পিকনিক
ও হলুদ ভাঁট ফুল
আমি মরে পড়ে ছিলাম।
পাথরের বিরাট এক চাঁইয়ের ওপর। আমার দেহ সটান পড়েছিল। নির্জীব।
বন্ধুরা আমায় জঙ্গলের আনাচে কানাচে নদীর পারে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছিল। ওরা গলা ফাটিয়ে আমার উপস্থিতির জাহির চাইছিল। কিন্তু আমি তো তখন নিশ্চুপ।
বস্তুত ঘটনাটা এমনি ছিল।
পিকনিকে বেরিয়ে ছিলাম বন্ধুরা মিলে। আমি,মনোজ,ভোলা,দুলাল সব মিলে সাত জনের মত। মফস্বল জাগায় থেকেও জঙ্গল,নদী পাহাড়ের দিকেই ভালবাসার টান ছিল বেশী। আর জঙ্গল,নদী, পাহাড় কে না ভালবাসে ?
তখন আমাদের এই সতের আঠার বছরের জীবন চলছিল। মনের মধ্যে টগবগ ফুটন্ত একটা ভাব অনুভব করা যেত। খুব ভোরে উঠেই আমি আর ভোলা জঙ্গলে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য, পিকনিকের জন্যে বন মোরগ শিকার করা। তখন দণ্ডক বনের বস্তারের জঙ্গলে ভরমার বন মোরগ--সে সঙ্গে বাঘ,ভাল্লুক তো ছিলই।
জঙ্গলের ভেতর তখন বেশ অন্ধকার। ভয় এটাও ছিল মোরগ শিকার করতে গিয়ে আমরা নিজেরা না বাঘ,ভাল্লুকের শিকার হয়ে যাই ! তাকে তাকে চলছিলাম--বড় বড় গাছের নিচু ডালগুলো পরখ করে যাচ্ছিলাম।
হ্যাঁ,চোখে পড়লো,গাছের মাথার ফোকর গলিয়ে এক জাগায় সামান্য আলো আভা ছড়িয়ে পড়েছে--আলো আঁধারের যেন সংঘর্ষ চলছিল সেখানে। তারই মাঝে আমাদের চোখে পড়ল দুতিনটে মোরগ মুরগি। ওরা ভোরের প্রতীক্ষা করছিল হবে--সামান্য নড়াচড়া করে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল হবে। ভোলা আর তর সইতে পারল না—হাতে রাখা চাঙড় ছুঁড়ে মারল ওগুলোর দিকে--ক্যাঁক ক্যাঁক ক্যাঁক করে সবগুলি মুরগি সেখান থেকে উড়াল দিল। মোরগ বেশী উড়তে পারে না,ধপ করে নিচে পড়ে সরসর করে জঙ্গলে গিয়ে লুকোলো। প্রথমে ভেবে ছিলাম মোরগটা বোধ হয় আমাদের ভোগেই লাগবে। পরে বোঝা গেল ভোলা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছে। আমার আপসোস হচ্ছিল আমার হাতের পাথরের চাঙড়টার সদ ব্যবহার হয় নি বলে। ব্যর্থতা নিয়ে জঙ্গল থেকে ফিরে এলাম।
পিকনিকের বাজার ঘাট হল। মনের আপসোস নিয়ে দুটো মোরগ কিনতে হল। আহা যদি বন মোরগটা মারতে পারতাম ! বন মোরগের তেলাল মাংসের স্বাদের তুলনা কোথায় !
