়া ঋতু বৈচিত্রে এই ভরহেমন্তেও বুঝি বান ডাকে । মেঘের গুড়ুম গুড়ুম
শব্দে বিলের জল নাকি ফুলে উঠে মরা মোষের পেটের মতন-বিল ফেরত অনেকেইবলাবলি করে । এই মেঘ
গেলেই শীতের হিম প্রকোপ বাড়বে-এমনটা বিশ্বাস সবার । আমরা চুপচাপ বসে আছি ঠেকের
বাইরে । দক্ষিণের বাতাস বর্ষীয়ান শিরিষ গাছের মাথা কাঁপায়ে উত্তরে ঢুকে । বৈশালী
মাঠের বুক কামড়েযে বিশাল দিঘিটা আর দিঘিটার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যে ক’টাতালগাছ আছে-তাদের পাতায় নিশি কুটুম্বরা
জাপটা জাপটি করেবাতাসের তুড়ে ।
আর তখনি একটা পাকা তাল ধপ করে জমিনে ঠেকে । সনাতন
কেবলি চেয়েথাকে দু’চোখেবিস্ময়নিয়ে।
-আমি
উনার দর্শন ফাইসি । আর কোন হালারে আমি মানি না ।
নড়েচড়ে বসি আমরা । সনাতন
কথা বলা শুরু করলে এই উতলা পরিবেশে সময় কাটানোর খোরাক পেয়ে যাই । তাছাড়া কাকে
পেয়েছে আর কাকেই বা মানে না-স্পষ্ট করে জানা দরকার ।
-কেডার
দর্শন পাইসত আর কেডারে মানস না ?
-উনার
দর্শন । দু’জাহানেরবাদশাযিনিতাহার।
-হালার
বেডার মাথাডা একবারে গেসেগা ।
পাশ থেকে একজন মন্তব্য করে । সনাতনের তাতে ভ্রূক্ষেপ
নেই ।
-ক্যামনে ফাইলে রে ?
-কসম আল্লা, একটাও যদি মিছা অয় ?
-ঠিকাছে । সব হাসা কতা । এইবার কইয়া লাক্যামনে তাইনরে ফাইসত ।
-একদিন রাইত, আনুমানিক আড়াইডা বাজে এরফরও ঘুম আইয়ে না আমার
। এইফাশ ওইফাশ কইরা একসময় ঘুমাইলাম । চোখ লাগার ফরফরই কমু কিতা তরারে খুব ডরেরএক
স্বপ্ন দেকলাম । অতডাই ভয়ঙ্কর যে-ঘাইম্মা চুপচুপা ভিইজ্জাগেসিলগাআমার গঞ্জি । মনে
অইসিল,কয়েক লিটার পানি ফরসে বিছনার চাদ্দরে । ঘুমের মাইজে যে চিল্লাইসি,হেই আওয়াজ হুইন্না আম্মা উইট্টা আইসে
আমার রোমে ।
-কিতা
দেখসস স্বপ্নে, খুইল্লা ক ?
-নির্জন
একটা রাস্তা । গাছপালা দিয়া ঘেরা । ঠাণ্ডা পরিবেশ । চাইরদিগে কোন মানুষজন নাই । রাস্তাডা
দিয়া আইট্যা যাইতাসি সামনে । হডাৎ একটা মাইনসের আওয়াজ হুনলাম । মানুষটা আমারে ঐ
রাস্তা দিয়া সামনে যাইতে মানা করতাসে । চারদিকে ঘুইরা চাইলাম, কেউরে না ফাইয়া আবার আডা দিসি সামনে । একটু সামনে গিয়া দেহি, একটা
বিশাল দিঘি । এই যেমন আমরার বৈশালী মাডের দিঘিডার হমান ।
আমরা বৈশালী দিঘিটা নতুন করে দেখার জন্য চোখ দেই । ঘুটঘুটে অন্ধকার । তবুও চারদিক
উন্মুক্ত বৈশালী মাঠের মাঝে দিঘিটার অবয়ব অস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ।
-তারপর কিতা দেকসত ?
-দেকলাম দিঘির মাইজ বরাবর একটা সোজা রাস্তা
। আমি করলাম কিতা, ঐ
রাস্তা দিয়া আডা দিলাম । দিঘির ঠিক মাইজখানে গিয়া দেহি রাস্তা শেষ ।
পিছে চাইয়াই ডরাইগেলাম গা ।
দেহি, পিছেও কোন রাস্তা নাই । আর রাস্তা কই পামু, চাইরহান্দা দেহি ফানি আর ফানি । আমি জান দিয়া হাতরাইতাসি-কূলকিনারা আর ফাই না ।
সনাতন থামে । কেউ একজনএকটা
সিগারেট এগিয়ে দেয় । বাতাসের এই ঝাপটার মাঝেও কায়দা করে আগুনটা
ধরায় । দুই আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেটটা রেখে বিশাল ক’খানা টান দিয়ে দম নেয় ।
-এরফর ?
