গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

সা ঈ দা মি মি

২টি অনুগল্প

লাশটা

আমি যখন চার কেলাসে পড়ি তখন ওকাল মামু বললেন, মিয়ার বেটি, আমার আজিতেরে এট্টু পড়াইবার পারবা? এটাই মাত্র ছাওয়াল আমার, কোন মেয়াও (মেয়ে) নাই, ছাওয়ালডারে এট্টু শিক্ষিত করবার চাই । আমি মিয়ার বেটি, ওকাল মামু অবস্থাপন্ন কৃষক, এখানে একটা সামাজিক ব্যবধান আছে, কিন্তু গ্রামগঞ্জে আত্মিয়তার সম্পর্ক বাদে মিয়া কৃষকরা মিলেমিশেই থাকে, অন্তত আটত্রিশ বছর আগে যেরকম দেখেছি সেই ভাবনা থেকে বলা, আমিতো মহা খুশি, ছাত্রজীবনেই মাস্টার হতে যাচ্ছি ।
আজিত (আসল নাম আজিজ) কে পড়ানো শুরু করলাম, হতভাগা এমন গাড়ল কে জানতো! একসপ্তাহের মধ্যে অনুভব করলাম, আমি আমার পড়াই ভুলে যাচ্ছি । আজিতের মাথায় টাকা কামানোর চিন্তা ছাড়া আর কোন ভাবনা নেই, বর্ণশিক্ষা কিংবা জসিমুদ্দিনের কবিতা এসবে ওর কোন আগ্রহ নেই, এমনকি তার বাবার জমিগুলো চাষ করার বিষয়েও কোন আগ্রহ ?  নেই, একেবারেই নেই ।

মামুকে বললাম, পারুম না মামু, ও পড়বার চায় না, মামু আশাহত হলো, আজিত কিন্তু নেহায়েত বালক ছিলো না, আমার চেয়েও বড় কিন্তু সেই কেলাস ওয়ান পাশ দেয়া ওর আর হলো না ।
সাতবছর পরে শুনলাম আজিত বাস ড্রাইভার, পরের বছর শুনি, কোন দুর জনপদের এক ভদ্রলোকের মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছে ও, ওর বাবা মা খুব আহাজারি করতো, ‘হায় রে আমাগের জমিজিরাত কিডায় দেখপেতারপর খবর পেলাম আজিত মরে গেছে, সে বড়লোক হয়েছিলো, আরও ধনী হওয়ার জন্য ইয়াবার চোরাচালান শুরু করেছিলো, কার কার সাথে দ্বন্দ্ব ছিলো তা আমি জানি না, আমার জানার কথাও নয়, কেবল জানি ওর বাবার আমন ক্ষেতের আলে পড়ে ছিলো লাশটা ।

পিকনিক

পিকনিকটা আমাদের হলেও রেঁধেছিলেন বিলকিস খালাম্মা, আমরা আসলে রাঁধতে শিখিনি তখন, তবে মাটির পাতিলে চালডাল মশলা মাখিয়ে খিচুরির মত একটা জিনিস পাকাতে পারি, বলছিলাম পিকনিকের কথা, আমরা বলতাম চড়াইভাতি। আহা, তালাবের টাটকা কালবোশ মাছ, নানান সবজির চচ্চরি, মাসকলাই ডাল, দশমিশালী শাক আর ধোঁয়া ওঠা আউশ চালের লাল মিস্টি ভাত, খালাম্মা হাসি মুখে বেড়ে দিচ্ছেন, আমরা নয়জন মজা করে খাচ্ছি, দৃশ্যটা ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলো ।
সেবার শীত পড়েছে অন্যবারের চাইতে বেশি, বিলকিস খালাম্মাদের বাড়ি জমজমাট, আজ তার গায়ে হলুদ, অন্দর মহল ব্যস্ত, হলুদ-মেহেদি-গিলা-সন্ধ্যা-শংখচূর্ণ একটা কুলায় সাজানো, লালপাড়ের হলুদ শাড়ি পড়া খালাম্মাকে অপ্সরীর মত লাগছে, সেই ফ্রেমবন্দী দিনটার পর ঢলে গেছে অনেক বছরের সূর্য, আমার বয়স এখন পনের ।
তখন বিয়েবাড়িতে মাইক বাজতো দিনরাত, হ্যাজাক বাতির আলো সারা পাড়ায় আভা ছড়াতো, পাড়াগাঁয়ের সেরা গায়করা আসতো, খালাম্মার বিয়েতে বাড়তি আরো কিছু হলো, ঢাকা থেকে আমাদের এক গায়ক মামা এলেন ঢোলক সঙ্গী নিয়ে, আমরা শীতের রাতে খাদির চাদর জড়িয়ে সব ঠাসাঠাসি হয়ে বসলাম ।

মামা হারমোনিয়াম ধরেছেন, ঢোলক মামার আঙুল নাচছে বায়া তবলায়, একের পর এক গান চলছে, এভাবে সুরের মগ্নতায় আরেক সুর ভুলতে পারো বন্ধু তুমি আমি ভুলিনাই, পরকালে যেন বন্ধু একবার তোমায় পাই, যদি না পাই সেকালে প্রেম যাইবো বিফলে. আমার সোনা বন্ধুরে তুমি কোথায় রইলারে..” এত ভীড়ে কারও দেখার কথা নয়, হাসিনা খালা আমার চোখের পানি দেখে ফেললো, ‘ও মা তুমি কানতাছাও কেন? মা রে, কি অইছে?’ এত লজ্জা নিয়ে কিভাবে খালাকে বলি, উঠতি বয়সের মেয়ের আবেগের কথা এভাবে জানতে নেই গো