পথের
ধারে পথ
১
আপনি কি পথ হারিয়েছেন ? সুরেলা কন্ঠে কথাগুলো শুনে ব্যস্ত পথের দুরন্ত ছুটে চলা সময় হঠাত্ পেছনে ফিরতে লাগল..দশ..বিশ..তিরিশ বছরের পর বছর । এক্সকিউজ মি, আপনি
কি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না ? সামনে দাঁড়ানো আনুমানিক ২০-২২ বছরের
যুবতীর মুখে পুনরায় কথাগুলো
শুনে ব্যস্ত পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুড়ি । পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই
করে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলোয় কেঁপে
কেঁপে ওঠছে স্থবির ধুলো।ঘুড়ির মনে
পড়ে এই পথেই তার প্রেম হয়েছিলো
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা টপ জিন্স পড়া পেছনে শোল্ডার ব্যাগ ঝোলানো যুবতীর বয়সে।সেই সময় পথের প্রেমে গভীর প্রতীক্ষা।যুবতীর মুখে তখনো প্রশ্নবোধক ভাব ঝুলে আছে।কি বলবে মনে মনে ঠিক করতে করতে ঘুড়ি বদলে যাওয়া পথের চারপাশে বেড়ে ওঠা বাহারী রঙের বিল্ডিং এ চোখ রাখে । এত
রঙের
প্রাচুর্য্যে কোথায় যেন রঙহীন সাদা সময় আজো অপেক্ষার চোখ রেখে বেঁচে আছে। যে পথের পাশে
দাঁড়িয়ে আছি তাকে কখনো চাইলেও ভোলা যাবে না । ভুলতে চাইলেও না ।
যুবতী হয়ত তার প্রশ্নের উত্তর পায়নি কিংবা একটি মানুষকে দীর্ঘক্ষণ একই পথে ঘোরাঘুরি করে দাঁড়িয়ে থাকার কৌতহল থেকেই তার প্রশ্ন উত্তর বোঝেনি। না,মানে অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে দেখছি এই রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছেন তাই ভাবলাম তবে কি অনেকবছর পর এলেন এই শহরে ?
হুম । 'হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি'
আপনার বয়স দেখে তো হাজার
বছরের
মানুষ মনে হচ্ছে না । ঘুড়ি
একটু হাসে । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন পড়নি বুঝি ?
না । তবে
মাম পড়ে এইসব । প্রফেসর তো । আপনিও বুঝি প্রফেসর ?
না। আপনি কি ডিস্টার্ব হচ্ছেন?
না তো ! বরং
তোমার কম্পানী এনজয় করছি । সবাই
বলে আমি নাকি একটু বেশি কথা বলি এইসময়ে অচল ।
ঘুড়ি যুবতীর বলা কথায় বেশ মজা পায় । হাসি ছড়িয়ে বলে আমি কিন্তু তা বলছি না ।
তা তোমার নাম কি ?
ঘুড়ি। ঘুড়ি ! হুম, আপনিও অবাক হলেন তো ? মাম কেন যে
এমন একটা নাম রাখলো বুঝি না,অবশ্য মামের নামটাও আমার মত ব্যাকডেটেট সুতা । হাঃহাঃহাঃ
যদিও মাম বলে ঘুড়ির জন্ম সুতার জন্য আর ঘুড়ি সুতার কম্বিনেশনটা নাকি দারুণ ।
তবে আমার মনে হয় মাম... তোমার মার নাম কি ডঃ সুতা রায় বোস ?
হ্যাঁ । আপনি চেনেন বুঝি ? বিবর্ণ
অতীত ঘিরে আসে চোখের তারায় ছলকে উঠা চায়ের মত উচ্ছাস নিয়ে তাকে কি কখনো ভোলা যায়. ভুলতে চাইলেও সম্ভব নয় বলতে গিয়েও চুপসে
যাওয়া বেলুনের মতো নিজের ভেতর হারিয়ে যায় মিস্টার ঘুড়ি দত্ত ।
২.
কত মানুষ কতভাবে
স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকে। পরিচিত
পথের বাঁকে অনেক কথা,অনেক স্মৃতি । পথ মানুষকে ভুলে যায় কিন্তু মানুষ পথ ভোলে না।প্রতিদিনকার কর্মব্যস্ততা এবং গ্লানির মাঝে অনেককিছু ভুলে থাকা তবু জীবন ফুরায় কিন্তু রাস্তা ফুরায় না । নতুন নতুন রাস্তার মাঝেই রচিত হয় নতুন কোন গল্প,নতুন
কোন ইতিহাস। ডঃ সুতা রায় বোস তার
কর্মব্যস্ত জীবনে যখন মেয়েকে ঘুড়ি বলে ডাকে তখন তার মনটা রাস্তার পাশের ঘাসেরা যেভাবে গাড়ির ছুটে চলায় কেঁপে ওঠে । তেমনি কেঁপে ওঠে তার মন তবুও পুরানো পথের নামে নতুন পথ আঁকড়ে বেঁচে থাকা।ক্লিনিকে মেয়ের জন্মের পর নাম রাখা নিয়ে দুই বাড়ী,বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়,কলিগদের মাঝে হুলুস্থুল । এই নাম,সেই নাম, নাম নিয়ে লটারী সব হলো।বাসায় ফিরে সব নাম এক ফুঁয়ে উড়িয়ে সুতা মেয়ের নাম রাখলো ঘুড়ি রায় বোস। বন্ধুবান্ধবীরা
যেদিন বাসায় এলো নামটা নিয়ে বেশ হৈচৈ
হলো ।
কেবল যারা আয়ুশ দত্ত ঘুড়ি আর সুতার পথে হলো দেরীর খবরটা জানতো তারাই নিশ্চুপ বসে থেকেছে । অনেক তর্ক বিতর্কের শেষে ফেরার সময় মেখলা খুব ধীর গলায় বলেছিলো কেন মিছে ধরে রাখা । জিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন না বলেও অনেক কিছু বলে দিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে হলেও অংকের খুব পছন্দ হয়েছিল ঘুড়ি নামটা যদিও সে নিজের মেয়ের নাম সংখ্যা রাখবে ভেবেছিলো । কিন্তু বাসায় ফিরে ঘুড়ি নামটা বলতেই অংক বেশ উচ্ছাসে বলেছে দারুন শৈল্পিক কম্বিনেশন । সুতা অংকের মেয়ে ঘুড়ি । সংখ্যা হলে শুধু অংকের মেয়ে মনে হতো। চোখের পলকে সময় উড়ে যাচ্ছে। এতগুলো বছরের পথ পাড়ি দিয়েও এখনো কেন সেই ঠিকানাহীন পথ আনমনেই গেয়ে ওঠে 'কেন
মেঘ
আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না....মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাইনা...'