-হাতরাইতাসি, হাতরাইতাসি । নাক-মুক
দিয়া ফানি ডুকতাসে । আমার দম বন্ধ অইয়া আইতাসে । হঠাৎ সামনে একটা পুরান গাছের গুড়ি
ভাইস্যা উডতে দেহি । জাপটাইয়া ধরলাম গুড়িডারে । ঢেউয়ে
ঢেউয়ে গুড়িডা আমারে এক কিনারোলইয়া যায় । আস্তে আস্তে পানির উফর গুড়িডা সোজা অয় । আলাজিলা
আমি একজন মানুষরে দেকতাম ফাই । তাইন ফাড়ে খারইয়া আসিল । গুড়ি বাইয়া উপরে
উইট্যাদেহি কেউ নাই । ঘুম ভাইঙ্গা যায় । বিছনা চবচইব্যা ভিজা ।
-ইডা তো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন । এইহানো কারে
পাইসত তুই
?
-আসল স্বপ্নডা দেখসি আরো ৩ সপ্তা ফর ।
দে আরেকটা সিগারেট দে ।
জ্বলতে থাকা একটা সিগারেট
এগিয়ে দেয় একজন । সনাতন আলগোছে ঠোঁটে ঠেকায় ।
-ঐদিন
কিতা দেকসত কস না কেল্লাইগগা ? তাড়া দেয় একজন ।
-একটা নির্জন জাগা । আমি আটতাসি । দূরে
দেহি একজন বয়স্ক লোক, সাদা
লম্বা পাঞ্জাবি ফড়া, মুখে লাম্ব দাঁড়ি, একটা ফালঙ্গে কাইত অইয়া হুইত্তা রইসে । মাথার
কাছে একটা সুন্দর লাডি রাহা । উনার সামনে একটা ৭/৮ বছরের আবুইদ্দা খেলতাসে
। আমার মনে অইসে লোকটার দিগেআমি ঘণ্টার উফরে চাইয়া রইসি ।
নূরানি চেহারা, কাঁচা অলদির মতন রঙ । কিতা কমু তরারে,
অত সুন্দর মানুষ আমি জিবনেও দেকসিনা ।
সহালে উইট্যা মাদ্রাসার হুজুরের কাছে গেলাম ।
দুইডা স্বপ্নের কথাই কইলাম । হুজুর একটু সম নিরব থাইক্কা কইল, তুই পাইসস দেহা ।
আসলেই আমি ফাইসি । অন্য কোন হালারে মানি না ।
তিন
এবার ঈদ-পূজা দুটোই একসাথে । ঈদের বাহারি আমেজ থাকলেও পূজার
আয়োজন এখানে মন্দা । হিন্দু পাড়ায় যে কয় ঘর সনাতনী ধর্মাবলম্বী আছে, ওরাও কেমন যেন মিইয়ে গেছে । আগের উচ্ছলতা নেই
। আর্থিক দিক দিয়ে এরা এতটাই দুর্বল যে কোন রকম দুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে । আর দৈন্যতার ছাপ পড়ে পূজাপার্বণে ।
ফলে পুরো এলাকায় কেবল মাত্র একটা দুর্গামণ্ডপ
চোখে পড়ে । ওখানে ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় রাত বাড়তেই । পূজার প্রস্তুতি শুরুর দিন
থেকেই সেয়ানা ছেলেরা সারারাত পড়ে থাকে মণ্ডপে । পাহারা দেয় পালা করে । যদিও ভয়ের
কিছু নেই এখানে তবুও ওরা কেন যেন ভয় পায় ।
হিন্দু পাড়ার কালিচরণ, রাইচরণ, বিশু, মাণিক, সুবল
ওরা আমাদেরই বন্ধু ।একই স্কুলে পড়তাম । অনেক দিনের গ্যাপে পরস্পরের সম্বোধন
ঠেকেছে তুই থেকে এখন তুমিতে । আমাদের মেশামেশিআর নেই বললেই চলে ।দূর থেকে হাই-হ্যালোতে
সীমাবদ্ধ ।কালিচরণ-রাইচরণ
বিনু কাকার ছেলে । বিনু কাকা জাতে ঘোষ । কষ্ট করে ছেলে দুইটাকে মেট্রিক
অবধি টেনে নিয়ে সরকারী অফিসের ক্লার্কের চাকুরীতে ঢুকিয়েছেন । বিশু-মাণিকের বাবা নকুল কাকাছিলেন নাপিত । নকুল কাকা মারা যাবার পর বিশু ক্ষুর-কাঁচি ধরেছে । মানিক টেন পর্যন্ত পড়াশুনা করে এখন সুয়েটার কোম্পানিতে আছে
। আর একমাত্র সুবলের বাবা চাকুরীজীবী ছিল । কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষাও ছিল
তার ।ইউনিয়ন পরিষদের হেড ক্লার্কেরপদে চাকুরি করত । সে মতে অন্য সবার তুলনায় সুবলের অনেক উঁচুতে যাবার কথা ছিল কিন্তু সেও আটকে
গেছে ক্লার্কেই । কপালগুণে ওর বাবার চাকুরীটা আঁকড়ে বেঁচে আছে
