লং বেঞ্চ
পার্কের
এই কংক্রিটের লং বেঞ্চটা বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য উদ্দিষ্ট । একটু নিরিবিলি পরিবেশ ।
সামনেই ছোট্ট একটা ফুলের বাগান আছে তাতে নানান রঙের গোলাপ , রজনীগন্ধা ,ডালিয়া , জারবেরা ইত্যাদি ফুলের শোভায় এক মনোরম
পরিবেশ । বেঞ্চের ওপর ছায়ার জন্য বেশ পেছনে একটা কদম গাছ । বলে কদম গাছে নাকি
কেষ্ট নাচে গোপীদের জন্য , তাই এই - বরিষ্ঠ নাগরিকের বসার
জায়গায় কদম গাছটাই বেশ বেমানান। এই অঞ্চলের কাউন্সিলার ঠিক যায়গাতেই বরিষ্ঠ
নাগরিকদের জন্য বসার যায়গাটা ঠিক করেছেন পার্কের মধ্যে । সামনেই মাঠের মধ্যে
আরেকটা গোলাকার ঘর যার চালাটা এসবেস্টস এর তৈরি । চূড়াটা কোনিকাল আকৃতির এবং
গোলাকার বেঞ্চ , বসার জন্য । মধ্যেখানে সুন্দর অর্কিড।
পাসের দেওয়ালটা খোলা তাই আলো বাতাস আসার অসুবিধা নেই। মোটামুটি বলতে গেলে এরকম
একটা পার্ক সাধারণত সল্ট লেকেই দেখতে পাওয়াযায় ।
প্রসঙ্গে
আসি । এই বেঞ্চটাতে আমরা ৫ জন অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ নাগরিক এসে বিকেল বেলায় আড্ডা
দি। আমরা বলতে ১. পঞ্চুদা , ২. নিহারদা , ৩. রণজিৎ-দা , ৪. সমরেশ দা এবং আমি ।
এনাদের মধ্যে আমি সর্ব কনিষ্ঠ । পঞ্চুদা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ তাই সকলে
ওনাকে সম্মান করেন।
আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক রাজনীতি , খেলা , কিছু ধর্মালোচনা আবার
তার মধ্যে কখন কার্ল মার্ক্স তো কখনো শ্যামা প্রসাদ মুখুজ্জে র আবির্ভাব হয়।
নিহারদা এর আগে পার্টি করতেন । ‘৭১ এ জেলে ছিলেন শুনি। রণজিৎ দা একটু গেরুয়ার ভক্ত। পঞ্চুদা , আমাকে নিজের দলে টানেন । উনি কোন পার্টির আলোচনায় থাকেন না । আমার
তাই ওনাকেই পছন্দ । সমরেশদা কে বোঝা মুশকিল । উনি সব শোনেন কোন মন্তব্য দেন না।
বলতে-গেলে আমরা তিনজন রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি না । নিহারদা আর রণজিৎ দার মধ্যে কথা
কাটা কাটি হলে পঞ্চুদা সামাল দেন। আমি ওই সময় চট করে দুটো রাউন্ড মেরে আসি পার্কের
চারিদিকে। আজকে পঞ্চুদা আসেন নি । নিহারদা খবর দিলেন উনি এপোলোতে আই.সি.ইউ.তে ।
কাল নাকি স্ট্রোক হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড় দেখতে যাওয়ার সাধ হল । এইতো গতকাল
বিকেলে কি সুন্দর ছিলেন । রাতে
কি এমন হল ? সকলকে বললাম চলুন না দেখে আসি ‘পঞ্চুদাকে’
।
পরের দিন সকালে সবাই এপোলোতে হাজির হলাম । ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে
আরও বেশ কিছু সময় বাকি । পাস নিয়ে ওপরে গিয়ে দেখি আই.সি.ইউ. থেকে ডেড বডি বেরুচ্ছে
। সামনেই পঞ্চুদার ছেলে মেয়ে ! সকলে হতভম্ব । কারুর মুখ থেকে কিচ্ছু কথা বেরুলো-না
। মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে । পঞ্চুদার ছেলে নিথর । রণজিৎ দা , নিহার দা , সমরেশ দা সকলেই চোখ
পুঁছছে । আমার
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো । নিজেকে সামলাতে পারলাম না । রণজিৎ দাকে জড়িয়ে বললাম একি
হোল ? রণজিৎ দা শুধু মাথায় হাত
রাখলেন। উনিও চোখ পুঁছছেন রুমাল দিয়ে । নিহারদা সমরেশ দা নিথর । সব শেষ ! এইতো
মানুষের জীবন !! এই নিয়ে এতো গর্ব ।