শনিবারের
কলম
শনিবারের দুপুরবেলা ঘরের কাজপাট সেরে ভিজা চুল এলিয়ে
খাটে আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজে অভ্যাসমত চোখ বোলাচ্ছিল নন্দিতা। এটা ওর রোজকার
রুটিন। সকালে সময় হয়না,দুপুরে সংসারের হাজার
টুককিটাকি কাজের মাঝে যে ক্ষণিক অবসর মেলে সেটা একান্ত নিজের কাজে লাগায় ও। খবরের
কাগজ, গল্পের বই, কবিতার
খাতা। ভাতঘুমের নেশা ওর কোনকালেই নেই। আছে গোপনে একার মনে কলমপেষার নেশা। তা আজকের
শনিবারের বিশেষ উৎসব সংখ্যার গল্প বিভাগের পাতায় এসে থমকে গেল নন্দিতা। নিজের
চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। পরম উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল। শ্বাস দ্রুততর হল।
নামটা আবার পড়লো নন্দিতা। নাহ,ভুল
না। নন্দা সেন। নন্দা ওর ডাকনাম। সেন বিয়ের আগের পদবী। এই নামেই দুমাস আগে
শনিবারের অণুগল্প প্রতিযোগীতায় লেখা পাঠিয়েছিল নন্দিতা। প্রাপ্তি সংবাদটুকুও পায়নি
বলে ভুলেও গেছিল। তার মানে ওর গল্পটাই প্রথম হয়েছে। বিশেষ উৎসব সংখ্যার নির্দ্দিষ্ট
খোলা পাতাটা চোখের সামনে ধরে রেখে নন্দিতা কিছুক্ষন চুপ করে বসেই রইল।গতকাল রাতেই
এই লেখালেখি নিয়ে স্বামী স্ত্রীর নরমে গরমে একটু হয়ে গেছে। নন্দিতার লেখালেখি নিয়ে
চন্দনের কোন সমস্যা নেই, বরঞ্চ বউ যে বইপাগল গল্প
কবিতা লেখে এনিয়ে চাপা দূর্বলতা ও হাল্কা প্রশ্রয়ই আছে কিন্তু সারা বাংলা কবিতা
প্রেমী সমাজ যে পূজোসংখ্যা বার করছে তার গ্রাহকচাঁদা একহাজার টাকাটা ফালতু খরচা
বলে উড়িয়ে দেওয়াতেই বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেই মানুষটা যদি শোনে নন্দিতা প্রথম
হয়েছে তাহলে নিশ্চই খুব খুশী হবে।গল্প প্রকাশ বা প্রতিযোগীতায় জেতার চেয়ে ওর
আনন্দ বেশী হচ্ছে অন্য কারনে।হঠাত্ করেই হাতে কিছু টাকা আসবে। টাকার অংকে দেড়হাজার
খুব কম টাকা হলেও এই মুহূর্তে নন্দিতার কাছে অনেক।
চন্দনের একার উপার্জনেই সংসার চলে। চন্দন যদিও মাসে
একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা নন্দিতাকে হাত খরচ দেয় তবুও এই টাকায় কিছুই হয়না।
নন্দিতাও লজ্জায় আর চাইতে পারেনা। চন্দন মানুষটা ওই রোগাভোগা শরীরেই এম্নিতেই
অনেক কষ্ট করে। আগে বেশ হাসি খুশী থাকতো। ইদানিং শেয়ার বাজারে বড়সড় একটা ধাক্কা
খাওয়ায় সেই হাসিটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের বড়বড় প্রয়োজনের পাশে ঘর
গেরস্থালীর মেয়েলী টুকিটাকির প্রয়োজনীতা একেবারেই খেলো। মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের
অকারন আবদারের দায়ভাগটাও নন্দিতার ওপর দিয়েই যায়। পাঁচ পাঁচটা মানুষের সংসার আর চন্দনের ব্যাঙ্কের সামান্য ক্লার্কের রোজগার।
খরচের কথায় আজকাল চন্দন কেন যে এত খিটখিট করে সেটা বাচ্চারা না বুঝলেই নন্দিতা
বিলক্ষন বোঝে বলেই সব সময় সব কথা আর চন্দনকেও বলতে সাহস পায়না। মাঝেমাঝে নিজের
অক্ষমতার কথা মনে হতেই নন্দিতার কান্না আসে।
মনে মনেই পুরস্কারের হাজার টাকা দিয়ে কি করবে তার একটা
চটজলদি
তালিকা বানিয়ে নেয় নন্দিতা,নাহ ,মজার
কথা হল, গ্রাহক চাঁদার ব্যাপারটাই এখন আর মনে পড়ল না ওর।
চন্দনের একটা টিশার্ট কিনতে হবে। আন্দাজ ৫০০ পড়বে। ওর ভালো টি শার্ট একটাই। দু’বছর আগে নন্দিতার ছোট বোন অনিন্দিতা প্রথম চাকরী পাবার
আনন্দে যেটা কিনে দিয়েছিল। সেই এক টি শার্ট চন্দন অনেক দিন ধরে পড়ছে । মাঝেমাঝে
নন্দিতারই খুব বিরক্ত লাগে। নতুন শার্ট পেয়ে নিশ্চয়ই চন্দন খুব অবাক হবে। বড়
মেয়ে নন্দিনীর দরকার একটা স্কুল ব্যাগ।অনেকদিন ধরে বলছে। হাতিবাগানে একটু ঘুরে কিনলে শ’ আড়াইয়ের মধ্যে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ছোট চাঁদনীর