।দেখলাম,
ওদের
সাথে সনাতনের বেশ মাখামাখি । এটা আবারআমাদের মাঝের অনেকের নাপছন্দ । সরাসরি বলে না কেউ কিন্তু ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় ।
সনাতনের দেখা নেই বেশ ক’দিনধরে । কে যেন বলে, সনাতন পূজারমণ্ডপ
পাহারা
দেয়রাতে
। কিন্তু
আমাদের
সনাতনতো
হিন্দু
নয়, পুরোদস্তুর মুসলমানের ছেলে । তবে ? “মালোদের
সাথে মিসশ্যা
মিসশ্যা হালা মালু অইতাসে । নামডা পর্যন্ত
বদলাইলাইসে”-
বলেগালি
দেয় কেউকেউ
।
নাম শুনে কেউ কি বুঝবে সনাতন মুসলমান ? আকিকা দিয়েছিল মুহাম্মদ জইনুল মিয়া নামে । মসজিদের
ইমাম সাবের দেয়া নাম বদল করে নিজেই একসময় ‘সনাতন’বলে নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করে । নাম
বদলের কারণ জানতে চাইলে-‘রহস্য কউঅন যাইত না’ বলে নিজেকে গুটিয়ে নেয় । সনাতনের ‘না’শব্দের পর আর কারো কোন কথা থাকেও
না । ফলে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করা হয় না ।
ইদানিং সনাতনের কথায়-আচরণে
অনেকেই রুষ্ট পায় । তার কাজকর্ম নিয়েও অনেকের ক্ষোভ উপচে পড়ছে । আমরা বন্ধু বলে সামলে নেই কিন্তু সনাতনের যারা শত্রু, ওরা তো ওৎ পেতে আছে কিছু একটা ঘটাবার জন্যে ! চারদিকের
বাউবাতাস ভালো ঠেকে না । ওকে সতর্ক করি ।
ঈদ-পূজা শেষ হয় । হপ্তাকয়েক ঘুরে গেলেও
সনাতনের দেখা মেলে না । ঠেকে আসে না । মোবাইলে ফোন দিলে কার্যত অশুদ্ধ নাম্বার বলে
অটো রেসপন্স আসে । মাঝে মাঝে আগেও নাকি এমন হয়েছে । বলা নেই কওয়া নেই মাস খানেকের
জন্য সনাতন উধাও । আবার একদিন ঠিক ঠিক আড্ডাখানায় এসে হাজির হয়েছে । তাই আমরা কেউ
তেমন গা না লাগালেও একটা চাপা আতঙ্কে ভুগি । এই বুঝি মন্দ কিছু একটা শুনলাম । ঠিকই শুনলাম, সনাতন খুন হল ।
চার
কলিম মামু আর আমি বাড়ির দিকে রওয়ানা দেই । সনাতনের স্মৃতি সারাটা পথ আমার
মাথায় মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয় । পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয় রাস্তায় ।
‘এইবার
বুঝবা মাউল্লারা রাজনীতি কেডারে কয় !’
‘এইবার
ফাইস্যা গেসেগা হালার ফুতাইন ।’
‘কেইসটা
শক্ত কইরা করাইতে অইব ।’
আরো ফিসফিস নানান কথাবার্তা,
ছাড়া ছাড়া নানান সংলাপ সেই সাথে হালকা হাসির শব্দও শুনতে পাই অন্ধকারে । তখনি একটা
পুলিশভ্যান আমাদের পাশ কাটায় । সনাতনেরঘনিষ্ঠ বন্ধু জহিরকে এক ঝলক দেখতে পাই ঐ দলে
। আমার বুঝতে বাকি থাকে না ।
“শালা,
হারামির
বাচ্চা”-অজান্তে শব্দক’টা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে ।
পাঁচ
সনাতন মরেনি । এ
যাত্রায় বেঁচে যায় । ঘাড়ের উপর ছুরির আঘাতটা এখনো দগদগে, দেখে মনে হয় ওটা
সনাতনকে অনেকদিন ভোগাবে । বাঁ পায়ের হাঁটু থেকে নিচের দিকটা একেবারে অকেজো হয়ে
গেছে । ক্র্যাচে ভর দিয়ে কোন রকমে হাঁটাচলা করে ।
সনাতনের পরিবারকে দিয়ে ‘এটেমপট
টু মার্ডার’-এর যেমামলাটা সাজানো হয় বিশু-মাণিকদের বিরুদ্ধে, দুর্বল শরীর নিয়ে সনাতন
এর জোরালো প্রতিবাদ করে । বিশু-মানিকরা
সাময়িক
রক্ষা পেলেও
এদেশে থাকতে সাহস পায়না আর । কেবল সনাতন ওদের ভরসা দেয় । দুর্বল
শরীরের সনাতন মনের দিক দিয়ে কতটা সবল-আমরা ভেবে ভেবে ক্লান্ত হই ।