বাহন সাইকেল। পাঁচ ছটা সাইকেল আমাদের সাথে। সবটাতেই কিছু না কিছু বোঝা ধরা আছে--একটা কেবল ডাবল ক্যারি করছিল। রাস্তার দু পাশ ধরে হালকা বন শুরু হয়ে গেছে। সাল, সেগুন,মহুয়া বহুল গাছের বন। সরু দু তিন ফুট চওড়া লাল মাটির পথ। খানিক উতরাই,খানিক চড়াই। এত সময় সূর্যের তেজটা গায়ে বিঁধছিল। জঙ্গলের মাঝে এলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ শরীর জুরিয়ে দিল। কোন কল্প কথা,গল্প কথার দেশ বলে মনে হচ্ছিল। একেই বোধ হয় বলে নির্জন নিরালা--নীরবতা ভাঙতেই বোধ হয় আমাদের মাঝ থেকে দুজন মাঝে মাঝে গানের কলিতে সুরের টান দেবার চেষ্টা করছিল।
খুব ভাল লাগছিল। কোথাও সূর্যের আলোর অনায়াস প্রবেশ আলোকিত করে ছিল জঙ্গল মহল। কথাও অন্ধকার ঝাপড়ানো গাছদের মাথা ছাতির মত বেড় দিয়ে ছিল। আবার কোথাও পুঞ্জ পুঞ্জ আলোর ঝিকিরমিকির আমাদের মনকে খেলে নিয়ে বেড়াচ্ছিল।
অনেকটা দূর এসে গেছি আমরা। সামনেই কোকরী নদী। পাহাড়ী নদী,আদিবাসী দেওয়া নাম। তার জলপ্রবাহের ক্ষীণ ধ্বনি দূর থেকেই আমাদের কর্ণগোচর হচ্ছিল। বড় মিষ্টি সেই বয়ে যাওয়া জলতরঙ্গ ধ্বনি ! পাহাড়ি নদী ছোট বড় পাথর ঠেলে ধাক্কে--কোথাও তার গায়ে আছাড় খেয়ে কোথাও তার আশপাশ গলিয়ে ঠুং ঠ্যাং শব্দ রণনে আপন মনে ছুটে চলেছে ঢালানে।
ব্যাস,এসে গেলাম স্পটে।
আমি,ভোলা,মনোজ গতকাল এসে জাগা দেখে গেছি। এখানে সেগুনের ছোট বড় গাছ বেশী--মাঝখান দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। সামান্য দূরেই দেখা যায় ছোট বড় পাহাড়--আর কি চাই ! পিকনিকের জন্যে আদর্শ জাগা বলা যায়।
রান্না চাপানো হল। এ ব্যাপারে ভোলা,মনোজ খুব এক্সপার্ট--সঙ্গে হেলপার দুলাল আছে। বাকি আমরা সবাই আশপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।
বস্তুত সৌন্দর্য তো মনের কাছে--এত সুন্দর অপূর্ব জাগা আগে কি দেখেছি কখনও ? না,অন্তত আঠার বছরের জীবনে তো নয় ! ছোট নদীর পারে পারে সুন্দর ফুল ফুটে আছে। সাদা হলুদ লাল বেগুনি—রঙ-বে-রঙের। মাথার ওপর ঝাঁকরানো বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম,আকাশ
বেয়ে কত কত
পাখীরা নিজস্ব ভাষায় আওয়াজ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা চলে এসে ছিলাম। নদীর পার ছুঁয়ে পড়ে আছে বিরাট একটা পাথর খণ্ড। বসে থাকার বা শুয়ে থাকার পক্ষে উপযুক্ত বটে। আমি আর রতন গিয়ে বসলাম পাথরের ওপর। খুব ভাল লাগছিল। চুপচাপ দুজনে বসে ছিলাম,এই শীতের সময়েও পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম,নদীর কলকল তান কানে বাজছিল,এক অদ্ভুত ভাব নিয়ে চুপচাপ শান্ত বসেছিলাম। স্তব্ধতা এত দূর থেকেও ভঙ্গ হল--মোরগের কর্কশ ডাক শুনতে পেলাম। বেচারা মোরগ--এবার কসাইয়ের পাল্লায় পড়েছে নিশ্চয়। ওটা দুতিন ডাক দিয়ে চুপ হয়ে গেল। আবার সেই আগের নিরলস শব্দগুলিই কানে ভাসছিল।
বেশ বেলা হল--হাতের কব্জি ঘুরিয়ে দেখে নিলাম,ঘড়িতে তিনটের কাছাকাছি। সময় দেখার পরই খিদেতে যেন পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। আর সে সঙ্গে শুনতে পেলাম ভোলার ডাক,চীৎকার, তপন,তপন,রান্না হয়ে গেছে,তোরা খেতে আসবি না কি ! স্নান সারা ছিল--পাহাড়ি নদীতে স্নানের ঝুঁকি নিই নি।
ভাল খেলাম। বিশেষ করে মোরগের মাংস,ভোলাটা রাঁধতে পারে ভালো।
খাওয়া শেষে আমি,রতন আর দুলাল শতরঞ্চি বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোলা,মনোজ ওরা আশপাশের জাগা দেখতে গেল। খানিক ঝিম মেরে মানসিক বিশ্রাম নিয়ে উঠে বসলাম--শারীরিক শ্রম করলাম কখন ? আবার কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখলাম। আরে চারটা বেজে গেছে ! আর আধ ঘণ্টার মত থেকেই ঘরের দিকে রওনা দিতে হবে। না হলে শীতের দিন ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে আসবে। আর তা হলে বলা যায় না--বাঘ,ভাল্লুক বেরিয়ে আসতে পারে!