অনেকদিনের বায়না এটা বারবি। দর করে দেখেছে নন্দিতা, শ’ চারেক যাবে ওতে। বাকি রইলো
এই সাড়ে তিনশোর মত। তা দিয়ে শাশুড়ীমায়ের একটা চপ্পল হয়ে যাবে।হিসাবটা সেরে নন্দিতা
ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চন্দনের এক কলিগের বিয়ে আসতে দেরী হবে। এদিকে কাল রবিবার।
নন্দিতার আর তর সইছে না। আজই একবার হাতিবাগান ঘুরে আসতে হবে। তবে তার আগের গন্তব্য
পত্রিকার অফিস। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নেয় নন্দিতা। দুই মেয়েকে শাশুড়ীর জিম্মায় রেখে
বাসস্টপের দিকে হাঁটা দেয়।
অনেক গুলো চিন্তা মাথায় নিয়ে নন্দিতা প্ত্রিকা অফিসের
দিকে গেলেও সম্পাদকের সাথে দেখা করে পুরস্কারের টাকা পাওয়াটা যত কঠিন হবে বলে মনে
হয়েছিল তার কিছুই হলনা। পুরষ্কারের টাকাটা হাতে নিয়ে নন্দিতা অভিভূতের মত অফিস থেকে বেরিয়ে আসল। সম্পূর্ণ নিজের একক প্রচেষ্টায়, একার যোগ্যতায় জীবনে এত বড় সম্মান ও আগে পায় নি। হাতের
পার্সটায় কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট। তিন টুকরো স্বপ্ন, তিন ফালি আনন্দ, নগদ
দেড় হাজার টাকা। ভাবতেই ভালো লাগছে।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে নন্দিতার যেন হুঁশ এলো। লিখে এত
সম্মান পাওয়া যায়? এত ভালো লাগে নিজের? হাতের মুঠোয় পার্সটা শক্ত করে ধরে। চন্দনকে না জানিয়ে এ
আজীবন গ্রাহক চাঁদাটা দিয়ে দিতেই পারে। এটা ত সংসারের হিসাবের খরচা নয়।পুরোপুরি
বেহিসাবী উপরি পাওনা। বদলে প্রতি মাসে বাংলা কবিতাপ্রেমী সমাজের মাসিক পত্রিকায়
প্রতি মাসে নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে দেখা যাবে। একান্ত নিজের রোজগারে নিজস্ব
বিলাসিতা । কথাটা মনে হতেই নিজের স্বার্থপরতায় নিজেই ধাক্কা খায় নন্দিতা। ছিঃ
চন্দন তো এরকম ভাবে না। এরকম একপেশে ভাবনা ভাবলে আর সংসার করা কেন? বরঞ্চ টাকাটা চন্দন ফিরলে ওর হাতেই তুলে দেবে নন্দিতা। হাসলে ভারী মিষ্টি লাগে
মানুষটাকে। ভাবতে ভাবতে নিজেই গালে টোল ফেলে ফিক করে হেসে নিল। তারপর সবাই মিলে
একজায়গায় বসে ঠিক করবে টাকাটা দিয়ে ঠিক কি কি করা যায়! অতএব ফিরতি বাসে চড়ে নন্দিতা সোদপুরের দিকে রওনা হল। লোকাল বাসে
এম্নিতেই প্রচন্ড ভীড় থাকে। আজ আবার মহালয়ার আগের শনিবার। লোকে লোকারণ্য পথঘাট
যানবাহন। অনভ্যস্ত নন্দিতা শাড়ী ব্যাগ সামলাতে সামলাতে টলোমলো পায়ে কোনরকমে বাস
থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তখনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভীড়ের মধ্যে কেউ
একজন ওর পার্সটা হেঁচকা টান দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ভাগ্যদেবতা এক হেঁচা টানে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল নন্দিতা নামের এক সাধারন মেয়ের কিছু অনাস্বাদিত সুখ, না মেটা ইচ্ছে। তিনটি নিঃষ্প্রান পাঁচশ টাকার নোট আর একটি সচল প্রানের একান্ত গভীর কিছু স্বপ্নমুকুল।
প্রাণপনে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো নন্দিতা, কিন্তু গলা দিয়ে অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গোঙ্গানী ছাড়া কিছুই বার
হল না, তাতেই শনিবারের অলস ভাতঘুমটা মাঝপথে ভেঙ্গে গেল। মাথার
ওপর ফ্যানটা ঘুরতে ঘুরতে দাঁড়িয়ে
গেছে অনড় হয়ে। লোডশেডিং। চাঁদনী ঘুমের ঘোরে মায়ের গায়ের ওপর পা তুলে দিয়েছে
বেকায়দায়। ওকে সরিয়ে ঠিকমত শুইয়ে দিয়ে উঠে বসলো নন্দিতা। শাড়ীর আঁচলেই কপাল গলার
ঘামটা মুছে নিয়ে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালো লেখার খাতাটার দিকে। আবার
কলম ধরতে হবে। স্বপ্ন বুনে নতুন গল্প বানাতে হবে। নতুন করে তৈরী হতে হবে।