গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

সুবীর সরকার

সখিচরণ
                                                  ১

এই ভরা রোদের পৃথিবীতে আজকাল নিজেকে বেশ ভরভরন্তই মনে হয় সখিচরনের। হেমন্তের মাঝামাঝি। চারপাশে রোদের বিস্তার। নরম হলুদ মায়াময় রোদের ভিতর হাঁটতে হাঁটতে কখন কিভাবে যেন জন্মান্তরের ডাক শুনতে পায় সখিচরণ। তার হাতের মোহন বাঁশিটিকে বহুমাত্রিকতায় পেয়ে গেলে ভরন্ত ধানমাঠের ভিতর ঢুকে পড়া। জীবনের পর জীবন সে কেবল রোদ চেয়েছে।
রোদভরা সংসার চেয়েছে। জীবন ফুরোয় না। শস্যের ভাঁড়ারে বুঁদ হয়ে বসে
পড়ে জীবনের ভিতরকার কুহকখন্ডগুলি তাকে ভাবিত করে তোলে।

                                                  ২

সেই মথুরার হাট। ভরা হাটের মধ্যে ঢুকে পড়া। মোরগহাটির পাশের মাঠে
মোরগলড়াই। ধামসা মাদল। চাটের গন্ধ। হাড়িয়ায় আকুল সব হাটুয়া। সখিচরণ
ঠিকঠাক দৃশ্যের ছায়ায় মিশে গিয়ে নিজেই এক দৃশ্যপট রচনা করে ফেলে।তার চার কুড়ির সুঠাম পেশল শরীরে আহ্লাদ জড়ো হলে সে হাটবাজারের দিকে উদাসীন
তাকিয়েই থাকে। চোখের ঘোলাটে পাতায় কীর্তনবাড়ি জেগে উঠলে সে বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও কেমনতর এক দ্বিধাও কাজ করতে থাকে। কালজানির স্রোতে ভেসে যাওয়া শোলার ঠাকুরের মতো। সখিচরণ অতীতচারিতাকে মান্যতা দিয়েই বর্তমানে ফেরে। মথুরা হাটে সন্ধ্যে নামে। সখিচরণ হেঁটে চলে সাহেবপোঁতার জঙ্গলের দিকে। ধনীবাড়ির হরিবাসরে আজ অনিবার্য বাজাতেই হবে তাকে বাঁশিটি। ম্যাজিক লন্ঠন দুলিয়ে  হাঁটুরেরা সঙ্গও
দেয় বুঝি তাকে। হাট থেকে হাটে গানকীর্তন আখরেআখরে  বিমূর্ত  হয়ে থাকে
এই পরিক্রমণ।

                                                    ৩

কীর্তনের তালে তালে দুলতে দুলতে কীর্তনতত্বের আখরগুলির ভিতর ডুবে যেতে যেতে সখিচরণ তীব্র উঠে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়া শরীর নিয়ে কেমন এক অভিজ্ঞতাময়তায় দীর্ঘ জীবনের দিকেই যেন তার নেমে যাওয়া। সখিচরণ কি নিঃসঙ্গ! না কি নিঃসঙ্গতা নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া আস্ত একটা জীবন তাকে কি সত্যিই কোন জীবনযাপন সাজিয়ে দিতে পেরেছিল! সখিচরণের তামাটে গাত্রবর্ণ,
তাকে লালন করেছে হাওড় বাওড় নদীনালার দেশ। বাঘশিকারের দিনগুলি যখন ফ্রেমবন্দী হয়ে শহরের অডিটোরিয়াম মাতায় তখন সখিচরণের তামাটে হয়ে ওঠবার রহস্যটি কিভাবে উন্মোচিত হয়, সে সংশয় জাগরুক হলেও বাতাসে ভেসে
আসে আবহমানের সব আবহমান দেশকালজনলগ্নতা। সখিচরণ কি আদতে অন্তহীন বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভূবনমায়ার বৃওে বসতভিটার ভিতর বৃওান্তের সব দৃশ্যপট
নির্মাণ করতে করতে অতিলৌকিক জীবনযাপনের ভরভরন্তের ভিতর চুপিসারে ঢুকে
পড়তে থাকবে।

                                                  ৪

হিম ও হেমন্তের এই সময় বড় মনোরম এক ইশারায় ডেকে নিলে সখিচরণ ঔদাসীন্য দিয়ে অন্যমনস্কতা দিয়ে দূরেকাছের সব খেতপ্রান্তরআশমান বুঝি দেখতে
থাকে; যেন অনন্তকালের চিরকালীনতায় সে জীবনের অপার রহস্যকে খুঁজতে খুঁজতে
সাহেবপোঁতা থেকে বেরিয়ে আরো আরো কতো মথুরাহাট,সাহেবপোঁতা বা তপসীখাতার দিকে চলে যাবে! জীবনের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে কখনো ভাবতে
দেখা যায় কি তাকে! সে কেবল মেঘ সাজানো আকাশের তলদেশে নদীর পারের
কুলজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ধরাছোঁয়ার খেলাটাই খেলে গেছে আজীবন। তার বিষাদ তাকে অন্তহীন জনমানুষ কীর্তনবাড়ি ভাটিখানা মরিচখেত সরিসাভরা মাঠের দিকদিগরেই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সখিচরণ তার শিল্পীস্বত্বায় টের পায় কেবল
প্রাণবিন্দুটুকুন। প্লুত এক সুখানন্দে আবিষ্ট হতে হতে তার নিঃসঙ্গতায় মধ্যরাতের
শেয়ালডাকের মতো কেবল চিরনতুন বাঁশিটিই বেজে ওঠে। তাকে সঙ্গ দেয়। তখন ভরা শীতের স্মৃতির সঙ্গে সে গুলিয়ে ফেলে ভরা বর্ষার স্মৃতিকেই। তার কি স্থবিরতা আসে? না কি, জীবনের বিষণ্ণতা গান হয়ে উঠতে উঠতে একসময় শ্যাওলাসবুজ কোন কাঠামবাড়ির জঙ্গল হয়ে ওঠে আর মাটিলগ্ন হতে হতে সে বুঝে নিতে থাকে কত কত গাঁথা শোলোক দরবেশী গানের সান্ধ্যভাষা।

                                                    ৫

বহুবর্ণতার ভিতর বহুবর্ণ এক যাপন নিয়ে সখিচরণ যাপনকেই বহুবর্ণ এক জীবনযাপনে উন্নীত করতে থাকে। ঋতুচক্রকাল আবর্তনের ধারাবাহিকতার ভিতর চিরদিনের সব মানুষের রোদের বিস্তারিতের দিকে চলে যাওয়ায় কেমন এক আহ্লাদ থাকে; শীতের হিম, কার্তিকের জ্যোৎস্নায়, কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া নদীবক্ষ সবকিছুর ওপর কেমন এক মায়াময়তার রঙীণ বিছিয়ে পড়া যেন। সখিচরণ ভরভরন্ত যাপন
দিয়েই  তার  অস্ত্বিত্বকে মহামান্য করে তোলে। সখিচরণ আসলে প্রতীক। যে প্রতীকতার আড়ালে আস্ত এক জীবনই বুঝি সংশয়তাড়িত হয়ে চেপে বসে। হাসি,বাঁশি,পেশীময় শরীরের তীব্র আর্তি নিয়েই ভরভরন্ত জীবন হয়ে সখিচরণ
কেবল হেঁটেই যেতে থাকে।