৩
মানুষের বোধ অনেকটা কি দিশাহীন পথের মতো ? মাঝে মাঝে তাই কি সবার মধ্যে থেকেও দূর কোন মেঠো পথের অপার শূন্যতা ছুঁয়ে থাকে জীবন ? অংক ভাবে
আর উত্তর খোঁজে ফেরে মনে মনে । ঘুড়ির
নাম
যে সংখ্যা না হয়ে ঘুড়ি হলো আর তার যে তাতে উচ্ছ্বাস কিংবা ভাললাগা সেগুলোতে কি শূন্যতা মিলেমিশে আছে কোথাও? তার
উত্তর পায় না অংক।কিন্তু একটা
অপরাধ বোধ,একটা গুমোট বেদনা
গুম
করে রাখা তাকে যতটা তাড়িয়ে বেড়েচ্ছে,তারাই কি শূন্যতার নামে লেখা ? এর উত্তর ও পায়না
অংক তবে অপরাধ বোধ টের পায় সে । বহুবার চেয়েছে হালকা হতে,পারেনি
। নিজেকে তার খুব
ছোট লাগে । জীবন পথে চলতে গিয়ে কতশত মুখের সাথে দেখা হয়ে যায় । কত মুখ রঙ হারায়,কত
মুখ দাগ কেটে যায় জীবনের রাস্তায় । অংক তার ছককাটা জীবনের পথে সবসময় টিপটপ।এস.এস.সি. পরীক্ষার শেষে পিসির বাড়ী ঘুরতে গিয়ে পিসির বড় ননদের মেয়ে কৌশীকির সাথে তার পরিচয় হয় । ছিমছাম
গড়নের
ফর্সা সুন্দরী কৌশীকির সাথে তোর্ষার পার ধরে কত হেঁটেছে অংক।রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কৌশীকির কন্ঠে হঠাত্ দেখা কবিতা শুনে অংকের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে তোর্ষার জলে শালবনের হাওয়ায়। সেনাবাহিনীর শ্যুটিং মাঠে হাঁটতে গিয়ে কৌশীকি যখন হাত
ধরে একের পর এক জীবনানন্দ দাশ আবৃত্তি করে গেলো । কৌশীকির মুখস্থ বিদ্যা আর জানার পরিধি অংককে স্তব্ধ করে দেয় । সেই কৌশীকিই হাতে
তুলে দিলো শরতচন্দ্র, নীহাররঞ্জন । প্রথম পাঠ্য বইয়ের বাইরে কিছু পড়ে অংকের মনে হলো কত কি জানার আছে । কৌশীকির প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ গড়ে
ওঠে কয়েকদিনেই । পিসির বাড়ী
থেকে ফিরে আসার পর আর কখনো
কৌশীকির সাথে দেখা হয়নি । তবু কৌশীকি
আজো উজ্জ্বল তার মনে । কৌশীকির
বিয়ে হয়েছে অংক শুনেছে । কেমন
আছে কৌশীকি আজ ? পিসির বাড়ী
থেকে ফিরে বেশ কয়েকবছর তাদের যোগাযোগ ছিলো চিঠিতে । দারুণ সব চিঠি লিখতো কৌশীকি । কবিতার উক্তি দিয়ে দিয়ে । কৌশীকির দুতিনটা চিঠির পর জীবনের প্রথম (পাঠ্য বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখার বাইরে) চিঠি
লেখে অংক।নাজনীনের কথা লেখে । সেইসব সময়ের চিঠি সুতার মতো সযত্নে রাখার কথা তার কখনো মনে হয়নি । সময়ের অমোঘ নিয়মে কৌশীকির চিঠি কমতে কমতে একদিন থেমে যায়। যেভাবে ঠোঁটে উষ্ণতা রেখে রাকিবকে ভালবাসে নাজনীন। সেই প্রথম চুমুর পরিতৃপ্তি আর কখনো মেলেনি । এমন কি সুতার ঠোঁটেও না।সুতার কি মিলেছে অংকের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে
সেই তৃপ্ততা ? অংকের মনে এই প্রশ্ন আগে কখনো আসেনি । প্রথম এই প্রশ্ন জাগে ক্লিনিকে ভর্তি সুতার ডেলিভারীর রাতে সুতার আলমারীতে কাঁথা খুঁজতে গিয়ে ।