রতন,দুলালের চোখ লেগে গেছে,ওদের আর ডাকলাম না। আমি উঠে ধীরে ধীরে চলে গেলাম সেই বিটার পাথরের চাঁইয়ের দিকটায়। ইচ্ছে হচ্ছিল,নদী দেখার,তার পারে ফুটে থাকা সুন্দর রঙিন ফুলগুলি আবার একবার দেখে নেবার।
পাথরের ওপর
কিছু সময় বসে আছি। হঠাৎ খেয়াল হল,মনে হল,ওই ফুলের কাছাকাছি গেলে কেমন হয় ! পাথরের পাশ দিয়ে সাবধানে নদীর জলের কাছে নেমে গেলাম। ভাঁট ফুলের মত সাদা আর হলুদ অনেক ফুল ফুটে আছে--গাছগুলি ছোট ছোট এলোবেরার মত গাছ। এলবেরার কাঁটা আছে, এগাছগুলিতে তা
নেই। একটা ফুল তুলতে ইচ্ছে হল। সাদা ফুল তুলতে গিয়ে শেষে হলুদ একটা ফুল তুলে নিলাম। গন্ধ শুকতে গেলাম--মনে পড়ল জঙ্গলে নাকি অনেক বিষাক্ত ফুল আছে--তার গন্ধে বিষ থাকে। সে বিষে মানুষের মরে যাওয়াও বিচিত্র নয়! না ফুল নাকের কাছে নিলাম না--ফুল হাতে নিয়ে সেই পাথরের গায়ে উঠে এলাম।
কেন যেন স্বপ্নালু একটা ভাব আমায় জড়িয়ে নিচ্ছিল। ঘুম ঘুম ভাব অনুভব কর ছিলাম। মনে হল আমার হাতের ফুল থেকে হালকা মোহময়ী এক ধরনের গন্ধ আসছিল ! না,না,করেও অনুভূতির আবেশে ফুলটাকে নাকের কাছে টেনে নিলাম। মাঝারি আকারের হলুদ ফুল--তার মাঝে সাদা কেশরের অনেক ছোট বড় ডাঁটা ছড়িয়ে ছিল। আরও একটু কাছে নিলাম ফুলটাকে--আর নিজেরই অজান্তে কখন যেন তার মিষ্টি সুবাস নাক ভরে টেনে নিলাম। শুয়ে ছিলাম পাথরের ওপরে--দেখতে পারছিলাম,আমার চারদিক ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা,কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে...
সবাই তপনকে খুঁজছিল। তপন,তপন,বলে চীৎকার
করে ডেকে ফিরছিল। মনোজ,ভোলা এসে দেখল,তপন
শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে যেন—কিন্তু তপনের দেহ এমনি নেতিয়ে পড়েছে কেন ! ভোলা চীৎকার
দিয়ে সবাইকে ডাকল। মনোজ তপনের নাকের কাছে হাত রাখল। না শ্বাস নেই--দুলাল তপনের
বুকে কান পাতল--না,বুকের
ধুকধুকি শব্দ নেই,বুকের
ওঠা নামাই বা কোথায় !
মাথায় হাত রেখে বসে পড়ল
সবাই।
ভোলা তার মধ্যে আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,তপন মরে গেছে রে রতন ! ওর গলায়
কান্নার ভাব স্পষ্ট হয়ে আসছিল।
দুলাল বলল,সাপে কাটেনি তো--না হলে--
মনোজ আশপাশ দেখতে লাগলো। ভোলা তপনের শরীরে সাপের দংশনের
জাগা খুঁজে ফিরল। ওরা নিশ্চিত হল,তপন মারা
গেছে। তার ঘরে খবর দিতে হবে। মৃত দেহ এখান থেকে তুলে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।
এদিকে আমার ক্ষীণ অনুভবে আমি জানতে পারছি আমি মৃত। সবার
উপস্থিতির কথা অনুভবে আসছিল। আমার দেহ সটান পড়ে আছে পাথর খণ্ডের ওপর।
আমার অনুভূতি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছিল--চোখ খুলে দেখছিলাম সবার জাল শরীর ধীরে
ধীরে আলোকিত হয়ে আসছে ! এক সময় ঘোর ঘোর
ভাবের মধ্যে উঠে বসলাম। আমায় লক্ষ্য করে সবাই চীৎকার দিয়ে উঠলো,তপন বেঁচে আছে--তপন
বেঁচে আছে--
এবার সেই হলুদ ভাঁট ফুলটা আমার চোখে পড়ল। আমার থেকে ওটা
অনেকটা দূরে পড়ে ছিল। বন্ধুদের চোখে মুখে আনন্দ,খুশির
আলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। আমায় ওরা জড়িয়ে ধরল। আমি তা হলে মরি নি !